Advertisment

শিক্ষামন্ত্রীর আহ্বান, আমাদের কথা

নানাবিধ আয়োজন সত্ত্বেও যখন তৃতীয় শ্রেণির ৮২ শতাংশ ছাত্র বিয়োগ করতে পারে না বা পঞ্চম শ্রেণির ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা পাঠ্য পুস্তক পড়তে পারেনা তখন বোঝা যায় শিক্ষার এই অসুখের শিকড় অনেক গভীরে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ফাইল

কিছুদিন আগে সোশাল মিডিয়ায় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী একটি আহ্বান রেখেছেন। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের কাছে তাঁর আহ্বান, শিক্ষায় উৎকর্ষ সম্পর্কিত প্রস্তাব দেওয়ার। সে আহ্বান মাথায় রেখেই এই আলোচনার অবতারণা।

Advertisment

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার মানের উৎকর্ষ সাধন যে ভীষণ জরুরি তা নিয়ে বোধহয় কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। বিগত ২০বছরের অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অব এডুকেশনের রিপোর্টে চোখ বোলালেই একথা দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে শিক্ষার মানের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ নেহাৎই এক পিছিয়ে পড়া রাজ্য। অথচ মান ফেরাতে সরকার যে উদ্যোগী নয় এমনটা বলা যাবেনা। শিক্ষার পরিকাঠামো আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি উন্নত। শিক্ষাখাতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ব্যয় বরাদ্দ আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা বেড়েছে। প্রায় প্রত্যেক সরকার-পোষিত স্কুলে পানীয় জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা হয়েছে, মিড্ ডে মিলের কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, ড্রপ আউট কমেছে। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই, স্কুলব্যাগ, দশম শ্রেণিতে টেস্ট পেপার, বিনামূল্যে স্কুল ইউনিফর্ম, সাইকেল, কন্যাশ্রী প্রকল্প -এক কথায় বিদ্যালয়ে সরকারি ইনপুট অনেক বেশি, এতে শিক্ষার্থীরা লাভবান হচ্ছে, অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা কমছে। এছাড়া শিক্ষার অধিকার আইন অনুসারে শিক্ষার্থী যাতে তার বাসস্থানের নিকটবর্তী বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় তার জন্য বিদ্যালয়গুলিতে 'No Refusal পলিসি চালু হয়েছে। সারাদেশের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শুধুমাত্র দশম শ্রেণির পাঠক্রমের উপর মাধ্যমিক এবং দ্বাদশ শ্রেণির পাঠক্রমের উপর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে। ফলে একথা অনস্বীকার্য যে শিক্ষার্থীদের পড়ার চাপ বিগত সময়ের তুলনায় কমেছে।

এই নানাবিধ আয়োজন সত্ত্বেও যখন তৃতীয় শ্রেণির ৮২ শতাংশ ছাত্র বিয়োগ করতে পারে না  বা পঞ্চম শ্রেণির ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা পাঠ্য পুস্তক পড়তে পারেনা তখন বোঝা যায় শিক্ষার এই অসুখের শিকড় অনেক গভীরে। প্রয়োজন হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক অনুসন্ধানের।

পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আদ্যন্ত রঙিন, আকর্ষণীয় ও উন্নতমানের ছাপা বইগুলি শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বিতরণ একটি উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত। এক কথায় বলতে গেলে এই বইগুলির সাহায্যে পাঠক্রম ও পাঠদানকে প্রচলিত শ্রেণিকক্ষ নির্ভর শিক্ষা থেকে 'কৃত্যালী নির্ভর শিক্ষণ' (Activity based learning) এ রূপান্তরিত করার সচেতন প্রয়াস আছে। এতদিন পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষ নির্ভর পাঠদানে শিক্ষকরা মূলত 'লেকচার মেথড'(বক্তৃতা পদ্ধতি)-এর ব্যবহার করতেন। নতুন বইগুলিতে দেওয়া পাঠতথ্য অনুযায়ী দক্ষতা অর্জন করতে গেলে মাননীয় শিক্ষক মশাইদের 'Facilitator'-এর ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রথমত এই ধরণের কৃত্যালি নির্ভর শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে সফল করতে হলে প্রথমেই শ্রেণিকক্ষ নির্ভর প্রথাগত পাঠদানের পদ্ধতি থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই মুক্ত হতে হবে। সিলেবাস প্রণেতারা আলোচনা, বিতর্ক, দলগত কাজ, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, ছোট ছোট পরীক্ষা নিরীক্ষা, শিক্ষণ সহায়ক (Teaching Aids) ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু কীভাবে এগুলি প্রযুক্ত হবে সে সম্পর্কে কোন সামগ্রিক পরিকল্পনা না থাকার ফলে শিক্ষণ পরামর্শ বইয়ের পাতাতেই আটকে থাকছে, বাস্তবে তার প্রয়োগ ঘটছে না। দ্বিতীয়ত, এই নতুন ধারার পাঠক্রমের বাস্তবে রূপদান করার জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, যার আনুষ্ঠানিক নাম 'In Service Training'। অতীতের মত বর্তমানেও (নতুন পাঠক্রম সংক্রান্ত ) দেখা গেল এই ধরণের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলি হয়ে উঠলো যন্ত্রণাদায়ক, যান্ত্রিক, প্রথাবদ্ধ অভ্যাস। Activity based learning এর প্রশিক্ষণ শিবির শুধু একগুচ্ছ বক্তৃতাবাজি, শেষে চিরাচরিত প্রতিবেদন পাঠ ও প্রশ্নপত্র প্রস্তুতি। প্রশিক্ষক ও শিক্ষক কোন রকমে ওয়ার্কশপের কাজ সাঙ্গ করে টিফিনের প্যাকেট সংগ্রহ করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিচ্ছেন - এ এক পরিচিত দৃশ্য। তৃতীয়ত ,এই ধরনের সমন্বিত পাঠক্রমকে সফল করতে হলে নিদেন পক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত হওয়া উচিত ১:৪০। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো কোন কোন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপচে পড়ছে, কোথাও আবার শিক্ষার্থীর অভাবে স্কুল উঠে যাবার জোগাড়। এটা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সরকারি পরিকল্পনার বড়ই অভাব। চতুর্থত, শিক্ষণ সহায়ক বলতে বিদ্যালয়গুলিতে এখনও পর্যন্ত চক, ডাস্টার, মানচিত্র, গ্লোব ও জীববিদ্যার চার্টের বাইরে কোন কিছুকে ভাবা হয়না। যেমন সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইটি পুরোপুরি পরীক্ষা ও কৃত্যালি নির্ভর। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কোন বিদ্যালয়ে পরীক্ষাগার না থাকার কারণে ছাত্রদের বিজ্ঞান শেখা মুখে মুখে হচ্ছে। অথচ একটা থার্মোমিটার বা চুম্বকের পরীক্ষা এই পরিকাঠামোর মধ্যেও অসম্ভব নয়। শিক্ষকদের মাইনে বা ব্যক্তিগত তথ্যকে পঞ্জিগত করার ক্ষেত্রে কম্পিউটার ও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ হচ্ছে কিন্তু Computer Aided Learning(CAL) প্রয়োগের ব্যাপারে আমরা আলোকবর্ষ দূরে।

এর ফল হচ্ছে মারাত্মক। সিলেবাস প্রণেতারা একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন যে এখনও পশ্চিমবঙ্গে ৯৫শতাংশ শিক্ষায়তনের শ্রেণিকক্ষগুলিতে সেই একইরকম বস্তাপচা ,বিরক্তিকর ও একঘেয়ে বক্তৃতাদানের মাধ্যমে পঠন পাঠন হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আগেও কিছু শিখত না, এখনও কিছু শিখছে না। এই সুযোগে ঠিক আগের মত এখনও নোটবুক বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সরকারি বই বিনামূল্যে সংগ্রহ করার পর বই এর দোকানে বড় প্রকাশনীর নোট বই কেনার জন্য লম্বা লাইন। ক্লাসে পাঠদানের সীমাবদ্ধতা ও এই ব্যর্থ পরিণতি শিক্ষার্থীদের বাধ্য করছে পয়সা খরচ করে প্রাইভেট টিউশনির দিকে ছুটতে। কিন্তু প্রাইভেট কোচিং-এর উপর এই অত্যাধিক নির্ভরতা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে যে কোন গুণগত পরিবর্তন আনতে পারছে না তা সরকারি রিপোর্টগুলিতে স্পষ্ট।

এই প্রেক্ষাপটে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রশ্নটিকেও আলোচনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কীভাবে সরকারি পলিসিকে 'অন্তর্ঘাত' করা যায় তার আদর্শ উদাহরণ হতে পারে প্যারাটিচারদের প্রসঙ্গটি। সর্বশিক্ষা মিশনের আর্থিক সাহায্যে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরে প্যারাটিচারদের নিয়োগ করা হয়েছিলো পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের চিহ্নিত করে তাদের পৃথক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মান উন্নত করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে ঘটলো ঠিক উল্টো। বিদ্যালয়গুলি শিক্ষকের সংখ্যা কম, পরিকাঠামো নেই এরকম হাজারো অজুহাত দেখিয়ে প্যারাটিচারদের মূল রুটিনের অন্তর্ভুক্ত করা হল। স্থায়ী শিক্ষকরা ক্লাস কমার কারণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। প্যারাটিচাররা অখুশি হলেন না, কারণ স্থানীয় ভিত্তিতে নিযুক্ত হওয়া প্যারাটিচাররা মূল রুটিনের অন্তর্ভুক্ত হতে পারলে বা স্থায়ী শিক্ষকদের মত কাজ করতে পারলে তাঁদের কোন ক্ষতি হয় না  বরং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যাদের জন্য এই উদ্যোগ সেই পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা সেই একই তিমিরে থেকে যায়।

সাবেকি পরীক্ষা ভিত্তিক ব্যবস্থার বদলে শিক্ষাবিজ্ঞানের আলোকে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে নিরবচ্ছিন্ন সার্বিক মূল্যায়ন (CCE) তুলনামূলক বিচারে ভালো পদ্ধতি। এই প্রক্রিয়ার অপরিহার্য অংশ হল Formative Assessment। কথা হয়েছিল শ্রেণি শিক্ষক এবং বিষয় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করবেন, তাদের শিক্ষণ ক্ষমতাকে রেকর্ড করবেন, তাদের অগ্রগতি বা পিছিয়ে পরাকে সম্যকভাবে বিশ্লেষণ করবেন এবং যাবতীয় তথ্য Formative Assessment Diary তে নথিভুক্ত করবেন। পাঁচটি মানদণ্ডে এই মূল্যায়ন হবে। কিন্তু রাজ্যের বিদ্যালয়গুলিতে একটু কান পাতলেই শোনা যাবে কী ভাবে ফরম্যাটিভ অ্যাসেসমেন্ট অকার্যকর হয়ে পড়েছে। গত এক বছরে কতজন শিক্ষক ফরম্যাটিভ অ্যাসেসমেন্ট ডায়েরি ব্যবহার করেছেন বা কটি স্কুলের সব শিক্ষক শিক্ষিকাদের এই ডায়েরি দেওয়া হয়েছে তার পরিসংখ্যান নেওয়া জরুরি। কার্যত মূল্যায়ন পদ্ধতি সেই তিনটি পরীক্ষায় ফিরে গেছে যা শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। ফরম্যাটিভ ও সামেটিভ মূল্যায়নের বদলে এক 'হাঁসজারু'ব্যবস্থা চালু হয়েছে। শিক্ষার্থী কী শিখছে, তার জন্য প্রদত্ত মূল্যায়ন পদ্ধতির বিকৃত ও অসম্পূর্ণ প্রয়োগ মার্কশিটকে ক-খ-গ  শ্রেণীবিভাগে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। ফলে আগের মতোই, নতুন পদ্ধতিতেও একটা বড় অংশের শিক্ষার্থী প্রায় কিছু না শিখেই পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হচ্ছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ যথেষ্ট না হলেও আগের তুলনায় বেশি একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাব উৎকর্ষের আকাঙ্ক্ষাকে দূরবর্তী করে তোলে। বহুদিন আগে সারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ম্যান উন্নয়নের জন্য গঠিত যশপাল কমিটি বলেছিলো 'আমাদের শিক্ষার বেশিরভাগ ব্যাবস্থাই মানব মনের নতুন জ্ঞান নির্মাণ ও সৃষ্টির ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিক্ষার্থী যে তথ্য ও সূত্র ভরে দেবার একটা থলি নয়, শিক্ষা মানে যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর এক চলমান কথপোকথন, এক সম্মিলিত সক্রিয়তা --এই উপলব্ধিকে বইয়ের পাতার বাইরে আনার ব্যবস্থা না থাকার ফলে শেখার জগতে মস্ত ফাঁকি থেকে গেল।

(সুমন কল্যাণ মৌলিক ও মিঠু বণিক গৌরান্দি পশ্চিম বর্ধমানের একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক)

Education
Advertisment