দুটি পৃথক বিষয় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার শিক্ষিত-সচেতন ‘নেটিজেন’-রা বিগত দু-তিনদিন যাবৎ বেজায় চিন্তিত। এক, ‘ইসরোর’-র অধিকর্তা কে শিবন তিরুমালা মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থানে, ধর্মগুরুদের দোরে মাথা ঠুকতে গিয়েছিলেন। দুই, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও একবার বিপুল জয় পেয়েছেন বামপন্থী ছাত্র-ছাত্রীরা, গেরুয়া শিবিরকে প্রায় মুছে ফেলে লাল আবীরে ছেয়ে গেছে জেএনইউএর চত্বর। অথচ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য পেশরত এসএফআই নেত্রী ঐশী ঘোষের ডানহাতে দেখা গেছে তাবিজ-তাগা বাঁধা। এহেন ঘোর ‘অযৌক্তিক’ সংস্কার আর বিশ্বাস দক্ষিণপন্থী দলের নেতা-বুদ্ধিজীবীদের খুবই মানায়। কিন্তু ‘ইসরো’-র শীর্ষবিজ্ঞানী অথবা জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির আগুনখোর বাম নেত্রীকে মানায় কি? কখনও না। এরপর হয়তো এই বিজ্ঞজনেরা ভারতের পশ্চাৎপদ ‘আধা-সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থা, জনগণের পিছিয়ে থাকা চেতনায় সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ ইত্যাদির দোহাই পেড়ে বলবেন একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে সবকিছু। কারণ, তাঁরা বলবেন, কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরেই বিজেপির ভাববাদী চৈতন্যের অবশেষ লুকিয়ে আছে। বিজ্ঞানচেতনার মর্মমূলে মিশে আছে ‘অ-যুক্তি’-র কু-প্রভাব। একে সমূলে উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত বিপ্লব অসম্ভব।
আচ্ছা, একটা ভোট নিলে হয় না? ইস্যু হবে, ভগবান আছেন না কি নেই? শুধু ভারতবর্ষ কেন? পুঁজিবাদের স্বর্গরাজ্যে ভোট নিলেও সেই ভোটে কারা জিতবে বলে মনে হয়? কোনও সন্দেহ নেই, এই ভোটে জিতবেন ‘ভগবান আছেন’—এই বিশ্বাসে অবলম্বী মানুষেরা। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট হলেও আমরা সেই ভোটের রেজাল্ট সর্বান্তঃকরণে মেনে নিতে প্রস্তুত থাকব তো? এই ভোটে কিন্তু কোনও ইভিএম কারচুপি হবে না, কোনও হার্মাদ বা ভৈরববাহিনীর ‘রিগিং’ হবে না। আসলে আমাদের তথাকথিত ‘যুক্তিবাদের’ বনিয়াদটাই দাঁড়িয়ে আছে হরেকরকম ‘অযুক্তি’-র টানাপোড়েনের সাপেক্ষে।
আরও পড়ুন, ওরা ক্ষমতা দেখাচ্ছে: রোমিলা থাপার
সেই লুকিয়ে-থাকা চোরাগোপ্তা ‘অযুক্তি’-কে না বুঝলে আমরা টেরই পাব না কীভাবে ‘সর্বহারার বৈজ্ঞানিক একনায়কতন্ত্র’ শেষ অব্দি একধরনের ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। বুঝতেই পারব না ‘মার্কসবাদ বিজ্ঞান কারণ তাহা সত্য’—এই গোদা মৌলবাদী বিশ্বাস আসলে কার্ল মার্কস-নামক ‘যৌক্তিক’ পীরবাবার চরণামৃত পানের মতোই অবাস্তব, যে অন্ধ বিশ্বাস থেকে মরিচঝাঁপি থেকে করন্দা-নানুর-নন্দীগ্রামের সপক্ষে লাগাতার গলাবাজি করে যাওয়া যায়। এটা বোঝাই যায় না যখন গোটা দেশের অর্থনীতি ধুঁকছে, মানুষের হাতের সঞ্চয় কমে আসছে, উৎপাদন শিল্পে ব্যাপক ছাঁটাই চলছে, পাবলিক সেক্টরের কর্মচারীদের জীবিকা বিপন্ন হচ্ছে, তখন কেন একটা দেশের জনতা মোদি-র মতো এক অলৌকিক পীরবাবার ৫৬ ইঞ্চি ছাতির গল্পকেই আবারও আঁকড়ে ধরে। কেন তারা ভেবে নেয় ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’-এর সঙ্গে আসলে ‘কমরেড লেনিন-স্তালিন আসলে যুক্তিবাদী বিপ্লবের পয়গম্বর’—এই বোকা, একবগ্গা ধারণার ভিতর আসলে কোনও মৌলিক ফারাক নেই।
এটা তো বিশ্ব-ইতিহাস থেকেই প্রমাণিত, যখনই কোনও দেশের অর্থনীতিতে মন্দা আসে, জনগণের চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে দিনকে দিন ফারাক বেড়েই চলে ক্রমাগত, তখনই শাসকবৃন্দ মহাকাশ অভিযানের শোর মচায়। সে ষাট-সত্তরের দশকের ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভের থমকে-যাওয়া সোভিয়েত অর্থনীতিই হোক অথবা শান্তিপূর্ণ অস্ত্র আর প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় মেতে-থাকা আমেরিকান প্রেসিডেন্টই হোন, আসল গল্পটা একই। সেই একই খেলা নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহও খেলবেন আর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বুঢ়বক জনগণ সেই উগ্র দেশপ্রেমের আফিম গিলবে।
যুক্তির স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একদিন প্রতিশোধ হয়ে ফিরে আসবে কে শিবনের মতো একদা হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে-আসা মানুষের দেশের অন্যতম সেরা বিজ্ঞান-প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে বসেও তিরুমালায় পুজো দিতে যাবার মতো ঘটনার পিছনে কোনও ব্যক্তিগত অথবা সমষ্টিগত অসহায়তার কাহিনি। বহু বাম-লিবারাল লাগাতার বলেই চলেছেন, তাঁরা চন্দ্রযানের চাঁদের মাটি স্পর্শের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। তাঁরা কিন্তু এই মিশনকে বিজ্ঞানের জয় বলেই ভেবে নিয়েছেন। ভাবেননি যে এই বিজ্ঞানের জয় আদপে রাজনীতিকদের হাতে জাতীয়তাবাদের জয় হিসেবেই প্রোজেক্টেড হবে। ঠিক যেরকম ইউরি গ্যাগারিনের মহাকাশ-বিজয় একদা সমাজতন্ত্রের নৈতিক জয় হিসেবে মান্যতা পেয়েছিল। ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা-র মহাকাশ-যাত্রা সেদিন যুগপৎ সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ-বিরোধিতা আর সমাজতন্ত্রই নারীমুক্তির হাতিয়ার—এই একপেশে হাস্যকর ন্যারেটিভ দ্বারাই পুষ্ট হয়েছিল। ঠিক যেভাবে চাঁদের মাটিতে নিল আর্মস্ট্রং-এর পা রাখাকে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদের ‘স্বাভাবিক বিজয়’ হিসেবে দেখিয়েছিল মার্কিন শাসকেরা।
আরও পড়ুন, আসামের মিঞা কবিতার ইতিহাস, ভূগোল ও দেশপ্রেম
অজস্র ‘অযুক্তি’ আসলে ঘিরে রাখে আমাদের দৈনন্দিন বেঁচে-থাকাকে। আমাদের প্রাত্যহিক বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ভিতর যে প্রতিনিয়ত কতোরকম চোরাগোপ্তা হাসি-রাগ-অভিমান-ঘেন্না-আপসের বাণী লুকিয়ে থাকে তার হদিশ আমরা নিজেরাই জানি না। আমরা একমাত্রিক, সরল আশাবাদী যুক্তির ছকে বিশ্বাস করতে ভালোবাসি। ‘জাতীয় শিক্ষা আয়োগের’ নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকার হরণ করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার—এই ভাবনার সময় ভুলে যাই ৩৪ বছর ধরে এই বাম-বাংলায় গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হত আলিমুদ্দিন নামক অচলায়তনের অঙ্গুলিনির্দেশেই। পৃথিবীর কোন্ শাসক আছে যে শিক্ষা নামক সবচেয়ে জরুরি বিষয়টাকে কুক্ষিগত করতে চায়নি? পুঁজির ধর্মই তো এই যেকোনও জনস্বার্থকে নিজের অধিকারে নিয়ে আসা। এই একদা বাম-বাংলার শাসকরাও যে শেষদিকে পুঁজি-বান্ধব হয়ে উঠেছিল, ক্ষমতায় আবার কোনওদিন ফিরলে যে তারা ফের নির্জলা পুঁজিবাদী শোষণকেই যৌক্তিক উপায়ে কোরামিন জোগাবে—এই সরল সত্য ভুলে যাওয়া হবে মূর্খামি ‘বিক্রম’-এর সিকি-সাফল্য আসলে আমাদের অন্তর্গত অযুক্তির সীমারেখাকেই বারবার উন্মুক্ত করে—এই কথা ভুলে যাওয়া অন্যায়।
(অর্ণব সাহা জয়পুরিয়া কলেজের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)