দৃশ্য এক। ১৯৪৩। দেশভাগ হয়নি। অবিভক্ত বাংলার কোন মফস্বল শহর। মাঠে মাঠে কাশফুল দেখা দিয়েছে। অনিবার বর্ষণ শেষ। এক হাঁটু কাদায় ডোবা রাস্তাগুলো সদ্য পরিষ্কার আর খটখটে হয়ে উঠেছে। জমিদারদের আটচালায় বাঁধা হচ্ছে খড়ের কাঠামো। ইশকুলে পড়া চলছে কিন্তু মন উড়ু উড়ু। পাঁচ ভাইবোন যেন আনচান করছে। উমা, রমা, ধ্রুব, পার্থ গোরা। বাবা থাকেন কলকাতায়। কাজে। এই ত কদিন পরেই পুজোর ছুটি। সবার জন্য জিনিস নিয়ে ফিরবেন বাবা, অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছেলেমেয়েরা। বাবা এলে বাবার সঙ্গে আসবে টিনের তোরংগ আর অনেক পোঁটলাপুঁটলি। প্রতিটায় পুজোর গন্ধ মাখা। নতুন নতুন শহুরে জিনিশ। খেলনা, চুড়ি। টিপ। আর পুজোর কাপড়, তাঁতিবাড়ির গন্ধমাখা এক গোছা শাড়ি। মায়ের লাল পেড়ে কস্তাপাড়। বাড়ির সব মহিলার জন্য এইভাবে তাঁতের শাড়ি আসে। একশো সুতো একশো বিশ সুতোর শাড়ি মা কাকিমার, তো কাজের মহিলাদের জন্য মোটা কাপড়। কিন্তু সুন্দর রঙিন পাড়। ধুতি আর গামছা পুরুষদের। আর ছেলেদের জন্য হালফ্যাশনের নতুন শার্ট প্যান্ট। কলকাতার দোকানের ছাপ মারা কাগজের কৌটোয় বা ঠোঙায় পোরা। এই সবে মড়মড় করছে মাড়ের নতুন নতুন গন্ধটি। আর তার সঙ্গে মচমচ করছে নতুন বইয়ের গন্ধ। কী সব মোটা মোটা বাঁধানো বই, দেবায়ন, দেবদেউল, মনোবীণা, আজব বই, পুষ্পাঞ্জলি, মণিহার। দেব সাহিত্য কুটিরের প্রতিবছর একটা করে নতুন বই বের হয়। সম্পাদনা করেন আচার্য নরেন্দ্র দেব, অথবা প্রেমেন্দ্র মিত্রের মত লেখক। লেখেন কে নয়? প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা, আশাপূর্ণা দেবী, রাধারাণী দেবী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিধায়ক ভট্টাচার্য নরেন্দ্র মিত্র নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। টেনিদা আর ঘনাদার একটি করে গল্প থাকে। থাকে অমরেশের ওপর নাটক। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের রক্তজমাট বাঁধানো রহস্য কাহিনি। বুদ্ধদেব বসুর একটা করে আশ্চর্য গল্প। ছোট কোন মেয়েকে নিয়ে, ঠিক যেন উমা বা রমার কথা। তাছাড়া পাতা জোড়া জোড়া ছবি। প্রাচীন কোন কাহিনির সঙ্গে প্রতুল গুপ্তের আঁকা রাজা রাজড়ার পাঁচ রঙা ছবিগুলো দেখে খাতায় আঁকে নিজে রমা। উমার পছন্দ হাসির গল্পের দু রঙা ছবির তলায় লেখা টুকরো ডায়ালগ।
কাট টু ১৯৪৭ । মজুমদার বাড়ি, ঝামাপুকুর লেন। চালু হল শুকতারা পত্রিকা। বাঁটুল দি গ্রেট আর নন্টে ফন্টে লিখতে আঁকতে শুরু করলেন নারায়ণ দেবনাথ। পঞ্চাশ ষাট পেরিয়ে সত্তরের দশক।
দৃশ্য দুই। কাট টূ সত্তরের দশক। ষাটের মাঝামাঝি জন্ম উমার মেয়ে তুতুন আর ছেলে বুবুনের। ১৯৭১। চালু হল আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী। । নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী , তিনি নাকি এর সম্পাদক। নিজে কী ভাল ভাল ছড়া লেখেন। সাবান মেখে কাল মেঘের বাচ্চা হল সাদা। খেলা ছিল, এর সঙ্গে মিলিয়ে ছড়া লিখতে হবে। সে বোধ হয় আরো পরে। প্রথম পুঊজাবার্ষিকীতেই প্রফেসর শঙ্কুর গল্প, সত্যজিৎ রায়। সন্দেশে ত তিনি লেখেনই, আরো লেখেন লীলা মজুমদার অজেয় রায় নলিনী দাশ। নলিনী দাশের গন্ডালু পেলে তুতুন ছাড়বেই না। প্রতি বছর চারটে মেয়ে রহস্য উদ্ধারে বেরোয়।
