শ্যামলী ঘোষ। বয়স ৭৫। যোধপুর পার্কে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে খুন হয়েছেন তিনি। একাই থাকতেন। অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এ ঘটনা নতুন কিছু অবশ্য নয়। এর আগেও এ শহরে বা দেশের অন্য কোথাও প্রবীণ মানুষদের এভাবে খুন হওয়ার ঘটনা খবরের শিরোনামে এসেছে। তাঁরা যে কতখানি অসহায় এবং নিরাপত্তাবিহীন অবস্থায় বেঁচে আছেন, সেটা এই ঘটনাগুলির পুনরাবৃত্তি সে কথাই প্রমাণ করে।
শ্যামলী দেবীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর বাড়িতে হত্যাকারীর জোর করে প্রবেশের কোনও চিহ্ন মেলেনি। অর্থাৎ হত্যাকারী শ্যামলী দেবীর পূর্ব পরিচিত। কোনও মূল্যবান জিনিস খোয়া যায়নি। অর্থাৎ চুরির উদ্দেশ্যে এই খুন নয়। তাহলে কি আক্রোশের বশে? নিছক প্রতিশোধস্পৃহায় এত বড় কাণ্ড? পুলিশের এখনও পর্যন্ত তেমনই সন্দেহ।
আরও পড়ুন, স্বাস্থ্য ভিক্ষা নয়, অধিকার
এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা কী? অপরাধী ধরা পড়ল কি না, কে অপরাধী, এসব আমাদের বিস্তারে আলোচনার বিষয় নয়। যেটা ভাবার সেটা হলো, কোন প্রেক্ষিতে ঘটনাগুলি ঘটছে? যেটা লক্ষ্য করা যায়, যাঁরা এই ধরণের অপরাধের শিকার হচ্ছেন, তাঁরা সকলেই মোটামুটি বয়সে প্রবীণ। একা থাকেন। স্বচ্ছল।পরিচারক বা চেনা পরিচিত মানুষের ওপর নির্ভরশীল।বসবাস মূলত ফ্ল্যাটবাড়ি বা কিছুটা এমন অঞ্চলে, যেখানে সামাজিক ভাবে মেলামেশা কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজকর্মের জন্য ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে একা রেখে বাইরে থাকতে বাধ্য হয়। নিঃসন্তান বা অবিবাহিতদের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি হতে পারে।
যখন এই জাতীয় হত্যার ঘটনা ঘটে , তখন প্রথমেই আমরা যেটা করি, ছেলেমেয়েদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। তারা বাবা-মায়ের কাছে থাকে না বা তাঁদের কাছে রাখে না---এই ধরণের অনুযোগ, অভিযোগ উঠে আসে আলোচনায়। অথচ বাস্তব কারণেই কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। নিজের শহরে বা রাজ্যে কাজের সুযোগ কত শতাংশ ছেলেমেয়ে পায়, ভেবে দেখা দরকার। না পেলে, বাধ্য হয়েই ভিন রাজ্যে বা ভিন দেশে গমন। একান্ত বাধ্য হয়েই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
আরও পড়ুন, অর্থনীতির স্বাস্থ্য: স্বাস্থ্যের অর্থনীতি
একটু স্বচ্ছল জীবনযাপনের স্বপ্ন সকলেই দেখেন। বলা ভালো, বাবা-মায়েরাই স্বপ্নটা দেখেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের ঘিরে। প্রথমে উচ্চশিক্ষা, তারপর যোগ্য জায়গায় তাদের প্রতিষ্ঠা। এই প্রতিষ্ঠা ব্যাপারটা প্রায়ই প্রত্যাশামাফিক হয় না। মানে নিজের শহরেই হবে, তার গ্যারান্টি নেই। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় বাড়ির বাইরে , চেনা বৃত্ত ছেড়ে দূরে যাওয়াটা অবধারিত হয়ে পড়ে। এরপর জীবনের ছন্দটাই যায় বদলে। নিজেদের চাকরি, সংসার, বাচ্চাদের পড়াশোনা। দিন যায়। ব্যস্ততা বাড়ে। আসা-যাওয়া কমে। যাতায়াতের ক্ষেত্রে অনেক সময় ভৌগোলিক দূরত্বও অন্তরায় হয়। এই সূত্রেই ক্রমশ বাবা-মায়েরা একাকী, নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। প্রথমে আকুল হলেও, ধীরে ধীরে মানিয়ে নেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক সক্ষমতা কমে। তখন ভরসা গৃহ পরিচারক বা পাড়ার চেনা কেউ, অথবা কাছে-দূরের কোনও আত্মীয়।
আক্ষেপ ও দুর্ভাগ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ভরসার জায়গাটা দিয়েই প্রবেশ করে অপরাধের কালনাগিনী। শ্যামলী দেবীর ফ্ল্যাটে খুনি জোর করে ঢোকেনি। অর্থাৎ উনি নিজেই দরজা খুলে দিয়েছেন। ওঁর ভাবনার আশেপাশে কোথাও ন্যূনতম অবিশ্বাসের কালো মেঘ ছিল না। নিবিড় বিশ্বাস, ভরসা, নির্ভরতা নিয়ে উনি পা বাড়িয়েছিলেন মৃত্যুর গহ্বরে, যা রচনা করে তাঁরই অতি চেনা কেউ। ঘটনার সব থেকে ভয়াবহ দিক তো এটাই। এ তো শুধু এক অপরাধ নয়, এ যে চূড়ান্ত সামাজিক অবক্ষয়। বিশ্বাসভঙ্গ কতদূর পর্যন্ত, শুধু চুরি-ডাকাতি নয়, প্রাণহরণের মতো গুরুতর অপরাধ! আমরা কথায় কথায় বলি, দিনকাল খারাপ। আজকাল কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। বলেও বিশ্বাস করি, ভরসা করি। না করে উপায় থাকে না যে! বিশেষত প্রবীণদের ক্ষেত্রে তো আরওই। বলা বাহুল্য তাঁদের এই নিরুপায় অবস্থাই অনেক সময় আস্থাভাজন লোকটির মনে অপরাধের বীজ বপন করে। এক্ষেত্রে টাকাপয়সার লোভ অপরাধের উৎস হতে পারে। কিন্তু যেখানে বিষয়টা অর্থ বা মূল্যবান উপকরণ সংক্রান্ত নয়। যেমন শ্যামলী দেবীর ক্ষেত্রে ঘটেছে ! প্রবল আক্রোশ অস্ত্র হয়ে নেমে এসেছে। সেখানে সামাজিক অবক্ষয় শুধু নয়, কিছু মনস্তাত্ত্বিকঅভিমুখ খোঁজাও জরুরি।
আরও পড়ুন, বাঙালিকে কি তৃণমূল বা বিজেপি হতেই হবে?
