এখনো হয়ত শরতের কাশফুল আর পেঁজা মেঘ কংক্রিটের শহরে বুনোট বাঁধেনি পুরোপুরি, কিন্তু মাতৃবন্দনার হিড়িকে প্রাণ আকুলিবিকুলি! তবে পুজো শপিংকে টেক্কা দিয়ে এবার নোবেল কমিটিই পুজোর বাজিমাত করল ট্রিপল ধামাকায়। একই বছরে তিনজন নারীর পদার্থবিদ্যা, রসায়ন আর শান্তিতে একসাথে নোবেলে ভূষিত হওয়াটাই হয়ত এই বছরের পুজো বাম্পার! এঁদের মধ্যে প্রথমেই আসি ফিজিক্সে নোবেলজয়ী কানাডার ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটির ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের গল্পে। অর্ধশতকের পর তিনি তৃতীয় নারী হিসেবে এই মহান সম্মান অর্জন করেছেন অন্য দুজন পুরুষের সাথে, আমেরিকার আর্থার অ্যাশকিন ও ফ্রান্সের জেরার্ড মুরো। সাহিত্যে, শান্তিতে কিম্বা মেডিসিনে তাও খানিক নোবেল টোবেল পায় নারীজাতি। এই বছরেও যেমন ইরাকের ইয়াজিদি উপজাতি গোষ্ঠীর নাদিয়া মুরাদ ২০১৮ সালের নোবেল শান্তি পুরষ্কার ভাগ করে নিয়েছেন কঙ্গোর ডেনিস মুকওয়েগের সাথে । অথচ মেয়েটি নিজেই কিনা বারবার আইএস জঙ্গিদের হাতে ধর্ষিতা এবং নিগৃহীতা। অদম্য নাদিয়া ধর্ষণের বিরুদ্ধে, মেয়েদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়ে যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তার স্বীকৃতি এই নোবেল প্রাইজ! সে নাহয় হল। কিন্তু রসায়ন কিম্বা পদার্থবিদ্যার মত পুরুষশাসিত ক্ষেত্রে মেয়েদের জয় দেবীপক্ষের অন্যতম উপহার বললেও অত্যুক্তি হয়না বোধহয়। ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড আমাদের সেইদিকেই নজর ঘুরিয়ে দেয়। প্রায় তিনযুগের কাছাকাছি লেগে গেল ডোনার কাজকে স্বীকৃতি দিতে। যে লেজার সার্জারির কথা এখন আমরা আকছার শুনতে পাই তার কর্মপদ্ধতির পেছনে ডোনার পালস লেজার নিয়ে গবেষণার গুরুত্ব অনেক। কিন্তু স্রষ্টাকে কুর্নিশ জানাতে দ্বিধা হচ্ছিল এতদিন সে কি তিনি কেবল মেয়ে বলেই? উইকিপিডিয়ার মত বোদ্ধারা যাঁকে নিয়ে আর্টিকল লিখতে চাননি এতদিন নিজেদের ওয়েবসাইটে, তাঁর নাকি উইকিতে নাম তোলার মত কিছু অবদান নেই।
আরও পড়ুন, যৌনকলঙ্ক ঢাকতেই কি নাদিয়াকে নোবেল
আসলে নারীকে আমরা পেলব, মোলায়েম এসব ভাবতে ভালবাসি। অর্থনীতি, রসায়ন অথবা পদার্থবিদ্যার মত পুরুষকেন্দ্রিক বিষয়ে নারীর বেমক্কা যখন তখন আসাযাওয়াতে করা নজর রেখেছে সমাজ! তাই মারি কুরী ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি দুটিতেই নোবেল আদায় করেও অচলায়তন পুরোপুরি ভাঙ্গতে পারেননি। ডোনা তো তাও একটি পূর্ণ সময়ের সবেতন চাকরি জুটিয়ে নিতে পেরেছিলেন। আর এক ফিজিক্সে নোবেলজয়ী মারিয়া গেপার্ট মায়ারকে তো প্রায় বিনা বেতনে এবং অবহেলার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে।
মেয়েদের যোগ্য সম্মানপ্রদানে বিলম্ব ঘটাতে রসায়নের ক্ষেত্রেও জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু নারীশক্তি উত্থানের এই ঝোড়ো সময়ে দাঁড়িয়ে আর হয়ত ঠেকিয়ে রাখা গেলনা শেষমেষ। তাই রসায়নে পঞ্চম মহিলা নোবেলজয়ী হিসেবে পাওয়া গেল ক্যালটেকের লাইনাস পাউলিং প্রফেসর ফ্রান্সিস আর্নল্ডকে। পুরষ্কারের অর্ধেক পেয়েছেন তিনি একাই । বাকিটা শেয়ার করেছেন অন্য দুজন পুরুষ বিজ্ঞানী উইন্টার আর স্মিথ। ক্যালটেকের তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণার কাজে নিযুক্ত ফ্রান্সিসের গতিবিধি বেশ বিস্তৃত। নোবেল পুরষ্কারটি রসায়নে পেলেও আদতে তিনি কখনো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কখনো আবার এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তবে উতসেচকের বিবর্তন নিয়ে বায়োইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দুনিয়ায় সাড়া জাগানোর ফলেই এল চরম স্বীকৃতি। “ডিরেক্টেড ইভোলিউশনের” সাহায্যে ব্যাকটেরিয়ার জিনের তারতম্য ঘটিয়ে বিবর্তনের ধারাকে মাথায় রেখে তৈরি করেছেন নতুন উতসেচক যা কিনা বায়োফুয়েল কিম্বা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিকে পৌঁছে দেবে নতুন মোহনায়। ক্যালটেকের সমৃদ্ধ ইতিহাসে তিনিই প্রথম মহিলা নোবেলজয়ী। মনে করেন ক্যালটেকের শেষ মহিলা নোবেলপ্রাপক হবেন না তিনি। কেননা মেয়েদের প্রাপ্তির সুদিন আসছে আরও বেশি করে।
তবুও ভাল যে এই মেয়েরা দেরিতে হলেও পুরষ্কার অব্দি পৌঁছতে পেরেছেন। এই প্রসঙ্গে হাজারো বঞ্চনার ইতিহাস আছে। তারমধ্যে একটি যেমন মনে পড়ে লাজুক মেয়ে লিসা মাইটনারের কথা। তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে অটো হানের সাথে কাজ করা মেয়েটি। জার্মানী থেকে নির্বাসিতা ইহুদি লিসার পরামর্শ অনুযায়ী অটো ও তাঁর সহকর্মীরা ইউরেনিয়াম পরমাণুর সাথে নিউট্রন কণার কৃত্রিম সংঘর্ষ ঘটিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। তাঁর তীব্র অন্তর্দৃষ্টি এবং সঠিক ব্যাখ্যার হাত ধরেই নিউক্লিয়ার ফিশন জন্ম নেয় । ১৯৪৪ সালে সহকর্মী অটো হানকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। লিসা রয়ে যান আড়ালে। নির্বাসন এবং বার্লিনের গবেষণা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় লিসার প্রধান ভূমিকার কথা বুঝতে পারেননি নোবেল কমিটি এবং এটি নাকি নোবেল পুরষ্কারের ইতিহাসে “নোবেল মিসটেক”! আসলে ভুলচুকগুলো মেয়েদের পাওনার ক্ষেত্রে হয়েই যায়।
আরও পড়ুন, #MeToo: মুখ খুললেন মন্দাক্রান্তা সেন
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে “জেন্ডার বায়াস আর মাইনরিটি" নিয়ে কাজ করছেন জো হ্যান্ডেলসম্যান। সোসাইটি ফর নিউরোসায়েন্স কনফারেন্সে তিনি বলছিলেন আমেরিকার মত দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান অনুসারে ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী পুরুষরা মেয়েদের থেকে বেতন বেশি পায়। তিনি আর জানালেন ২০১২ সালে ছয়টি নামজাদা রিসার্চ ইউনিভার্সিটির ১২৭ জন বিজ্ঞানীকে নিয়ে সংঘটিত একটি অদ্ভুত পরীক্ষার কথা। সেইসব বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠানো হয় সমযোগ্যতার দুটি আবেদন, একটিতে জেনিফার এবং অন্যটিতে জন নাম লিখে। খুবই আশ্চর্যভাবে দেখা যায় সেই প্রফেসররা বেশিরভাগই সম্ভাব্য হিসেবে বাছাই করেছেন পুরুষ নামধারী আবেদনকারীকে। আর যদি মেয়েটিকে নেওয়া হয় তবে তার জন্য বরাদ্দ হচ্ছে কম বেতন।
অতএব সেইসব উপমা ভাবলে মনে কিছুটা সোয়াস্তি খুঁজে দিল এই বছরের শরতকাল। মেধা আর মননকে সঙ্গী করে কণ্টকের পথ পেরিয়ে যে অভিযান শুরু করেছে মেয়েরা তাকে ঠেকিয়ে রাখার উপায় আর নেই। হয়ত কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু দেবীর জাগরণ অনিবার্য। বৈষম্যের অসুর আর কল্কে পাবেনা এই কথাই যেন হলফ করে বলে গেল নোবেল কমিটির সিদ্ধান্ত ।