১৯৭৫-এর ২৫-২৬ জুনের মধ্যরাত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি করলেন। ২৫ তারিখ দুপুরে রামলীলা ময়দানে জয়প্রকাশ নারায়ণ বিপুল সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ভ্যানে ওঠার সময়ে তিনি বলেছিলেন, বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি। সমস্ত বিরোধী নেতৃত্বকে বন্দি করে রাখা হয় সে সময়ে। পরে জগজীবন রাম, হেমবতী বহুগুণা, চন্দ্রশেখর বন্দি হন। সেসময়ে বিজেপির পূর্বসূরী জনসংঘের অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি, দেওরস, সুব্রহ্মণ্যন স্বামী, অরুণ জেটলি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও গ্রেফতার হন।
আরও পড়ুন, জুন: মানবাধিকারের পক্ষে ভয়াবহ এক মাস
সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। সুপ্রিম কোর্টও সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে জানাল, জরুরি অবস্থার সময়ে নাগরিকদের কোনও অধিকার থাকে না। যদিও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পরিষ্কারভাবে বলে, বিশেষ সংঘর্ষের পরিস্থিতিতে, বা জরুরি পরিস্থিতিতেও নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না।
সঞ্জয় গান্ধীর তাণ্ডব- তুর্কমান গেটে বুলডোজার চালিয়ে গরিব মানুষের বাসস্থান উচ্ছেদ, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে জেলে পুরে দেওয়া, বলপূর্বক নাসবন্দি - আজও জাতীয় ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা- তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বরুয়ার এই বক্তব্য আজও স্বৈরাচারী শাসনের দ্যোতক হিসেবে চিহ্নিত।
জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপটটা আমাদের জানা। এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে ইন্দিরা গান্ধীকে পরে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে সাংসদ পদ খোয়াতে হয়েছিল। সিংহাসন রাখার তাগিদে, সিদ্ধার্থ রায়ের পরামর্শে তিনি জরুরি অবস্থা জারি করেন। সেই দুই বছরের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার নানা টুকরো টুকরো স্মৃতি শাহ কমিশনের কাছে নথিভুক্ত করা হয়েছিল। জয়প্রকাশ নারায়ণ, আদবানি সহ অনেকের কারাস্মৃতিতে, চন্দ্রশেখরের উপর লিখিত জীবনীতেও এই সমস্ত ভয়ানক অভিজ্ঞতা আলোচিত। কবি নাগার্জুন তীব্র ব্যঙ্গ করে ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, "ইন্দুজী, ইন্দুজী কেয়া হুয়া আপকো, সত্তা কি রাস্তে মে ভুল গয়ি বাপকো!"
পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর) নিষিদ্ধ হয়েছিল। তাদের প্রকাশনাও নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়।
আরও পড়ুন, চিকিৎসক আন্দোলন: বিনায়ক সেনের কী বক্তব্য?
এরপর মানুষের নিঃশব্দ লড়ইয়ে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার সম্ভব হল। ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে সর্বস্তরের দল, ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজের সবাই একজোটে পরাস্ত করে এশিয়ার মুক্তি সূর্য ইন্দিরা গান্ধীকে। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত স্বমহিমায় ফিরে আসে। সংবিধান সংশোধন করা হয় যাতে কোনও ফ্যাসিবাদী শক্তি নিজের ইচ্ছামত জরুরি অবস্থা জারি না-করতে পারে।
পরবর্তীকালে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলির আনা অভিযোগ খণ্ডন করার চেষ্টা করেন তাঁর 'দ্য ড্রামাটিক ইয়ার্স, ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স' বইটিতে। জরুরি অবস্থার শিকার জনক রাজ শ্রী মুখোপাধ্যায়ের যুক্তি ও তথ্য খণ্ডন করে দেখান শ্রী মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা নানা দিক থেকে ত্রুটিযুক্ত ও তথ্য চেপে যাওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস।
ইদানিং দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল ও তাদের মেরুদণ্ড সংঘ পরিবার জরুরি অবস্থার বিষয়টিকে আত্মসাৎ করতে চাইছে। নিজেদেরই একমাত্র ও প্রধান হিসেবে প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত। ইতিহাস বলছে, জরুরি অবস্থাতেই সংঘ নিষিদ্ধ হয় ও নেতৃবৃন্দ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তারপর! তথ্য বলছে, শীর্ষ নেতৃত্ব ইন্দিরা গান্ধীর কাছে চিঠি দিয়ে সৎ ব্যবহারের মুচলেকা দিয়ে ও ভবিষ্যতে রাজনীতির সংশ্রব থেকে দূরে থাকবে বলেই জানিয়েছিল, যা ইন্দিরা গান্ধী প্রত্যাখ্যান করেন।
আরও পড়ুন, মুজফফরপুরের মহামারীর রাজনীতি
আজ এরাই ক্ষমতায় থাকার সুযোগে অত্যাচারের শিকার তাঁরাই এ দাবি করে আসে। কিন্তু এ কথা এড়িয়ে গেলে চলবে না যে ২০১৪ সালের পর থেকে ভারত বা নতুন ভারত গড়ার নামে এমন কিছু ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে যা জরুরি অবস্থার সময়েও ঘটেনি। দলিতদের উপর আক্রমণ ও তাদের হত্যা, জনসমক্ষে তিলে তিলে গোমাংসভক্ষণকারী বা গোহত্যাকারী বলে অথবা চোর সন্দেহে গণপিটুনি, দেশভক্তির নতুন মানদণ্ড- বন্দে মাতরম বা জয় শ্রীরাম জোর করে বলানো - কো বিদেশি ঠিক করে নাগরিকদের উপর আক্রমণ এরমক ঘটনা ঘটেই চলেছে। শুধু তাই নয়, জীবনের নিরাপত্তা যা সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত, তা আজ ভূলুণ্ঠিত। কেউ জানে না, আজ কার উপর আঘাত আসবে। চলছে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যক্তি পূজার প্রচার ও দেশকে ধীরে ধীরে স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোয় রূপান্তর ঘটানো। একদিকে ভারত সরকার আমেরিকার ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর গত কয়েক বছরে নগ্ন আক্রমণ সংক্রান্ত প্রতিবেদনকে অসত্য ও ভিত্তিহীন বলছে, সংবিধানের কাঠামোয় সংখ্যালঘুর সমস্ত অধিকার সংরক্ষিত বলে দাবি করছে, দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বলে দাবি করছে, অন্যদিকে বাস্তবে ভারতভূমিতে সংখ্যালঘু ও দলিতদের উপর আক্রমণের নিত্য নতুন ফন্দি বের করছে দেশের শাসকদল, তৈরি করছে ভয় ও সন্ত্রাসের পরিবেশ। দুদিন আগে সংসদে ওড়িশার মোদী বলেছেন, "বন্দে মাতরম না বললে দেশে থাকা যাবে না" - যা সম্পূর্ণত সংবিধানবিরোধী, অথচ এই সংবিধানবিরোধী বক্তব্য উচ্চারিত হয়েছে আইনসভাতেই, যা নিয়ে তাঁর দলের মধ্য়ে থেকে কোনও প্রতিবাদ উঠে আসেনি।
এগুলোর বিরোধিতা করাটাই বর্তমান সময়ে নাগরিক সমাজের, আমাদের সকলের কর্তব্য। তাহলেই জরুরি অবস্থার দুঃস্বপ্নের স্মৃতির পুনরুদ্ধার রোখা সম্ভব।
(সুজাত ভদ্র মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক। মতামত ব্য়ক্তিগত।)