ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাংসদের এক প্রতিনিধিদলের কাশ্মীর সফরের তিন-চারদিন আগে ইউরোপেরই এক রাষ্ট্রদূত দিল্লিতে তাঁর দপ্তরে বসে কাচের জানলা দিয়ে দূতাবাসের সবুজ লনের দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে আমাকে বলেছিলেন, "কী দরকার ছিল এখন এই প্রতিনিধি দলকে কাশ্মীরে নিয়ে যাওয়ার?" আমি বলি, "কেন, আপনার সমস্যাটা কোথায়?" ওই সাহেব কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর বিপক্ষে নন, বরং দীর্ঘদিন ধরে দেখছি বেশ সমর্থক - 'ভক্ত' টাইপ। বহু বছর দিল্লিতে আছেন, ২০১৪ সালের আগে থেকেই। এবং তিনি যথেষ্ট শিক্ষিত, 'ভাইব্র্যান্ট গুজরাট' সামিটে নিয়মিত যেতেন। সেখানেই ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়।
তা এই রাষ্ট্রদূত আমার প্রশ্নের জবাবে বললেন, "আসলে ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি একান্তভাবে ভারতীয় সিদ্ধান্ত। মোদী সরকারের পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতাও আছে। তাই এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ব্যাপারে আমাদের বলার কী থাকতে পারে? কিন্তু আপনাকে একটা ভেতরের খবর বলি, ইউরোপের সব দেশ কিন্তু ভিতরে ভিতরে এই সিদ্ধান্তের পক্ষে নয়। অনেক মতপার্থক্য আছে। বিশেষত মানবাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ সম্পর্কিত বিষয়টি ইউরোপের দেশগুলির কাছে খুবই সংবেদনশীল। এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন একটি আলোচনার বিষয়।"
ভারত অবশ্য পাকিস্তানের তোলা এই অভিযোগ খারিজ করে দিচ্ছে। ওই রাষ্ট্রদূত সেদিন বলেছিলেন, ইউরোপের মানুষের কাছে যখন কাশ্মীর নিয়ে সমস্ত তথ্য নেই, যখন ইউরোপের দেশগুলি আনুষ্ঠানিকভাবে ৩৭০ ধারা নিয়ে কোনও মন্তব্য না করে নীরব থাকছে, তখন এত তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন কী? বরং বিষয়টি নিয়ে আগে ইউরোপের দিল্লিস্থিত রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার প্রয়োজন ছিল।
সেদিন যখন এই আলাপ আলোচনা হচ্ছিল, তখন বুঝতে পারি নি, ইউরোপের সাংসদ প্রতিনিধিদলের কাশ্মীর সফর নিয়ে এহেন বিতর্ক হবে। এমনকি লন্ডনের এক সাংসদ প্রতিবাদে মুখর হয়ে ফেরত চলে যান, কারণ এই সাংসদের দাবি ছিল, তাঁকে তাঁর ইচ্ছেমতো কাশ্মীরে ঘুরতে দিতে হবে। তিনি সাধারণ মানুষদের সঙ্গে যত্রতত্র কথা বলবেন, এবং নিরাপত্তা ছাড়াই। নিরাপত্তা ছাড়া বিদেশি সাংসদকে যত্রতত্র বিচরণের অনুমতি ভারত সরকার দিতে পারে নি।
আরও বিতর্ক তৈরি হয় বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয় এনজিও-র আধিকারিক মধু শর্মাকে নিয়ে। জানা যায়, এই সফরটি সরকারি সফর ছিল না। বিদেশ মন্ত্রক আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেয়, এটি কোনও সরকারি প্রতিনিধিদল নয়। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কোনও ভূমিকা ছিল না এই সফরের আয়োজনে। বিদেশের নানা সংবাদমাধ্যমে এই প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মনোনয়ন নিয়ে সমালোচনা হয়। অভিযোগ ওঠে যে এই প্রতিনিধিদল নিরপেক্ষ নয়। এই সদস্যরা মূলত দক্ষিণপন্থী, এবং কাশ্মীরে সন্ত্রাস দমনের প্রশ্নে কট্টরবাদী এই সদস্যরা সেনা বা আধাসামরিক বাহিনীর দমন নীতির পক্ষে। এই সদস্যরা মানবাধিকার নিয়ে আদৌ ভাবিত নন।
কে এই মধু শর্মা? এ নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা, গুজব, কাহিনী, দিল্লির নানা স্তরে ঘুরছে। কিন্তু এসব হয়ে যাওয়ার পরও প্রশ্ন থেকে যায়, এই সফর সংগঠিত করার দায়িত্ব কার ছিল? বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের? নাকি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ ধরনের সফরের খুঁটিনাটি নিয়ে সাধারণত হোমওয়ার্ক করেন। তবে এ সফরে কাদের আনা হচ্ছে? এর প্রয়োজনীয়তা কতখানি? সেটার হোমওয়ার্ক প্রধানমন্ত্রী করেন নি।
সরকারের অন্দরমহলের বিতর্ক চলছেই। প্রথম প্রশ্ন হলো, কাশ্মীর সম্পর্কিত বিষয়গুলির সার্বিক দায়িত্ব জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার। বিদেশমন্ত্রীর নয়। বিদেশমন্ত্রীর কাজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা, কিন্তু কাশ্মীরের উপত্যকার জঙ্গী বিরোধী অপারেশনের সঙ্গে জয়শঙ্করের কোনও সম্পর্ক নেই। তাহলে এই সফরের নেপথ্যে দায়িত্ব কার?
এদিকে, যেদিন এই প্রতিনিধিদল সফরে যায়, সেদিনই কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী আঘাত হানার খবর আসে। সেই হানায় নিহত হন বাংলার মুর্শিদাবাদের পাঁচ বাসিন্দা। এ ঘটনায় বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, একদিকে যখন ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের কাশ্মীরে আনা হয়, ঠিক তখনই এত বড় সন্ত্রাসের ঘটনা প্রমাণ করে দেয় যে কাশ্মীরে আইন শৃঙ্খলার অবনতির জন্য সরকারই দায়ী। এই সন্ত্রাসের মোকাবিলা যে সম্ভব হচ্ছে না, তার জন্য দায়ী মোদী সরকারই। আবার সরকার তথা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বর বক্তব্য হলো, ভারতের পাকিস্তান-বিরোধী যে সন্ত্রাসের অভিযোগ, তাই তো ওই প্রতিনিধিদলের সামনেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। প্রতিনিধিদল তো দেখতে পেল, কাশ্মীরে পাকিস্তান কী করছে।
২৯ অক্টোবর কাশ্মীরে পরিদর্শনের সময় ভূস্বর্গে ইউরোপীয় সাংসদরা দেখলেন সকাল থেকেই রীতিমতো বনধের চেহারা। জায়গায় জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনী আর বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ। মোট ২৩ জন এমপি এসেছিলেন। একদিকে শিকারায় চড়ে ভূস্বর্গের সৌন্দর্য দর্শন, অন্যদিকে নয়া দিল্লিতে এই ঘটনার সমালোচনায় মুখর কংগ্রেস, সিপিএম, ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলি।
সফরটির ব্যবস্থাপনায় ছিলেন মধু শর্মা, যিনি মাদি শর্মা বলেই ইউরোপে অধিক পরিচিত। মধু শর্মা একটি মহিলাদের আর্থিক ও সোশ্যাল 'থিঙ্ক ট্যাঙ্কের' প্রধান। তার কার্যকলাপ ইউরোপেই। তিনি ব্রাসেলস ও লন্ডনেই থাকেন। ২০১৪ সালে এই এনজিও-টির জন্মসময় থেকে আজ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে এই সংস্থার কোনও অপারেশনের নজির পাওয়া যায় নি। টেকনিক্যালি ২০১৩ সালে এই সংস্থাটির রেজিষ্ট্রীকরণ হয়। তারপর দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর ১০ থেকে ২৪ হাজার ইউরো তাদের বাৎসরিক আয় ছিল, এবং এটি এককালীন অনুদান। জনগণ বা কোনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠান থেকে এই অর্থলাভ হয় না।
মধু শর্মা নিজে একজন ব্রিটিশ নাগরিক। তিনি নিজেই নিজেকে এক লবিইস্ট ফার্মের প্রধান তথা বিশিষ্ট ব্র্যান্ড বলে অভিহিত করেন। তিনি এই সাংসদদের কাশ্মীরে আসতে শুধু উদ্বুদ্ধ করেন তাই নয়, সকলকে আশ্বাস দেন যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি একটি বৈঠকেরও ব্যবস্থা করে দেবেন। লন্ডনের সাংসদ ক্রিস ডেভিসের ই-মেইল থেকেও জানা যায়, কীভাবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার করানোর ব্যাপারে আশ্বাস দেন।
দেখুন, বিদেশে এ ধরনের লবিইস্ট ফার্মের কাজকর্ম কোনও নতুন ঘটনা নয়। কোনও অপরাধও নয়। বরং জাতীয় স্বার্থে বিদেশী রাষ্ট্রে লবিইস্ট ফার্মের কাজ করা তো জাতীয়তাবাদী, ইতিবাচক ঘটনা। অতীতে সমালোচনা হতো, চিন এমনকি পাকিস্তান বিশ্বমঞ্চে এ ধরণের লবি গড়তে সক্রিয় হলেও ভারত নয়। তা মোদী জমানায় যদি সরকারি সাহায্য নিয়েও মধু শর্মার সংস্থা কাজ করে (যে অভিযোগ গুলাম নবী আজাদের মতো কংগ্রেস নেতারা করছেন) তাতে অন্যায়টা কী? তবু ভারতে এই সফর নিয়ে মোদী সরকারের পক্ষে সেদিন প্রচারটা করা যায় নি। বোধহয় ভারতীয় সামাজিক মনস্তত্ব এখনো এ ধরনের তৎপরতার জন্য প্রস্তুত নয়।
আসলে বিরোধীদের আক্রমণে হাতিয়ার জুগিয়েছিল উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের লেবার পার্টি এমপি থিবস গ্রিফিনের টুইট। যেখানে তিনি স্পষ্ট করে দেন যে এ সফরে যে সাংসদরা এসেছেন, প্রত্যেকেই এসেছেন ব্যক্তিগতভাবে। এর সঙ্গে ইউরোপের পার্লামেন্টের কোনও সম্পর্ক নেই। বিদেশী এমপি-দের এই প্রতিনিধিদলকে নিয়ে আসার কারণ ছিল একটাই। কাশ্মীরের পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা।
কিন্তু ইংল্যান্ডের লিবারল ডেমোক্রাট প্রতিনিধি ক্রিস ডেভিস অভিযোগ করেন, কাশ্মীরে যত্রতত্র তাঁদের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় নি। মনে রাখতে হবে, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বিভিন্ন দেশের সরকারের সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত সংসদীয় প্রতিষ্ঠান। ইউরোপীয় কমিশন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে একত্রে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন প্রণয়নকারীর ভূমিকা পালন করে। এই প্রতিষ্ঠানটি ৭৫১ জন সদস্য নিয়ে গঠিত। ভারতের সংসদের পর এটিই বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত আইনসভা। এবং বিশ্বের বৃহত্তম আন্তঃরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভা। তাই নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যটা মহৎ ছিল, কিন্তু এত তাড়াহুড়ো করার বোধহয় প্রয়োজন ছিল না। বরং প্রয়োজন ছিল আরও সমন্বয়ের।