তাদের হাতে এখন উমা তুলে দেন পূজাবার্ষিকী সন্দেশ, আর আনন্দমেলা, শুকতারা, কিশোর ভারতী।
বছর ঘুরে ঘুরে আসা পুজোর আর সব আশা আকাঙ্ক্ষায় জড়িয়ে প্রতিবচ্ছর আনন্দমেলায় শুরুতেই অসামান্য সব ইলাসট্রেশন বহুল প্রফেসর শংকু। তারপর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সন্তু কাকাবাবু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কলমে মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি র মত অবিশ্বাস্য মারাত্মক উপন্যাস। সমরেশ বসুর গোগোল, বুদ্ধদেব গুহর ঋজুদা… শেষ পাতে মতি নন্দীর একের পর এক খেলার জগতের উপকথাপ্রতিম গল্প। কোনি বা স্ট্রাইকার বা স্টপার।
তাছাড়া অসংখ্য গল্প। প্রতিটি নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে বুবুনরা।
আর বাবা মায়েরা পড়েন দেশ আনন্দবাজার পত্রিকা যুগান্তরের পূজাসংখ্যা। উমা-রমার কৈশোর বেলায় হা পিত্যেশ থাকত দেশের শারদ সংখ্যার পাতা উল্টে পরশুরাম আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাদুটি পড়ার। আপাতত থাকে আনন্দবাজার পত্রিকায় নীললোহিতের উপন্যাস কালকূটের উপন্যাস , বিমল কর রমাপদ চৌধুরী। পিকনিক, এখনই, খারিজ বা বাহিরির মত রমাপদ ক্লাসিক সবই পূজাসংখ্যার পাতায় পাওয়া। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে দেশের উপন্যাস, সমরেশ বসুর কলমে গল্প বা উপন্যাস । সত্তরের দশক আলো করা লেখা সব। ছোটরাও দেশ বড়দের সঙ্গেই টানাটানি করে নিয়ে পড়ে, কারণ প্রথমেই থাকে ফেলুদার উপন্যাস। আবার বারো তেরো বয়স থেকে বুবুণ বা তুতুন ফেলুদা খুলে রেখে চটপট “বড়দের” উপন্যাস গুলোতেও চোখ বোলায়। নীললোহিতের কিশোর কিশোরী প্রেম, অথবা মিষ্টি খুনশুটির গল্পগুলোয় বড় বেশি চোখ চলে যায়।
এর পর পরই, আজকাল সংবাদ পত্র হিসেবে এসেছে আশির দশকে। বর্তমান সত্তর দশকের শেষ দিকে । এদুটি কাগজের পূজাসংখ্যাও এর পর বেরবে। ততদিনে দেবেশ রায়ের মত লেখক, অমর মিত্র ভগীরথ মিশ্রের মত বহুপ্রজ লেখক উপন্যাসের ধারাটিকে অন্য এক খাতে বওয়াতে শুরু করেছেন। তাঁরা গোটা আশি ও নব্বই জুড়ে লিখে চলবেন।
কবিতার পাতা নিয়ে ঝগড়া লেগে যাবে ছোড়দা আর ছোট মাসির ভেতর। রাজলক্ষ্মী দেবীর লেখাটা থাকে একেবারে শুরুর দিকে। নামটা কেমন পুরনো পুরনো, অথচ লেখাটা ভীষণ চমকে দেওয়া। একে একে নীরেন চক্রবর্তীর কবিতা , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পাশাপাশি পড়ে ফেলবে তারাপদ রায় অথবা বিজয়া মুখোপাধ্যায়কেও। শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় সোজা সোজা লেখেন। আর জটিল লেখেন ভীষণ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।
এইভাবে বড় হয়ে যাচ্ছে ওরা। ওদের বড় হবার পথে পথে ছড়ানো থাকছে শারদ সংখ্যার কবিতা উপন্যাস, গল্প। রমাপদ চৌধুরীর এখনই, পিকনিক, যে যেখানে দাঁড়িয়ের মত উপন্যাস অসম্ভব টানছে , সঙ্গে সুধীর মৈত্রের আঁকা অসামান্য সব আকর্ষণীয় স্কেচ। বিমল করের উপন্যাস অথবা বড় গল্প কাড়াকাড়ি করে পড়তেই হয়। মতি নন্দীর লেখা কিশোর উপন্যাস কোনি, স্টপার, স্ট্রাইকার, প্রতি বছরের আনন্দমেলায় চমকে দিচ্ছে ক্রমাগত।
পাশাপাশি ছোটগল্প সম্বন্ধে ওরা সচেতন হয়ে উঠছে। কত না ধরণের গল্প যে! আশ্চর্য যাদু তাদের। ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী। শেখর বসুর গল্প পড়ছে, যেখানে একটা মানুষ গাছ হয়ে যায় ধীরে ধীরে, বনের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে। প্রতি সংখ্যা আনন্দ বাজার পত্রিকা শারদ সংখ্যায়, একটি করে রমানাথ রায়ের আশ্চর্য ভঙ্গিমার গল্প থাকে। সে গল্পের লেখার ধরণ এতটাই আলাদা… তার প্রতি বাক্য সরল থেকে সরলতর, অথচ বিষয় নাগরিক জটিলতা। এসব লক্ষ্য করতে করতে পড়তে পড়তেই নেশা ধরে যায় যেন। এসবের মধ্য দিয়েই অক্ষর প্রিয় হয়ে ওঠে।
বুবুন এখন পয়ঁতাল্লিশ, তুতুন পঞ্চাশের কোঠায়। বাবা মা দুজনেই আকাশের তারা হয়ে গেছেন। আর এখন তো শরৎ অব্দি বর্ষা, আর শারদ সংখ্যাগুলো কোনটাই ঠিক পুজোর ছুটির সময়ে বেরোয় না, আর পুজোর ছুটি বলতেই সে অর্থে আর কী আছে ওদের জীবনে! ওদের ছেলেমেয়েরাও যে পুজো সংখ্যার জন্য হা পিত্যেশ করে থাকবে তাও না। সারাবছরই তো টুকটাক বই কেনা হয়। বেশির ভাগই ইংরিজি বই। তবে আনন্দমেলা আর সন্দেশ নিয়ম করে কেনে ওরা, যতটা না ছেলেমেয়েদের জন্য তার চেয়ে বেশি নিজেদের জন্যই। আনন্দমেলায় হর্ষবর্ধনের ছবিতে গল্প আর ফেলুদার কমিক্স মিস করে না।কিন্তু তারপর? সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কলমে মিতিনমাসির গল্পটাও গত কয়েক বছর ধরে আর বেরচ্ছে না। বেশ কিছু নতুন লেখক এসেছেন ঠিকই, কিন্তু পড়ার লোকগুলোই যে নেই।
কেন এখনকার শারদ সংখ্যা টানছে না পাঠককে? উত্তর খুঁজতে গেলেই অনেক আলাদা আলাদা দিক থেকে উত্তর আসে। লেখক বলেন, আমি খেটেখুটে লিখছি ঠিক, কিন্তু বাংলা পড়ার দিকে ত কারুর মন নেই। পাঠক বলেন, কোথায় গেলেন সেই সব মহীরুহ প্রতিম লেখক? লেখক বলেন, টিভি সিরিয়াল ছাড়া আর কেউ যদি কিছুতে আকৃষ্ট বোধ না করে, সাহিত্য বোধ যদি না থাকে, তাহলে গল্প পড়ার লোক থাকবে না। পাঠকেরা বলেন, চারপাশে যা যা ঘটছে তার অতি সামান্য অংশের প্রতিফলন হচ্ছে লেখায়। প্রেমের গল্প আর টানে না কারুকে, নতুন রহস্যকাহিনি কোথায় লেখা হচ্ছে আর? হচ্ছে না গবেষণাধর্মী কোন নতুন বিষয়ের ওপর উপন্যাস লেখাও। নানা রকমের চাহিদা আর জোগানের বৈপরিত্যে ভুগছে বাংলা ভাষার শারদ সংখ্যাগুলি।
তবে সবচেয়ে খারাপ বদল যেটা হয়েছে, সেটা হল, শারদসংখ্যা আনন্দমেলা এখন রথের সময়ে বেরিয়ে যায়। ঘোর বর্ষায়। পুজো পুজো গন্ধটা গায়ে না মেখেই।
২
অধুনার পুজোসংখ্যা কে পুজো শব্দটা র সংগে জড়িত রাখাতেই প্রথম বিপত্তি। সেক্যুলার হতে এখন বলি শারদ সংখ্যা।
এখানেই শুরু কিন্তু শেষ কোথায়?
১৯৭০-১৯৯০ কালখন্ডে পুজোসংখ্যার হাত ধরে আমাদের যাবতীয় আরবান লেজেন্ড বা শহুরে ইতিকথা র উংপত্তি। বাঙালি নস্টালজিয়া প্রবণ জাতি হয়ে উঠেছে, কেবলই অতীতে কী ছিল আর এখন কী নেই তা নিয়ে বেদনা বিধুর হয়ে থাকতে চাইছে। অজস্র লেখালেখি হচ্ছে তা নিয়ে , এমনকি প্রচুর সেমিনারের বিষয় ও কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বাঙালির স্মৃতি বিধুরতা।
এইসবের মধ্যে কতগুলো জরুরি প্রশ্ন এইই যে, আমরা যে কথায় কথায় পুরনো স্বর্ণযুগের কথা বলছি, আর হা হুতাশ করছি অতীতের শারদ সংখ্যাগুলোর সমৃদ্ধি আর আজকের শারদ সংখ্যার অপুষ্টি নিয়ে, এটা কতটা ঠিক!
এই সমৃদ্ধি আর অপুষ্টির ছবিটা কি শুধুই সাহিত্যে? এটা ত একই সঙ্গে অন্য অনেক গুলো সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রেও মজুদ। একইরকমের অতৃপ্তিবোধ সেখানেও আমাদের, বিনোদন মাধ্যমগুলির উপভোক্তাদের!
যথা, পুজোর গান বলতে বাঙালি্র যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা, তৃষিত প্রতীক্ষা, উৎসুকতা ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে, তার দশাটা ভাবা যাক। এখন পুজোর গান , পুজোর বেসিক ডিস্কের রেকর্ড ইত্যাদি ইত্যাদি অবলুপ্ত, কেননা প্রযুক্তির মাধ্যমটাই পালটে গিয়েছে। বছরের যে কোন সময় যে কোন গান রেকর্ড হচ্ছে ও বাজারে পণ্য হিসেবে পেশ হচ্ছে। এবং অতৃপ্তিবোধে ভরা গোটা “মেলডির অভাব” ইত্যাদি ইত্যাদি গল্পটা না হয় আবার নাই বা পুনরুক্তি করলাম।
একইভাবে , অন্য মাধ্যমগুলিও কি সমান আক্রান্ত নয়? সিনেমার ক্ষেত্রে একমাত্র কিছুটা বা সজীবতা লক্ষণীয় , কেননা এখনো পুজো , শীতের ছুটি ক্রিসমাস ইত্যাদি ধরে ধরে বেশ কিছু বাংলা ছবি রিলিজ হয়, এবং এক ঝাঁক নতুন পরিচালক ও বাজারে উপস্থিত যাঁরা এখনো নতুন নতুন ছবি বানিয়ে চলেছেন। সবটাই যে খুব উপভোক্তা প্রিয় তা নয়, সেখানেও কেউ কেউ নস্টালজিয়া, বাঙালির ‘সব গেল গেল’ প্রবণতাকে খাটিয়ে, পুরনো বিখ্যাত ছবিগুলোর থিম বা সিচুয়েশন কপি পেস্ট করে পুরনোর আদল এনে চালাচ্ছেন।
কাজেই সমস্যাটা একা সাহিত্যক্ষেত্রের নয়। তবে অবশ্যই শুধু সাহিত্যের কথা বলতে যদি হয়, আমরা বলব, শারদ সাহিত্যে সম্পর্কে কিছু কিছু দৃষ্টান্ত রাখতেই হয়।
এক, আগে যে মোনোপলি ছিল আনন্দবাজার পত্রিকা দেশ সাহিত্য পত্রিকা আনন্দলোক আনন্দমেলার, তা কিছুটা মিলেমিশে গিয়েছে অসংখ্য , অগুনতি নতুন পত্রিকার শারদ সংখ্যার ভিড়ে। আমাদের “আম পাঠক” , ধরা যাক শ্রীযুক্ত অ, আজ যদি শারদ সংখ্যা বলতে শুধুই “কাগজওয়ালাকে বলে দিও ত, দেশ টা দিতে” বলে দায় সারেন চলবে না। তাঁকে স্ক্যান করতে হবে বর্তমান