ইংরেজ লেখক রোয়াল্ড ডাল (১৯১৬-১৯৯০) এমন একজন লেখক যাঁর লেখা ছোটদের বইয়ের মোট বিক্রির সংখ্যা ২৫০ মিলিয়ন। অথচ খুব মধুর নয় ডালের লেখা গল্প-উপন্যাসগুলো। অনেক সুন্দর জিনিস থাকে, রূপকথার মতই রূপময়তাও থাকে অনেক সময়, কিন্তু বক্তব্যে, আর বলার ধরনেও, থাকে কোথাও এক কর্কশতা। কটুতাও এমনকি। এরই মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয়, কল্পনা আর রূপময়তার গল্প চার্লি নামের একটি ছেলের এক চকোলেট কারখানা দেখতে যাবার কাহিনি। সেই ছোট্ট শহরের চকোলেট কারখানা ছিল দেশবিদেশের একটা স্বপ্নের মত। এমন আশ্চর্য সব চকোলেট সেখানে তৈরি হত –যেমনটি কিনা না কেউ দেখেছে, না কেউ শুনেছে। কিন্তু বহুকাল ধরে সেই কারখানায় বাইরের লোকজন ঢোকা বন্ধ। সে চালানোর জন্য নাকি ঠিকঠাক লোক পাওয়া যাচ্ছে না। কী ভাবে কাজ চলে, কীভাবেই বা তৈরি হয় ঐসব চকোলেট-তার সমস্তটাই রহস্যে মোড়া বাইরের চকোলেট-পাগল দুনিয়ার কাছে।
তাতে চার্লি বলে ছোট ছেলেটির কিছুই যায় আসেনা। কারণ ঠাকুমা, দিদিমা, দুই দাদু- এই চারজন অসুস্থ বুড়ো মানুষকে নিয়ে বাবা আর মায়ের সঙ্গে সে থাকে ঐ শহরেরই একটা ভাঙাচোরা ঝুপড়ি ঘরে। মা লোকেদের কাপড় কাচেন, সেই সামান্য টাকাতেই চলে তাদের খাওয়াদাওয়া। বাবার উপার্জনও নেই বললেই চলে। এদিকে একদিন টিভির ঘোষণায় শহর উথালপাথাল- চকোলেট কারখানার মালিক উইলি উওংকা, যাকে কিনা কেউ কখনো দেখে নি, হঠাৎ ঘোষণা করেছে পাঁচটা, মাত্র পাঁচখানা, গোল্ডেন টিকিট ছাড়া হয়েছে চকোলেট বারের মধ্যে। যারা সেগুলো পাবে, তাদের উইলি উওংকা কারখানায় নেমন্তন্ন করবে। নানাদেশের চারজন প্রচণ্ড ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরা চারজন সেই টিকিট পেয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি, অদ্ভুত ভাবে ছোট্ট চার্লিও পেয়ে গেছে একখানা। নির্দিষ্ট দিনে একজন করে বড়দের সঙ্গে নিয়ে কারখানার ভেতরে আসা পাঁচ ছোটর মধ্যে চার্লির সংগে এসেছেন তার জো-দাদু, উৎসাহে যিনি একটুখানি হাঁটতেও পারছেন। চত্বর থেকে ভেতরে ঢুকবার আগেই তাদের দেখা হয় সেই রহস্যময় মালিক মোটামুটি সাধারণ চেহারার উইলি উওংকার সঙ্গে। অভ্যর্থনা জানিয়ে উইলি একটু কঠোরভাবেই যেন, সব্বাইকে বুঝিয়ে বলে দেয় কারখানার ভেতরে পালনীয় নিয়ম গুলোর কথা- যা দেওয়া হবে তাই প্রচুর কিন্তু যেখানে হাত দেওয়া নিষেধ, যা অন্যদের, সেখানে কেউ হাত দেবেনা। কাজের জায়গায় শৃঙ্খলা ভাঙবেনা । কোনোরকম খেয়ালিপনা বা আদুরে অবাধ্যতা নিষেধ।
ইঞ্চিতে মাপা সামাজিক দূরত্ব
চার্লি ছাড়া অন্য চারজন অতিথি হল অতি ধনী বাবা-মায়ের আদুরে বেপরোয়া ছেলেমেয়ে, যারা কোনোদিন কিছুতে বাধা পায় নি - বেহদ্দ লোভী আগস্টাস গ্লুপ, অবাধ্য উচ্ছন্নে যাওয়া ভেরুকা সল্ট, সারাক্ষণ চিউইং গাম চিবোনো ভায়োলেট বোরগার্দে আর টিভি-অন্তপ্রাণ মাইক টীভী। কারখানার ভেতরে সবকিছুরই প্রাচুর্য কিন্তু কিছু কাজ একেবারে বারণ। চকোলেট খাওয়া অবাধ কিন্তু তৈরির পদ্ধতিতে বা তৈরির নিয়মে কোথাও হাত দেওয়া বারণ। চারটি অবাধ্য, লোভী বাচ্চাই শাস্তি পায়, তাদের অভিভাবকরাও। তরল চকোলেটের নদীতে মুখ ডুবিয়ে খেতে গিয়ে যন্ত্রের পাইপে ঢুকে যায় লোভী অগাস্তাস, সাবধান করে দেওয়া সত্ত্বেও অন্যদের আগে একরকম বিশেষ চিউইং গাম খেয়ে ফেলে প্রকান্ড ফুলে ওঠে ভায়োলেট, যেখানে ঠিক চকোলেটের শেষ পরীক্ষা হয় সেখানকার বড়ো কাঠবেড়ালি দেখে ‘আমার চাই, এক্ষুণি’ বলে ছুটে যেতে গিয়ে ‘বাজে চকোলেট’ হিসাবে ময়লাফেলার বিরাট পাইপের মধ্যে দিয়ে চলে যায় ভেরুকা আর বারণ না শুনে নিজের কেরদানি দেখাতে গিয়ে বরফের রাজ্যে গিয়ে গুটিয়ে এইটুকু হয়ে যায় মাইক। শেষ পর্যন্ত বাকি থাকে কেবল ছোট্ট চার্লি আর তার জো দাদু। যারা দু জন খুশি মনে ধীরেসুস্থে দেখছিল। একবার ছোট একটু এডভেঞ্চার করতে গিয়ে বিপদেও পড়েনি এমন নয়, কিন্তু সামলে নিয়ে বেরিয়ে আসতেও পারে। আরো দু-একটা ছোট ছোট পরীক্ষার পর উইলি শেষে জো-দাদুকে জানায় চার্লিকেই সে মালিক করে দিতে চায় এই চকোলেট কারখানার কারণ চার্লি বুদ্ধিমান কিন্তু নির্লোভ আর তার সংযম আছে যা না থাকলে কোনো বড় আর সুন্দর স্বপ্ন সাকার করা যায় না। উইলি বলে আসলে উপযুক্ত উত্তরাধিকারী খুঁজে পাবার আশাতেই সে ওই গোল্ডেন কার্ডের খেলাটার আয়োজন করেছিল।
বেশ গল্প। সুন্দর আবার শিক্ষামূলকও। মনোহারীও বটে। সেই মনোহারিত্বের দিকটি তুলে ধরে এই একই গল্প নিয়ে বিশাল খরচ সাপেক্ষ সফল ছবি বানায় আমেরিকার দুই প্রকান্ড ফিল্ম কোম্পানি, ১৯৭১-এ আবার ২০০৫ সালে। ছোটদের জন্য এর চেয়ে ভালো অর্থপূর্ণ গল্প যে আমরা কখনো পড়িনি এমন বলা যাবে না কিন্তু তবু এই গল্পটির কথা মনে পড়ছিল। সংকটের সময়ে যেমন নানা নতুন ভাবনার পাশাপাশি পুরোন বহু জিনিসের অন্য অর্থ তৈরি করে মন, হয়ত তেমনই।
প্রবল দারিদ্রে বাল্যবয়েস কাটানো এই লেখকের জন্মসাল ১৯১৬। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উথালপাথাল পৃথিবীর মধ্যে সামান্য এক দরিদ্র পরিবারের বাবা মারা গেলে ওয়েলসএ থাকা মা অতি কষ্টে ছেলেকে বাবার শেষ আকাঙ্ক্ষামত ‘ব্রিটিশ শিক্ষা’ দিয়ে বড়ো করেন। সদ্য তরুণটিকে যোগ দিতে হয় সৈন্যদলে। বিমানবাহিনীতে ক্রমশ উন্নতি করেন, লেখা শুরু করে একরকম প্রতিষ্ঠাও পেয়েছিলেন কিন্তু শান্তিময় সুখের জীবন ঘটে নি।
মহামারীকালে দায়িত্ব ভাগাভাগি
পৃথিবীর নানা দেশের অভিজ্ঞতা কি তাঁকে এই কথা ভাবিয়েছিল যে বিশ্বপৃথিবীর নিয়ম মেনে চলাতেই মানুষের সমাজের কল্যাণ? উইলি ওংকা কি তাহলে এক ওয়েলশিয়ান সাহিত্যিকের মানসে প্রকৃতির প্রতীক? যে সৌন্দর্য আর প্রাচুর্য দেবে কিন্তু তার নিয়ম লঙ্ঘনের শাস্তি কঠিন? যে সকল স্বভাবকে ‘পাপ’ বা ‘ক্ষতিকারক অন্যায়’ বলে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হয়, কারখানার ভেতরে কাজ করা সবুজরঙের বেঁটে মানুষ ঊম্পা-লুম্পারা গান গেয়ে সেই প্রতিটি অন্যায়ের জন্য সমালোচনা করে বাচ্চাদের বাবা মাকে। ডালের লেখায় প্রথমে চার্লি ছিল এক কৃষ্ণাঙ্গ বালক। পরে প্রকাশকের পরামর্শে তিনি তাকে ‘শাদা’ করেন কিন্তু কেন কালো ছিল প্রথম চার্লি? সে কি এইজন্য যে যুদ্ধকালে আফ্রিকায় কর্মজীবন কাটানোর কালে ডাল দেখেছিলেন প্রকৃতির সঙ্গে, জীবনের সামগ্রিকতার সঙ্গে কালোমানুষদের জীবনের ছন্দোবদ্ধতার মধ্যে কোনো অর্থময়তা?
নিজেদের অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন লোভ আর ক্ষমতার আগ্রাসনের মধ্যে বন্দি আজকের এক অস্বাভাবিক পৃথিবীতে আমাদের কি মুক্তির পথসন্ধান করতে হবে নানা সভ্যতার জ্ঞানী মানুষদের রচনা করা শিশুপাঠ/ শুভপাঠগুলোর মধ্যে? আশু বিপদমুক্তির সাময়িকতায় ভুলে না গিয়ে যদি যাত্রা করতে হয় পৃথিবীর, প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে চলা এক মানব সভ্যতার সুস্থ স্থায়িত্বের পথে।
(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন