বাঙালি উচ্চমধ্যবিত্ত পেশাজীবীদের গুরুতর অভিব্যক্তির ভাষা যে ইংরেজি, সে নিয়ে হাসি ঠাট্টা দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত। রেগে গেলে হিন্দি বা ইংরেজি বলা নিয়ে অনেক বিদ্রূপ-কৌতুকও হয়েছে, বাঙালি তা নিয়ে খুব হেসেছে, এবং ফের সেই গড্ডলিকা প্রবাহেই গা ভাসিয়েছে।
এ প্রবণতা ক্রমশ বর্ধমান। প্রকাশ্যে কথা বলার সময়ে, একটু উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদস্থরা, কিংবা যাঁদের সমাজে নামডাক রয়েছে, সেই সব বাঙালি মানুষ, ২১ ফেব্রুয়ারি বা ১৯ মে নাগাদ যাঁদের ভাষার প্রতি প্রবল দায়িত্ববোধ জেগে ওঠে, তাঁদের আলোচনাপ্রয়াসের ভাষা ইংরেজিই হয়ে রয়েছে। প্রায় ব্যত্যয়হীন। তালিকায় থাকবেন সাংবাদিক থেকে সম্পাদক, অধ্যাপক থেকে নামী সাহিত্যিক এবং কে নয়।
বাংলা বানান দেখে রেগে যাবেন না
ইংরেজির প্রতি মানুষের এই মোহ কেন কাটল না তার বহুরকম সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকতেই পারে। কিন্তু একে মোহ বলে মনে করা, একে সমস্যা বলে মনে করার ক্ষেত্রটিই ক্রমশ সংকুচিত। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম মুখ বাংলা পক্ষের গর্গ চট্টোপাধ্যায় যেমন মনে করেন, এটি এই মুহূর্তের সমস্যা নয়। গর্গর যুক্তির কারণ বোঝা যায়, তাঁর সাংগঠনিক বর্শামুখ তিনি বদলাতে চাইবেন না, কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে সে কারণটা কী বা কী কী হতে পারে, তা নিয়ে দু-চার কথার অবতারণাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
বাঙালিদের মধ্যে যে বিভাগটি সাংস্কৃতিক ও ভাষিক স্তরে আধিপত্য তৈরি ও বিস্তার করতে সক্ষম, তাঁদের মূল অংশ, বা হাতে গোনা কিছু উদাহরণ বাদ দিলে প্রায় পুরো অংশটাই ইংরেজিমুখী। এর একটা বড় কারণ অবশ্যই ঔপনিবেশিক লেজুড়তা। কিন্তু আরেকটি বড় কারণ নিজের ভাষা ও তার সংস্কৃতি সম্পর্কে চেতনাহীনতা।
একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। বাংলা ভাষায় সহজ ও সরল বলে দুটি শব্দ রয়েছে। খণ্ডিত হতে হতে, এখন সহজ ও সরল সমার্থক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা যে তেমন নয়, বাংলার মাটিতে সহজিয়া নামের ধারার সঙ্গে সামান্য পরিচয় থাকলেই তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে। কিন্তু সহজিয়া ধারা সম্পর্কে ইংরেজি তত্ত্বগ্রন্থ তেমন লভ্য নয় বলেই সহজ ও সরল শিশুতোষী সমার্থবাহী হয়ে উঠতে পেরেছে।
বাংলা পরিভাষা তৈরির ক্ষেত্রে বাঙালি মেধাজীবীরা লক্ষ্যণীয়ভাবে অকৃতকার্য। তার একটা বড় কারণ, ইংরেজিতে তাঁরা ভাল থাকেন, ভাল আছেন। এবং বিচ্ছিন্নতার সুখেও আছেন। বিচ্ছিন্নতার সুখের কথার আগে পরিভাষা তৈরির ক্ষেত্রে অনিচ্ছার যুক্তিগুলি একটু আলোচনা করা যাক।
বিভিন্ন সরকারি আধিকারিকদের দফতর ও পদের কিছু বাংলা পরিভাষা বানানো হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে। সে পরিভাষাগুলি জনপরিসরে ব্যবহৃতই হয় না। এ ব্যাপারে জোর দিতে গেলে শুনতে হয়, এসব কীরকম বাংলাদেশের মতন। এই উচ্চারণের মাধ্যমে একাধিক সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়ে। প্রকাশিত হয়ে যায় যে বাংলাদেশ সফল হয়েছে, তাদের এ ধরনের পরিভাষাগুলি সরকারি খাতায় আটকে থাকেনি, জনপরিসরে এসেছে, কিন্তু পশ্চিমবাংলার বাঙালি এ ধরনের প্রয়াসকে তুচ্ছ মনে করেছে, এবং নতুন বাংলা পরিভাষাকে গ্রহণ ও জনপ্রিয় করার বদলে ঔপনিবেশিক শিক্ষার কাঠামোকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছে, এবং এখনও পর্যন্ত এ ব্যাপারে এ বাংলার বাঙালির সাফল্য প্রশ্নাতীত।
এ ব্যাপারে এক শিক্ষাবিদের সঙ্গে কথা হয়েছিল বেশ কয়েকবছর আগে। বাঙালির সেই সুসন্তান অকপট ভাবে বলেছিলেন, তিনি নতুন কোনও তত্ত্বভাবনার সময়ে ইংরেজিতে ভাবেন। তিনি বাংলারই বাসিন্দা ছিলেন, ছোটবেলা থেকে, উক্ত কথোপকথন পর্যন্তও। নিজের যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছিলেন, পরিভাষার ইংরেজি নির্ভরতার কথা।
অর্থাৎ, বিষয়টা এরকম, পরিভাষা হলে, তা ঠিক লাগছে না বলে প্রত্যাখ্যান, তারপরে পরিভাষাহীনতার জন্য ইংরেজি ভাষাতেই চর্চা চালিয়ে যাওয়া, সুখে, বিচ্ছিন্নতায়। এ বিচ্ছিন্নতায় সুখ এই যে, এখানে প্রতিস্পর্ধীর সংখ্যা কমে যাবে, ভাষাগত তফাতের কারণে, ইংরেজিতে দড় না হবার কারণে। ইংরেজি-অজ্ঞানতায় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আত্মবিশ্বাসের অভাবে একটা বড় অংশ এই ইংরেজি তত্ত্বজ্ঞদের ধারে কাছে ঘেঁষবেন না, ঘেঁষেন না।
বাংলা ভাষার এক জার্নালের এক লেখকের প্রবন্ধের শেষে দেওয়া গ্রন্থ ও প্রবন্ধসূচিতে দেখেছিলাম, বাংলা ভাষায় লিখিত বই-প্রবন্ধের উল্লেখ করার সময়ে আগে পদবী, পরে নাম দেওয়া রয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি জবাব দিয়েছিলেন, উচ্চশিক্ষাঙ্গণে এরকম ভাবেই উল্লেখ করার দস্তুর। একটি বাংলা জার্নালে, বাংলা ভাষায় পূর্বপ্রকাশিত লেখার উল্লেখ করার জন্য ঔপনিবেশিক পদ্ধতি অবলম্বনের এরকম যুক্তি ও প্রমাণ নিশ্চিত ভাবেই আজও বিস্তর মিলবে।
প্রশ্নটা হল আকাঙ্ক্ষার। আর সেই আকাঙ্ক্ষার জায়গায় এ বাংলার বাঙালিরা শতগুণ পিছিয়ে ও ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক। আর তারই সুযোগ নিয়ে চলেছে বাংলা ভাষার বিভিন্ন মাধ্যমের দায়িত্বে থাকা অবাঙালিরা। বাঙালি মনন সম্পর্কে, সে ভাষার হাল সম্পর্কে প্রায় অজ্ঞ বা যৎসামান্য জ্ঞান সত্ত্বেও তাঁরা স্থির করে দেন, বাংলার পক্ষে কোনটা ঠিক। তাঁদের সে ঠিক করার পিছনে থাকে নিদারুণ এক আত্মবিশ্বাস। ইংরেজির আত্মবিশ্বাস, বাংলা যার প্রতিস্পর্ধিতা প্রদর্শনের সাহস দেখাতে পারে না। এ কথাটা খণ্ডসত্য বলে মনে হতে পারে, বলা যেতে পারে, ব্যাপারটা এত সরল নয়, এর মধ্যে পুঁজির বিন্যাসের বিষয় রয়েছে, সর্বভারতীয় স্তরের পুঁজি অনেক বেশি আধিপত্য দেখাতে সক্ষম। ঠিক। কিন্তু একই সঙ্গে এও ঠিক, এই যুক্তিটার আড়ালে নিজেদের হেরে যাওয়া মনন ও সংস্কৃতিকে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করে মেধাজীবী বাঙালি।
সাহিত্যিক দেবেশ রায় একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যত বেশি ইংরেজিতে অনুবাদ্য, তত ভাল লেখা- এরকম একটা ব্যাপার আবিশ্ব স্বীকৃত। কথাটার সত্যতা বাংলা ভাষাজীবী, বাংলা পেশাজীবী, সকলকে দেখলেই স্পষ্ট হয়।
যাঁরা বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ বলে দীর্ঘদিনের দাবিদার, তাঁরাও কদাপি বাংলা পরিভাষা তৈরির দিকে মনোযোগ দিয়েছেন, এমন অপবাদ দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনীয় ইংরেজি গ্রন্থের স্বত্ব-ফাঁড়া কাটিয়ে তার অনুবাদের জন্য কোনও তেমন চেষ্টা বাংলাবাদীদের দিক থেকে চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে না, কারণ তেমন চেষ্টা নেই। চেষ্টা নেই, কারণ, তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব নেই, নেই তলিয়ে ভাবার ও লেগে থাকার আকাঙ্ক্ষা।
তলিয়ে ভাবার প্রবণতা নেই বলেই ভাষিক রাজনীতির বহু স্তর অছোঁয়া থেকে যায়। গত বছর জনতার সাহিত্য উৎসবে এসেছিলেন তামিল ভাষার কবি ও চলচ্চিত্রকার লীনা মনিমেকেলাই। তিনি বলছিলেন, ক্লিটোরিসের কোনও তামিল নেই। কেন নেই, তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি তাঁর ব্যাখ্যা বলেছিলেন, যে পিতৃতন্ত্র এরকম একটা শব্দের তামিল করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি, এড়িয়ে থাকতে চেয়েছে।
বাংলা ভাষায় এরকম বহু উদাহরণ নিশ্চিত মিলবে, যেখানে দেখা যাবে অপর গোষ্ঠীভুক্তের যাপিত জীবনের বহুলাংশ নিজ ভাষায় অনুপস্থিত। তার কারণ সেই একই, ক্ষমতা।
ক্ষমতা যে সর্বত্র বিরাজমান, সে কথা এ বাংলার বাঙালি তথা ইংরেজি শিক্ষিত মেধাজীবীরা জানেন। তাঁরা সভা সমিতিতে ইংরেজি ভাষাতে এর প্রতিবাদ করে থাকেন। মাঝে মাঝে বাংলা ভাষাতেও।
মাঝে সাঝে।
তাঁদের মুখ থাকে পশ্চিম পানে। না, নমাজের জন্য নয়। নিজ ভাষা থেকে পালানোই তাঁদের অভীষ্ট। উদ্দেশ্য। চেতনে বা অবচেতনে।
এসব কোনও কথাই নতুন নয়। ভাষা দিবসের সুযোগ নিয়ে পুনরুচ্চার মাত্র।