আজকাল প্রতিদিনের শারদ ইস্যুগুলিও, বেশ কিছু অন্যধারার লেখা এইসব কাগজ থেকেই চিরদিন বেরিয়েছে আজ ও বেরয়। বাঙালির রুচি তৈরির কাজটা শুধুমাত্র আবদ্ধ নেই প্রফুল্ল সরকারের ঘরানায়, এটা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তিনি যদি সত্যিই সাহিত্য প্রেমী হন, তাঁকে ত খুঁজে পেতে আনতে হবে, শিলাদিত্য পত্রিকার শারদ সংখ্যা, যে সংখ্যায় তিন বছর পর পর বের হয়েছিল বর্ষীয়ান মণীন্দ্র গুপ্তের সাড়াজাগানো, রীতিমত আশ্চর্য করে দেওয়া তিন তিন খানা উপন্যাস। নুড়ি বাঁদর, আলতামসি, নেংটি।
দুই, কিছু ট্রেন্ড উঠে আসছে, অভাববোধের জায়গা পুরণ করতেই। দু তিন বছর আগে দেশ শারদ সংখ্যায় এসেছিল এক না পড়া লেখকের অন্যরকম উপন্যাস, নকশাল আন্দোলনের ইতিবৃত্ত নিয়ে । সুপ্রিয় চৌধুরী্র " দ্রোহজ" উপন্যাস। দেশে । পর পর ভাল কিছু শারদ সংখ্যা ছেপেছিল মঙ্গলকাব্য, পুঁথি, প্রাচীন সাহিত্য নিয়ে বেশ কিছু উপন্যাস। মহাভারতের ওপর আধারিত বেশ কয়েকটি উপন্যাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে, হর্ষ দত্ত, সৌরভ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের কলমে। বাণী বসুর কলম সেভাবেই ঐতিহ্য ও মেধাবী উত্তরাধিকার কে রক্ষা করছেন। যেভাবে অতীতে দেবেশ রায় পর পর দিয়েছেন মারাত্মক আক্রামক বেশ কিছু রাজনৈতিকভাবে তীক্ষ্ণধী উপন্যাস। অমর মিত্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের লেখাকে নানা ভাবে বদলে প্রায় প্রতি শারদ সংখ্যায় লিখেছেন উপন্যাস, মূল অভিঘাত মানুষের দিকে রেখে। অনিতা অগ্নিহোত্রী পর পর কয়েক শারদ সংখ্যায় লিখেছিলেন মহানদী নামের মহা উপন্যাসটির টুকরো । এগুলির বৈশিষ্ট্য এগুলি আম পাঠকের জন্য নয়, হয়ত বা মেধাবী, ইনিশিয়েটেড পাঠকের জন্য। তাঁরা ঠিকই খুঁজে নেন লেখাগুলি।
তিন, হয়ত ওপরের শেষ বাক্য থেকেই বলা যায় আম পাঠক বলতে কাদের বুঝি? তাঁরা মনে হয় আর পড়েন না , এমন কি ভাল সিনেমাও দেখেন না তাঁরা। তাঁরা ত বাংলা সিরিয়াল দেখেন। তাহলে পড়ার জিনিস নেই বলে দুঃখ করছেন কারা? এখন আসলে পাঠক বলুন পাঠক, আর ভোক্তা বলুন ভোক্তা, নানা সামাজিক অর্থনৈতিক স্তরে ভাগ হয়ে গেছেন। আইনক্স বা মালটিপ্লেক্সের দর্শক আর গ্রামের ভিডিও পার্লারের দর্শক এক নেই। তেমনই লিটল ম্যাগের পাঠক, আছেন, কম সংখ্যায় এবং তাঁরা খুঁজে খুঁজে ভাল জিনিস পড়েন। আর আম পাঠক যাঁরা চারটে তাঁতের শাড়ির সঙ্গেই একটা শারদ সংখ্যা কিনে লুচি বা পোলাও খেয়ে পুজোর দুপুরে দিবানিদ্রার আগে পড়ে নিতেন দু পাতা, তাঁরা সরে গেছেন সিনেমা টিভিতে… এবং ওই উপভোক্তা ক্ষেত্রটাই হয়ত একেবারে উধাও!
চার, তবু ভাল লেখা ত হয়েই চলেছে। এবং অনেক লেখাই সরাসরি বই হচ্ছে। বড় লেখা হলে ত বিশেষ করেই। তাই ত, দেবতোষ দাশের বিন্দু বিসর্গ, পত্রভারতী থেকে বই হয়েই বেস্ট সেলার হল। এই প্রবণতার কারণ কী? শারদ সংখ্যায় সব ভাল লেখা ঠাঁই পায়না বলেই, বা লেখকেরা নানা হাউজের দাক্ষিণ্যের অপেক্ষা আর রাখেন না বলেই। আগে হাউজগুলি নিজেদের এই সব সংখ্যার মাধ্যমে লেখকদের প্রমোট করতেন। এখন স্বাধীন হয়েছেন লেখক, পেয়ে গেছেন ফেসবুকের মত মাধ্যম যা দিয়ে সরাসরি পাঠকের সংগে যোগাযোগ ও নিজের লেখালেখির প্রচার হয়ে চলেছে।
যেমন, উপন্যাস লিখে সরাসরি বই করার প্রবণতা বাড়ছে, তেমনই উচ্চমার্গীয় সচেতন পাঠক সংখ্যায় কম হলেও, ফেসবুক বা অন্যান্য পিয়ার গ্রুপের মাধ্যমেই, জেনে যাচ্ছেন প্রিয় বইয়ের কথা। খাপ পেতে ধরে নিচ্ছেন সে বই গুলিকে। আবারো প্রযুক্তিগত পরিবর্তন। মাধ্যমের পরিবর্তন। যেমন গত দু তিনবছরের প্রীতম বসুর পাঁচমুড়োর পঞ্চানন মঙ্গল ও চৌথুপীর চর্যাপদর মত বই হিট হয়েছে। হিট শব্দটি জেনে ব্যবহার করলাম। দুটি বইই প্রাচীন পুঁথির সাহিত্যকে ব্যবহার করেছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক উপন্যাস বেরিয়েছে, অতীশ দীপংকরের জীবন নিয়ে সন্মাত্রানন্দের বই “নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা", এটিও হিট, পাঠক সমাদৃত এবং বহুল বিক্রীত।
পাঁচ, বই নয়, পত্রিকা নয়। পাঠক তবু আগের চেয়ে অনেক বেশি পড়ছেন বলে আমার ধারণা। কারণ, অসংখ্য ওয়েব পত্রিকা, ই জাইন, ব্লগ সাহিত্যের সাইট, এইসবে , এবং ফেসবুকের দেওয়ালে , প্রচুর লেখা তাৎক্ষণিক ভাবে ছাপা হয়ে চলেছে এবং পড়া হয়ে চলেছে। দ্রুত পঠনে এখন বাঙালির জুড়ি নেই। আর পুজোর দিনে তাদের প্রায়শই ছুটি থাকেনা, মাসি পিসি মামা মামিও নেই এবং ভাত ঘুম ও অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। তাই পত্রিকার পাতা ওলটানো বন্ধ। মোবাইলে পড়া ঢের ভাল।
ছয়, আর, শারদ বিনোদন, শারদ সাহিত্য, শারদ জামাকাপড়ের মতই আসলে বাঙালির অভ্যাস থেকে উধাও। কারণ একদা সম্বৎসর নামক ঘটনাটি ছিল, বছরে একবার একটা ভাল কিছু পাওয়ার জন্য হা পিত্যেশ ছিল। এ মুহূর্তিক পণ্যমাখা জীবনে, প্রতি দিন প্রতি মাসের চাহিদা প্রয়োজন মত যা খুশি কিনতে চাইলেই কিনে ফেলার দিনকালে, সারা বছরে একবার ভাল কিছুর জন্য কে বসে থাকছে আর? পোশাকের ক্ষেত্রে মা মাসিদের বছরে একটিবার, বা বড় জোর দু জোড়া শাড়ি পাবার দিন কি আছে আর?
পুজোয় থিম এসেছে, পোশাকের বিজ্ঞাপনে বাঙালির শাড়ির সঙ্গে সমান তালে কুর্তি লেহেঙ্গা চলেছে, তাহলে, যাবতীয় অপরিবর্তনীয় প্রাচীন আমেজ আশা করছি কেন আমরা কেবলমাত্র পত্র পত্রিকার শারদ সংখ্যায়? তবে কি সাহিত্যের এই অবলম্বনটির দিন গিয়াছে?