খবর ঘাঁটলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনও পরিচিত ব্যক্তি নিজেই এই অপরাধগুলি সংগঠিত করছে। আর অচেনা অপরাধীর ক্ষেত্রেও আড়ালে থাকছে কোনও চেনা মুখ। তারা যে যে কারণে একজন প্রবীণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে, অর্থলোভ তার একটা বড় কারণ নিঃসন্দেহে। এই কারণটা বরং কিছুটা সরল। না পাওয়া জিনিসগুলো খুব দ্রুত ও সহজে পাওয়ার জন্য হাতের কাছের অসহায় মানুষটির পিঠে ছুরি বসানো তো সবথেকে সহজ। কিন্তু যখন অর্থ নয়, অনর্থের মূলে থাকছে পুষে রাখা রাগ বা প্রতিহিংসা? তখন?
এক্ষেত্রে যিনি শিকার, তাঁরও কিছুটা ভূমিকা থেকে যায়। কোন বিন্দু থেকে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্কে তিক্ততা ছায়া ফেলতে থাকে, সেটা বোঝা জরুরি। বিশ্বাস ভালো। অন্ধ বিশ্বাস কখনই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। সামনের মানুষটির ব্যবহারের মধ্যে কোনও পরিবর্তন, অস্বাভাবিকতা আছে কিনা, বোঝা দরকার। খুনের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ যদি হঠাৎ রাগের বসেও সংগঠিত হয়, তবে, তারও একটা প্রস্তাবনা থাকে। আসলে হঠাৎ করে কিছুই হয় না। লোভ, ঈর্ষা, রাগ, প্রতিহিংসা জমতে জমতেই খুলে যায় অপরাধী মনের দরজা।
আরও পড়ুন, এক দেশ এক নেতা এক আদর্শ এক ধর্ম এক শ্লোগান: এই কি ভবিতব্য?
সামাজিক অবক্ষয়ের আর একটি দিক হচ্ছে একে অপরের প্রতি চরম উদাসীন হয়ে পড়া। ফ্ল্যাট বাড়ি হোক বা পাড়া , পাশের বাড়ির মানুষটি কেমন আছে, সেটার খোঁজ নেওয়া তার ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি মারা নয়। অন্তত যে প্রবীণ মানুষটি একা থাকেন, তাঁর ক্ষেত্রে আর একটু সংবেদনশীল কি আমরা হতে পারি না ? একটু খবরাখবর নিলে যে লোকটি একটি অপরাধের পরিকল্পনা করছে, সেও তো দুবার ভাববে। মানে, তার কাছে তো বিষয়টা ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো সহজ হবে না। এই আদানপ্রদানের পরম্পরা আমাদের সমাজজীবনের ভিত্তি ছিল একদা। হারিয়ে যাওয়া সেই সম্পর্কের অনুরণন ফিরিয়ে আনা দরকার। দরকার আমাদের সকলের জন্যই।
এ তো গেল সামাজিক মূল্যবোধ বা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কথা। এর প্রশাসনিক দিকটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাচ্ছে কি ? আইনকানুন আরও শক্ত করা যায় না কি ? অপরাধ ঘটে যাওয়ার পর অনেক সময় প্রশাসনিক গাফিলতির জন্যই অপরাধী পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। আইনের এই শিথিলতা এই ধরণের অপরাধ বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ, এতে কোনও সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন, সন্তোষ রাণা: সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক সমাজবিপ্লবী
সবশেষে ছেলেমেয়েদেরও বাবা-মায়ের জন্য কিছুটা সময় বের করতে হবে। যাঁরা নিঃসন্তান বা অবিবাহিত, দেখার কেউ নেই, তাঁদের জন্য এগিয়ে আসতে হবে আত্মীয় বা পাড়া-প্রতিবেশীকে। আজ পরিস্থিতির কারণেই হয়তো ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে দূরে রাখতে বা তাঁদের থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এই দূরত্ব ভৌগোলিক হতেই পারে। কিন্তু সেটা মনের মাধুরী দিয়ে অতিক্রম করা নিশ্চয়ই সম্ভব। আপনজন দূরে থেকেও কাছে থাকলে ভুল মানুষকে আপন ভাবার ভুলটা কম হবে। এ যে এমন ভুল, যেখানে প্রাণ বাজি রেখে সর্বস্ব খোয়াতে হচ্ছে। সার্বিকভাবে একে ঠেকাবার চেষ্টা না করলে এর পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলবে।