হায়দরাবাদে অভিযুক্ত চারজনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে। অভিযোগ ছিল ধর্ষণের। অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। অনেকেরই ধারণা, এবং এমন ধারণা করার যথেষ্ট কারণ আছে যে অভিযুক্তদের রাতের অন্ধকারে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই ‘হত্যাকাণ্ড’-এর ঘটনায় গোটা দেশ আপাতদৃষ্টিতে দু’ভাগে বিভক্ত। একপক্ষকে বলা হচ্ছে ‘ফ্যাসিবাদী’ অন্য পক্ষকে বলা হচ্ছে গণতন্ত্রের পক্ষে এবং প্রগতিশীল। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি সব অভিযুক্তের বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু এই লেখার বিষয়, যাঁরা এই ঘটনায় মৃত্যুকে সমর্থন করছেন, তাঁরা সবাই ফ্যাসিবাদী নন, হিন্দুত্ববাদীও নন। একটি ঘটনার ফলাফল সাময়িক ভাবে দু’পক্ষকে একটা জায়গায় মিলিয়ে দিয়েছে। আবার যাঁরা এই মৃত্যুর বিরুদ্ধে, তাঁদের মধ্যেও অনেকে সংগঠন, অনেক ব্যাক্তি, এই নির্দিষ্ট ঘটনাটির বাইরে, গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী, কার্যত ফ্যাসিবাদের পক্ষে।
হিন্দুত্ববাদীরা এই ‘হত্যাকাণ্ড’কে সমর্থন করছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মোহন ভাগবত এ-ও বলেছেন, যার অর্থ মেয়েদের বাইরে না বেরিয়ে সংসারে মন দেওয়া উচিত। যতই হাতে জনসমর্থনের আসনসংখ্যা থাকুক, যাদের নেতারা ‘মব-লিঞ্চিং’-এ অভিযুক্তদের বাড়িতে ডেকে মালা পরান, সংসদে সংখ্যার জোরে সংবিধান বিরোধী ধর্ম-ভিত্তিক নাগরিকত্বের ছক কষে কয়েক কোটি মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক তৈরির পরিকল্পনা করেন, তাদের চরিত্র অনেকটাই প্রকাশিত।
আরও পড়ুন, ধর্ষণ, মৃত্যুদণ্ড, খাপ পঞ্চায়েত কালচার
কিন্তু, এর বাইরেও বহু মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা, এই মৃত্যুকে সমর্থন করেছে। কেন? আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, ‘ আমরা শুধুই মার খাবো, ধর্ষণ করা হবে, পুড়িয়ে মারা হবে, শিশু থেকে বৃদ্ধা কারও রেহাই নেই। প্রতিদিন টিভিতে, খবরের কাগজে এই খবর দেখে অফিস যাবো, মেয়েকে বাইরে পাঠাব, আর প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাঠ হয়ে বসে থাকব ভয়ে’ এই দম বন্ধ করা অবস্থা থেকে সাময়িক একটা নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো আবহ তৈরি করেছে এই এনকাউন্টার।
হায়দরাবাদের ঘটনার পরে, মুম্বাইতে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। তার কাজ সেরে ফিরতে রাত হয়। ভিটি থেকে গোরেগাঁও আসতে হয়। তার কথায়, ‘রাত এগারোটা বারোটা হলেও কোনও দিন ভয় পাইনি। হায়দরাবাদের ওই ঘটনার পরের দিন, বেশি রাত হয়ে গিয়েছিল, আমার কামরায় লোক ছিল না, হঠাৎ খুব ভয় পেলাম, কামরা বদললাম। এমন আগে কখনও হয়নি’। তার কথা, ‘ কেন আমাকে ভয় পেতে হবে শুধু মেয়ে এই কারণে’? এনকাউন্টারের পরে তার বক্তব্য, ‘হয়তো খুবই ক্ষণস্থায়ী, আমরা জানি, তবু কিছুক্ষণের জন্য মনে হচ্ছে, কোথাও কেউ আমাদের হয়ে একটা কথা বলল। ভুল হলেও এই ভুলের কখনও কখনও দরকার হয়। সারা পৃথিবী আমাদের বিরুদ্ধে, এই মানসিকতা থেকে খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও মনে হয় একটু বেরোতে পারলাম’।
আরও পড়ুন, উন্নাও বুঝিয়ে দিল, এনকাউন্টার সমাধান নয়
এরকম আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, এই যে মেয়েটি, বা এরকম আরও অনেকে, এরা মোটেই হিন্দুত্ববাদী নয়, খবরের কাগজে লেখার মাধ্যমে, ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে, এদের অনেকের ভাবনার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কয়েক জন মা-কে জানি, যাঁরা মনে করছেন, এই ঘটনায় তাঁর কন্যার নিরাপত্তা যদি একটু বারে! ‘ভুল’ ভাবে হলেও স্বস্তি পাওয়ার ইচ্ছে তো দোষের নয়। এদের সবাইকে ফ্যাসিবাদী বলে দাগিয়ে দেওটা অন্যায়, অমানবিক। ভুল রাজনীতি।
এনকাউন্টার করে হত্যা করার ঘটনা, আমরা যারা ৭০-এর দশক দেখেছি, তারা জানি। সেই হত্যা এখনও সমানে চলেছে। এই ক’দিন আগেও আগরওয়াল কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে কী ভাবে নির্দোষ গ্রামবাসীদের পুলিশ মাওবাদী বলে দাগিয়ে দিয়ে এনকাউন্টারের নাম করে খুন করেছে। একই ধরনের ঘটনায় মণিপুরে শর্মিলা চানু বছরের পর বছর অনশন করেছেন। সরোজ দত্তের মৃত্যু আমরা জানি।
কিন্তু এর একটা উল্টো দিকও আছে। সেখানে কিন্তু যাঁরা ফ্যাসিবাদী বলে অন্যদের দাগিয়ে দেন, তাঁরা চুপ করে থাকেন। বর্তমান সরকারের আমলে মাওবাদী নেতা কিষেনজিকে যে ভাবে মারা হয়েছিল, অনেকেই বিশ্বাস করেন সেটাও এনকাউন্টার ছিল। সেই বিষয়ে যে ধরনের বিচারবিভাগীয় তদন্ত হওয়ার দরকার ছিল, তা হয়নি। কিষেনজির মতো বড়ো মাপের নেতার এই বিচার প্রাপ্য ছিল। কিন্তু কিষেনজির যে অনুগামীরা শুধুমাত্র সিপিএম করেন বলে স্কুলে ঢুকে শিক্ষককে গুলি করে মেরে ‘জনগণের শত্রু’ বলে দাগিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল, তখন কিন্তু দেখেছি অনেক অ-সিপিএম প্রগতিশীলদের চুপ করে থাকতে।
২০১০ সালে শান্তি-আলোচনাপন্থী মাওবাদী পলিটব্যুরো নেতা আজাদের পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যুতে অনেকেই, খুব স্বাভাবিক কারণেই, বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছিলেন। দেশের আইনে সেটা আজাদের প্রাপ্য ছিল। কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থায় (যত পোকায় খাওয়াই সেটা হোক না কেন) যে অধিকার আজাদের প্রাপ্য, সেই গণতান্ত্রিক অধিকার তো মাওবাদীরা যাঁদের খুন করছেন, তাঁদেরও প্রাপ্য। উপাচার্য গোপাল সেন, হেমন্ত বসু থেকে শুরু করে পাড়ার মোড়ের কনস্টেবলের খুনে যারা নীরব থাকেন, তাদের কী করে গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন বলা যায়!
আরও পড়ুন, হায়দরাবাদের এনকাউন্টার ও পরিতোষের বুলেট
স্কুল শিক্ষক অর্চনা গুহর কথা সবার নিশ্চয়ই মনে আছে। নকশালপন্থী ভাই সোমেন গুহকে না পেয়ে অর্চনা গুহ, সোমেনের স্ত্রী অধ্যাপক লতিকা গুহ এবং বাড়ির আরেক জন মহিলাকে দমদম থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। টানা ২২ দিন তাঁদের লাল বাজারে অন্য নামে গ্রেফতার দেখিয়ে অত্যাচার করা হয় তাদের উপর। অর্চনা গুহ পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। জরুরি অবস্থা উঠলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সহায়তায় বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করে অর্চনা গুহ হাঁটা-চলার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছিলেন। প্রধানত পুলিশ অফিসার রুনু গুহ নিয়োগী লালবাজার অর্চনা গুহদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিলেন ২২ দিন ধরে। সোমেন গুহ মামলা করেন রুনু গুহ নিয়োগীদের বিরুদ্ধে।
১৯৮৬-৮৭ সাল হবে। সাংবাদিক হিসেবে অর্চনা গুহর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ আমারই প্রথম হয়েছিল। পরে অর্চনা গুহ মামলার জন্য আমরা কয়েক জন বন্ধু অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সেই সময়ে একটি খবরের কাগজে রুনু গুহ নিয়োগির বিরুদ্ধে অর্চনা গুহদের এই মামলা নিয়ে লেখার জন্য প্রকাশক, সম্পাদক সহ আমাদের কয়েক জনের (দেবেশ রায়, গৌতম চট্টোপাধ্যায় সহ) বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ থেকে সুয়ো মোটো মামলা করা হয়, আমাদের কয়েক জনের নামে গ্রেফতারি পরওয়ানা বের করা হয়। পরে আমরা হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করি। মামলাতে জয় হয়েছিল আমাদের।
সেই সময় একদিন অর্চনা গুহকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘এই যে লড়াই করে চলেছেন, প্রতিপক্ষ বিরাট শক্তিশালী, আপনারা বিচারের আশায় আছেন, মামলা এগোচ্ছে না, দিনের পর দিন ডেট পড়ছে, কিছু কী হবে? কী মনে হয়’? অর্চনা গুহর উত্তর ছিল, ‘চেষ্টা করছি আমরা, না হলে কী করব, তবে এটাও মনে রাখতে হবে, যত মহৎ উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, আইনের চোখে আমাদের অনেক বন্ধুও তো অপরাধ করেছে, এতগুলো খুন কারা করল, কিন্তু তার জন্যও তো কারও কোনও শাস্তি হয়নি, তাদের বাড়ির লোক-জনেরও বিচার পাওয়ার অধিকার আছে, সেই কথা ভেবে আমার বিচার না পাওয়াটা মেনে নেব’। অর্চনা গুহ খুব লম্বা নন। এই উত্তর শুনে সেদিন আমি দেখছিলাম, উনি আমার সামনে উঁচু আরও উঁচু আরো উঁচু হয়ে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন, ধর্ষণে মৃত্যুদণ্ড কিংবা গণপিটুনির দাবি: হাত ধুয়ে ফেলার রাজনৈতিক চেষ্টা
মনে রাখতে হবে অর্চনা গুহ কোনও দিন রাজনীতি করেননি। ভাই রাজনীতি করতেন বলে তাঁর এই শাস্তি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমান চোখে কী ভাবে দেখতে হয়, সেটা সেদিন ওঁর কাছ থেকে শিখেছিলাম। সেই অত্যাচারী রুনু গুহ নিয়োগীকে বামফ্রন্ট সরকার এসে প্রোমোশন দিয়ে দেয়। এমনও বামপন্থী নেতাদের বলতে শুনেছি, রুনু আছে বলে কলকাতার মানুষ রাতে শান্তিতে ঘুমোতে পারে। এই বামপন্থীরা কি সবাই ফ্যাসিবাদ বিরোধী? মাওবাদীদের হাতে বিরোধীদের (পুলিশর চর বলে দাগিয়ে দিয়ে) মৃত্যুতে যারা চুপ করে থাকেন, তারা কি ফ্যাসিবাদ বিরোধী?
সময় বোধহয় এসেছে, অন্যকে ফ্যাসিবাদী বলার আগে নিজের দিকে তাকানোর। যাঁরা স্তালিনের হাতে নির্বাসিত কবি-লেখকদের পক্ষে কথা বলেন না, যাঁরা তিয়েন আন মেন স্কোয়ার নিয়ে চুপ করে থাকেন, যাঁরা গরিব কনস্টেবল খুনকে মুক্তির পথ মনে করেন, তাঁদের হাতে কি গণতন্ত্র নিরাপদ? সন্ত্রাস রং বদলালে ভালো?
(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)