তখনও বাঙলার ষড়ঋতু স্পষ্ট চেনা যায়। প্রকৃতি আর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে দেয়া যায় আনুমানিক বাঙলা বর্ষের কি মাস। আর এ চেনাটা আরো বেশি স্পষ্ট, আরো বেশি নিখুঁত যে ঋতুতে মনে হত তার নাম শরৎ। স্কুলবইতে পড়া ঋতুরাণী শরত, কতদিন স্কুল উঠোনে বসেই দেখেছি একটা সুনীল আকাশ নেমে আছে দূরের কোন গ্রামে। আর মেঘ শাদা পুষ্ট যেন তার ঝুলি থেকে শিমুল তুলো এই ছড়িয়ে যাবে কোন বৃক্ষের বনে। আর স্কুল ফেরার পথ গ্রামের প্রবেশপথে, কখনো নতুন উর্বর মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা কাশের সারি দুলে উঠতে দেখলে মন কেমনের হাওয়া বইতে শুরু করতো।
তখনও শরতের সাথে দুর্গাপুজোর উপলক্ষ্য আমাদের জানা নেই। এর কারণও স্পষ্ট। দেশভাগ কিংবা একাত্তর পরবর্তীতে দেশান্তরী হয়ে যাওয়া হিন্দু জনগোষ্ঠীর খুব একটা আর নেই গ্রামে। কিন্তু এইসব গ্রামে যে ভালোমতোই এদের বিস্তার ছিল, তার ছাপ পড়ে থাকে আমাদের শৈশব কৈশোরেও। গ্রামের ক্রমশ বিলুপ্ত হতে যাওয়া ঝোপঝাড়ে মাটির তৈজসপত্রের ভাঙ্গা টুকরো এমনভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বর্ষার শেষে, যেন বিলুপ্ত কোন নগর জেগে ওঠে। পরে মায়ের সাথে কৌতূহলে কথোপকথনে জেনে নিই, এখানে ছিল কুমোরপাড়া। এইসব আলাপনের রেশধরে আরো জানি, পাশেই কোন এক পরিত্যক্ত দালানটি কোন এক হিন্দু জমিদারের, কোন এক বিদীর্ণ উঠোনটি কোন এক ব্রাহ্মণের। এইসব মুখ কোনোদিন দেখা হয়নি, কিন্তু বুকের মাঝে একটা বেদনা বাজতে থাকে, যখন আপন মনে ভাবি, নিজের উঠোন, পরিচিতজন ছেঁড়ে যাওয়ার কথা। আজও।
ক্রমশ শূন্য হিন্দু জনসংখ্যার আমাদের গ্রামে আমি শৈশবে দুটি পরিবারই দেখেছি। একটি ননীস্যারের। যিনি আমাদের শৈশবে দেখা রবীন্দ্রদর্শন মুখ। আজ যখন ভাবি, অবিকল চেহারার লোকটিকে আবার দেখার ইচ্ছা জাগে। তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের এককালীন শিক্ষক, ন্যুব্জ শরীর নিয়ে তার স্কুল থেকে অবসরে যাওয়ার বহুবছর পরও মাঝেমধ্যে আসতেন বলে আমরাও উনার একটা দুটো ক্লাস পেয়েছি। উনি শখে কিংবা নিতান্তই অভ্যাসে এসব করতেন। ইংরেজিতে প্রখর মেধাবী ছিলেন, এটুকু স্মরণ করতে পারি। আর উনার বিচিত্র বিশ্বাসের কথা। উনি বহুদিন গোসল সারতেন না, কেন তার কারণ অজানা আমাদের। আর ব্রিজ কালভার্ট পেরিয়ে কোথাও যেতেন না। এই অভ্যাসগুলো কতদিনের তা নিয়ে ব্যাপক কৌতুহল দেখেছি মানুষের মাঝে। আর ছিলেন নিরীশ্বরবাদী। বিবাহবন্ধনে জড়াননি বলে তার শেষজীবনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন তার ভাগ্নে। তার