সবে লেখাটা লিখতে বসেছি, আমার ৪ বছরের ছেলে এসে বললো, "মামমাম, আমি আজকে ধোসা খাবো। ঝাল চাটনি দিয়ে।"
যারা পিঠে রুকস্যাক নিয়ে ইউরোপ/মিশর/চিন ঘুরতে দেখেছে আমাকে, তাদের আজো খটকা লাগে। মাথায় লাল নীল চুল...পায়ের তলায় সর্ষে...আর তিন মাস একজায়গায় থাকার পরই,উচাটন মন...
সেই উড়নচণ্ডী মেয়ে আজ সারারাত জেগে কাজ করে। ভোর হতেই রান্নাঘরে। কোনদিন ৫০পয়সা সাইজের লুচি আর আলুভাজা... কোনদিন চাউমিন... কোনদিন প্যানকেক... ছোট ছোট এগরোল... ৫দিনে ৫রকম টিফিন।
ছোটবেলায় সবাই যখন রান্নাবাটি খেলতো, আমি তখন ঘরের মধ্যে মঞ্চ বেঁধে নাটক নাটক খেলতুম। রুশদেশের রূপকথা। ঠাকুরমার ঝুলি। এনিড ব্লাইটন.... গপ্পোর কি অভাব আছে?
রান্নাবাটি পুতুলখেলায় আনাড়ি...সংসার সম্বন্ধে উদাসীন মেয়ে এখন একা বাজার করে, রান্না করে, হিসেব রাখে... অগ্নিস্নাত-র মা।
আমার ৪ বছরের ছেলের নাম অগ্নিস্নাত।
যখন প্রসব যন্ত্রণায় হাসপাতালের প্রসূতিঘরে শুয়ে ছটফট করছিলুম, তখন এক সহৃদয় নার্স এসে জিগ্গেস করেন, "কিছু লাগবে?"
হাতে চাঁদ পাবার মতোন খুশি হয়ে তাঁর কাছে একটু কাগজ আর কলম চেয়েছিলুম।
ওখানে শুয়ে শুয়েই আমার গর্ভের সন্তানকে চিঠি লিখি। শেষ লাইনে ছিলো,
তুই আগুনের নদী সাঁতরে আমার কাছে আসছিস।
তুই ভূমিষ্ঠ হলে, তোর নাম রাখবো - অগ্নিস্নাত।
অগ্নিস্নাত আর আমার ছোট্ট একটা পৃথিবী।
আমরা মাঝে মাঝে স্কুল কেটে ইকো পার্ক চলে যাই। ছেলেকে গাছ চেনাই, গাছে চড়া শেখাই। সায়েন্স সিটি চলে যাই। মামমামের পিঠে ঝোলাব্যাগ এখনো আছে।
ব্যাগের মধ্যে খাবার, জল, খরগোশ-গিনিপিগদের জন্য কপির ডাঁটা/ ব্রোকোলির পাতা / পালং শাক, মাছেদের জন্য মুড়ি, কুকুরদের জন্য বিস্কুট...আর ডাইনোসরের বই।
ছোট্ট ছেলেটা ২বছর বয়স থেকে ডাইনোসরের ভক্ত। ইদানিং অবশ্য তার সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্রহতারা আর Evolution of Man.
৪ বছরের অগ্নিস্নাত বর্ণপরিচয় ভুলে যায়।
কিন্তু ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রাজাসরাস নর্মাদেনসিসের ফসিল চেনে।
ওর সাথে সাথে অনিন্দিতাও চিনছে।
নতুন করে...সবকিছু।
আসলে মা হওয়া তো শুধু একটা পরিচয় নয়।
একটা আস্ত মানুষকে তিল তিল করে গড়ে তোলা।
আর তার চোখ দিয়ে নতুন করে পৃথিবীটা দেখা , সৃষ্টিকে চেনা।
অগ্নিস্নাত-র বড় হওয়াটা গতানুগতিক নয়।
আসলে ওর পৃথিবীতে আসাটাও গতানুগতিক ছিলো না।
১৭ বছর বয়সে এঙ্গেলসের The Origin of the Family, Private Property and the State পড়েই চক্ষু চড়কগাছ !!!
যাহ্ বাবা !
বিয়ের প্রবর্তনের সাথে প্রেমট্রেমের কোন সম্পর্কই নেই !!!সবের মূলে আসলে সম্পত্তি !
মাতৃতান্ত্রিক সমাজকে হটিয়ে পিতার পরিচয় প্রতিষ্ঠিত। সম্পত্তি পুরুষানুক্রমে যাতে হাতবদল হয়, তাই পিতার পরিচয় হলো সিদ্ধ।
কাঁচা বয়সে মোহভঙ্গ।
১৮ বছরে হাতে পেলুম গ্যব্রিয়েল গার্সিয়া মারক্যুইজের "Love in the Time of Cholera".
মারক্যুইজ বললো, প্রেম ৬৫ বছর বয়সেও হয়।
মনে মনে Florentino Ariza আর Fermina Daza র সাথে আমিও ম্যাগডালেনা নদীতে নৌকো ভাসালুম...হলুদ পতাকা তুলে দিয়ে।
যাক বাবা....প্রেম ৬৫তেও হবে।
আরও পড়ুন, ‘মা’ নামে শাঁখ বেজেই চলে
পিঠে ঝোলাব্যাগ নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে যখন দেশে ফিরলুম, শরীরের বয়সটা টিকটিক টিকটিক করে এগোচ্ছে।
মনের মানুষের সন্ধান পাইনি এখনো।
কিন্তু মা হবার স্বপ্ন অস্তিত্ব জুড়ে।
ডাক্তারবন্ধুর মাথার পোকা নাড়িয়ে দিলুম প্রশ্নবাণে। একা মা বা 'single mother' এখন চারিপাশে। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি বেশ নড়বড়ে ইদানিং। কিন্তু একেবারে বিয়ে না করে....পিতৃপরিচয় ছাড়া...সময় লাগলো মনস্থির করতে।
সাহসের অভাব নেই কোনদিন। কিন্তু সে তো শুধু নিজের জন্য।
যাকে পৃথিবীতে আনতে চাই, সেতো সম্পূর্ণ অরক্ষিত। তথাকথিত সমাজের কোনো ভ্রুকুটি, কোনো আক্রমণের হাত থেকে তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব- আমার।
সেই সাহস আছে তো আমার ?
শক্তি ?
পাশে দাঁড়ালেন আমার মা বাবা।
সমাজ তো কোন স্থবির বস্তু নয়। সে প্রতিদিন বদলাচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে। আমরাই তো তাকে বদলাচ্ছি।
IVF বা প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে test tube baby, বড়ো যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতি। ইনজেকশনে শরীর ঝাঁজরি হয়ে যায়, মন তোলপাড়।
একা একা আরো কঠিন। যেদিন প্রথম প্রচেষ্টার miscarriage হলো, একা গাড়ি চালিয়ে গিয়েছিলুম ক্লিনিকে।সেদিনটা ২০১৩র সরস্বতী পূজো। অসম্ভব যন্ত্রণা আর রক্তপাতের মধ্যে খালি নিজেকে বলছিলুম, "কাল সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল নাহয়, আরেকদিন...আমি ঠিক মা হবো।"
আরও পড়ুন, মাতৃত্ব, অবসাদ ও অপরাধবোধে
৩রা মে আমার গর্ভে প্রবেশ করলো ছোট্ট ভ্রুণ।
সাদা একফোঁটা আলো।
প্রাণ। কিন্তু তার লিঙ্গপরিচয় নেই , ধর্ম নেই, জাত নেই, দেশ নেই, ভাষা নেই - অথচ প্রাণ।
গর্ভের ভিতর তিলতিল করে বেড়ে ওঠা স্বপ্ন আমার বাস্তব জুড়ে।
মা হলুম।
২০১৩র ২১শে নভেম্বর।
সে এক নতুন জন্ম আমার।
এখন শুধু একটাই লক্ষ্য। পৃথিবীতে একটা ভালো মানুষ রেখে যেতে চাই।
না। আমাদের পথচলায় আজ অবধি কোনো অন্তরায় আসেনি। আসলে সমাজ তো আমরাই বানাই।
আজ অবধি বলছি কারণ আজ একা মা হিসেবে প্রথম ধাক্কা আমার। দেশের আইন, সমাজের অগ্রগতি সত্ত্বেও পিতৃপরিচয় নেই বলে নিঃশব্দে আমাদের মুখের সামনে এক এক করে শহরের বিভিন্ন অভিজাত স্কুলের দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তবে হোঁচট খেয়েছি শুধু।
হার মানিনি।
উপনিষদে আছে আরেক মায়ের কথা।
জবালা।
আমারই মতোন, একা মা।
তার পুত্র সত্যকাম যখন শিক্ষাগ্রহণের জন্য বাইরে পা রাখছে, তখন মাকে প্রশ্ন করে, "কী পরিচয় দেবো আমার?"
জবালা বলে, "তুমি জবালা সত্যকাম।"
আমার অগ্নিস্নাতও শুধু অনিন্দিতার সন্তান।
সেই পরিচয় নিয়েই আগামীর লড়াই।