মধ্যেও ধর্মাচার নিয়ে আগ্রহ দেখিনি। হয়তো বা এই ভিন ধর্মবিশ্বাসের মিছিলে নিজের সংখ্যালঘু অবস্থান নিয়ে সাহস ই পাননি। আজ এইসব মনে হয়। যতই পারস্পরিক বিশ্বাস আমরা দেখেছি, এর অন্তরালেও যে কিছু ছিল না তা কে বলতে পারে! আরেকটা পরিবার ছিল আমাদের গ্রামে, ধনার পরিবার। ধনঞ্জয় ভালো নাম। পেশায় মৎস্যজীবি। সারা গ্রামেই তার বন্ধু। এবাড়ি ওবাড়ি করে বেড়ান। তার কাছে ধর্মাচরণ মানে পুজো এলে দূরে কোন গ্রামে গিয়ে প্রণাম করে চলে আসা। ফলে শরতে পুজোর দিনক্ষণ নিয়ে কোন আবহ আমাদের শৈশবে নেই।
পুজো নিয়ে যা ছিল তা হলো কৌতুহল। যখন প্রাথমিক স্কুল পেরিয়ে হাইস্কুলে, তখন সেটা কয়েকটা গ্রামের পড়ুয়াদের স্কুল। ফলতঃ নতুন বন্ধু। এবং দু তিন গ্রাম দূরের এমন কেউ যাদের সাথে ধর্ম নিয়ে কোন আলাদা জানাশোনার ব্যাপার না এলেও দেখতাম শরতে একসময় তারা নতুন জামা নতুন জুতো নিয়ে উৎসাহী হতো। আমাদের যেমন ঈদ সামনে এলে হত, এরকম। এরপর ক্রমে জানা, কারো বাড়িতে পুজো হয়। পুজোতে বাদ্যি বাজে। তো আমাদের দেখা চাই। দেখার একটাই সুযোগ তখন, আরো যারা উৎসাহী সবাই মিলে দিনের কোন সময় খেলার মাঠে যাবার ছল করে দু তিন গ্রাম দূর চলে যাওয়া। মনে আছে, প্রতিবারই আমরা খুব কষ্টে দেবী দেখতাম। কারণ দিনে মণ্ডপগুলো প্রায়ই পর্দা ঘেরা থাকতো। লোকেরও তেমন আনাগোনা নেই। আমরা ভাবতাম অনেক লোক জড়ো হলে হয়তো পর্দা সরিয়ে নেবে, এই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকে বিকেল সন্ধ্যার দিকে এলে আমাদের ঘরে ফেরার পালা। এমনও হয়েছে মাত্রই ফিরে আসবো বলে হাঁটা শুরু করেছি আর বাদ্যি বাজছে, ফিরে গিয়েছি আবার, তখন ধূপগন্ধ পেরিয়ে বিশালাকার মূর্তিগুলো তাকিয়ে। আমাদের কৌতুহল দেবীর দশ হাত নিয়ে, পায়ের অগ্রভাগে সিংহ নিয়ে, কার্তিকের চুল নিয়ে। এই নামগুলো অবশ্য জানা অনেক পরে। আর সবচেয়ে বেশি কোলাহল যেটা নিয়ে ছিল, তার নাম পরে জেনেছি কলাবউ। তার মুখ তো ঢাকা থাকতো, তাই কৌতুহল ছিল সবচেয়ে বেশি। দেখতাম প্রসাদ বিলি হচ্ছে, অনেক শ্রদ্ধা ভরে সেসব নিচ্ছেন ভক্তরা। এর ভেতর স্কুলের কোন বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলে আমাদেরও জোর করে ধরিয়ে দেয়া হত শুকনো মিষ্টি, নাড়ু এসব। এসব নিয়ে কি করা যায়, খাওয়া যাবে কি না, খেলে কি পাপে জড়াব এসব কত ভাবনার উদ্রেক করেছে এবং শেষাবধি খাওয়াও হয়েছে। এভাবে আমরা পুজো দেখতাম। কখনো পাড়া থেকে পুজো দেখতে রাতে বেরোচ্ছে কোন দল জানলে আর বাড়ি থেকে অনুমতি মিললে রাতেও যেতাম, দেখতাম আগুন পাত্র দুহাতে নিয়ে অদ্ভুত খেলায় মেতেছে কেউ কেউ, এসবে মুগ্ধ হয়ে যেতাম।
পুজোকে নির্ঘণ্ট ধরে জানাটা শুরু স্কুলের শেষদিকে। যখন নবম-দশমের ছাত্র। লুকিয়ে পড়ার বইয়ের বাইরে বই পড়ার যে অভ্যেস গড়ে ওঠে তাতে ভাগ বসায় ম্যাগাজিন। ভারতে মুদ্রিত বেশকিছু ম্যাগাজিনের পুজো সংখ্যা তখন একটু দূরের শহরেও সহজে পাওয়া যায়। প্রথমে কৌতূহল পরে অভ্যাসের দিকে যে যাত্রা, আজও তো এসব কিনে যাচ্ছি। আর ছিল রেডিও। আমার গ্রাম যে ভারতের খুব কাছে তা পরে জানলেও কাছেই যে আগরতলা তা কিন্তু জানতাম। কোন এক রাত গভীরে টানা বাজি পোড়ানোর আওয়াজ যখন কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যেত তখন জানতাম আজ লক্ষ্মীপুজো আর এসব হচ্ছে আগরতলায়। আগরতলা তখন দূরগ্রাম, কিন্তু সেটাতে যে সীমান্তের ব্যাপার আছে কত পরে জেনেছি, ততদিনে কাঁটাতার দাঁড়িয়ে গেছে, আমরা সীমান্ত দেখতেও যাই, গিয়ে দেখি কালো সব কাঁটাতার, এর বেশি কিছু তো না। রেডিওতে আমাদের সবচেয়ে কাছের স্টেশনটি ছিল ত্রিপুরার, রেডিও ওলালা। এখন বোধহয় এর অস্তিত্ব নেই। থাকলেও বাংলাদেশ সীমান্তে ফ্রিকোয়েন্সিতে কোন রাখঢাক এসেছে। তখন ওলালায় হিন্দি গান বাজতো, বাংলাগান বাজতো, আর বাংলাদেশী গানও বাজতো। পড়ার টেবিলের পাশে থাকা সেই রেডিও শুনতে শুনতেই ঘোষণা পেতাম, মহালয়া আসন্ন। পুজো আসছে। মহালয়ার ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলে রেডিও টিউন করে ধারাবিবরণী শুনতাম, সকালে লোকে হাঁটছে, তর্পণ দিতে ছুটছে। এইসব।
কৈশোরে পেরোতেই অবশ্য পুজোকে দেখার জানার ব্যাপারগুলো সহজ হয়ে গিয়েছিল। শহরের দিকে দেখেছি একটি ছোট্ট পাড়ার ভেতর গোটা ত্রিশেক মণ্ডপ, আর গিজগিজ করা মুখ, সাউন্ডবক্স কাঁপিয়ে বাঙলা হিন্দি হিট সব গান। আলোর রোশনাই পথে পথে। কখনো মণ্ডপের পাশের পুকুরকেও সেজে উঠতে দেখেছি বিচিত্র রঙে। জেনেছি পুজো একান্তই নিজেদের উঠোনে করে কেউ, আবার সার্বজনীন পুজো কি। আর দেখেছি অনেক অনেক সংগঠন এবং তাদের ভেতরকার প্রতিযোগিতা। পুজোকে আরো বড় পরিসরে দেখেছি ঢাকায়, কনসার্ট হচ্ছে, আর চারদিকে খাবারের দোকান ঘেরা। উৎসব অনেকটা আনুষ্ঠানিক, অনেকটা বিজ্ঞাপনের। এবং এসব দেখতে দেখতেই মনে হয়েছে, পুজোর মেজাজ আসলে ছিল শৈশবের দুতিন গ্রাম দূরের মণ্ডপের ভেতর। চারদিকে মাটির ঘ্রাণ, ধূপ ধোঁয়া গন্ধ, আর কৌতূহলী মানুষের সব চোখ। পুজো দেখে আসা যাওয়ার পথ, জ্যোৎস্নারাত নেমে আসা, আর জামায় কাশবনের থেকে লেগে আসা কাশ। প্রতিবারই পুজো এলে এসব মনে হয়, মনে হয় কোথাও কোন সুদূরে সকালের ভেজা কুয়াশা পথ ধরে পালিত হচ্ছে মহালয়া, আর পুজোর ঘন্টি বেজে গেছে।