অদিতি বসুরায়
জয়া মিত্রের গল্পে পড়েছিলাম যে মায়ের কথা, তিনি হত-দরিদ্র হলেও রাজরাজেশ্বরী। আমার এযাবৎ পড়া, বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মা। তাঁর কথা একটু বলি!
দরিদ্র সেই মাকে সাপে কামড়েছিল। ঘরে তখন ছোট ছোট শিশু তাঁর।বড় মেয়েকে ডেকে মৃত্যুপথযাত্রী মা বলেছিলেন, রান্নাঘরে রাখা ভাতক’টা খেয়ে নিতে। জানাই ছিল, তিনি দ্রুত মারা যাবেন। সময় নেই একেবারেই। তক্ষুনি ছেলেমেয়ে যদি ভাত না খায়, তবে তিনি মারা গেলে ‘মড়া বাড়িতে’ রাখা ভাত আর তাদের কেউ খেতে দেবে না। অভুক্ত থাকবে সন্তান – এই আশঙ্কায় আসন্ন মৃত্যুকেও তুচ্ছ করতে দ্বিধা করেন নি তিনি। এই-ই মা। মায়ের মতো কেউ হয় না আর।
আমার কাছে আমার ‘মা’ এতদিন ছিলেন শ্বাস-প্রশ্বাস । আমি যবে থেকে নিজে ‘মা’ হয়েছি, মা আমার বিশল্যকরণী হয়ে উঠেছেন।
গত জানুয়ারিতে, যেদিন শহরে শৈত্য-প্রবাহের পূর্বাভাস, সেদিন আমি আমার ‘পদ্য’কে পেয়েছি। অপারেশন থিয়েটারে যেই সে কাঁদল, মনে হল যেন শাঁখ বেজে উঠল চরাচরজুড়ে। সেই পৌষী অপরাহ্নে ঈশ্বর যেন হারানো ইনকা রাজ্য থেকে সূর্যমাতাকে পাঠালেন আমাদের কাছে। এতদিন যাকে শরীরের মধ্যে নিয়ে বেড়িয়েছি, সে যখন সামনে এল – বুঝলাম এক মুহুর্তে, এতদিন যত ঘুরে মরেছি, মার খেয়েছি, পথ ভুল করেছি- সব সব মিথ্যে। এই কন্যাই একমাত্র সত্যি। এই ‘সন্তান’মুখই আসলে সেই জীবন, যাকে খুঁজতে খুঁজতে অর্থহীন কেটে যাচ্ছিল আয়ু।
এখন এই বাড়ি ‘পদ্যময়’। সেই থেকে চলছে রাত জাগা। একটানা তিন ঘণ্টা ঘুমাই নি গত তিনমাস। খাই নি এক কাপ গরম চাও। প্রতিবারই চা ঠান্ডা হয়ে গেছে তাকে সামলাতে সামলাতে। সেই সঙ্গে আমার মাও রাত জেগেছেন। মাও বসে থাকেছেন না খেয়ে আমার মেয়ে কোলে।
এখন বাড়ি ভরে আছে ছোট ফ্রক, ঝাপলা, পুতুল,বেবি পাউডার, ফিডিং বটল, দোলনায়। অসম্ভব ভাল-লাগার সঙ্গে হাত -ধরাধরি করে এসেছে ভয়ও যখন ওর বেবিকটে খুঁজে পেয়েছি আয়ার লুকিয়ে রাখা তামাকের প্যাকেট-যখন সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখেছি ওতটুকু বাচ্চার বেবিফুড চুরি করে খাচ্ছে তার আয়ামাসি-খবরের কাগজ খুলে হাড়হিম হয়ে গেছে দেড় মাসের শিশুকে তারিখ পেরিয়ে যাওয়া ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা পড়ে- শিশু আসিফার ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের বিবরণ জেনে-চ্যানেল করতে অক্ষম চিকিৎসকের হাতে পড়ে আট মাসের শিশুর মৃত্যুর খবর পড়ে। খেতে পারি নি সারাদিন। অবশ হয়ে এসেছে হাত-পা।
আজকাল প্রতিটি শিশুই আমাকে মেয়ের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ওকে ছেড়ে, ঘরের বাইরে গেলে বুকের মধ্যে হু হু করতে থাকে। ফিরে এসে আধফোটা ফুলের মতো তার ঘুমন্ত মুখ জড়িয়ে নিয়ে বসে থাকি। আমি জানি, ওরও আমার মতোই মায়ের কাছে থাকতে ইচ্ছে করে সারাক্ষণ। আমি যেমন ছোটবেলায় মা ইস্কুলে গেলে, মায়ের ছেড়ে যাওয়া শাড়ির গন্ধ শুঁকতাম ওরও হয়তো তেমনই হয়। আমি কাঁদলে কোন ম্যাজিকে জানি না, ও কেঁদে ওঠে। ঘুম থেকে উঠে সকালের মতো হাসে। আর সেই কষ্টের কথা লিখতেও পারব না – যে কষ্ট, সে কোনও অজানা কারণে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকলে হয়।
সারাদিন বারবার ওকে দেখি। স্নান করতে করতে বেরিয়ে আসি। কাজ করা হয় না। লেখার টেবিল থেকে উঠে পড়তে হয় বারবার। ইচ্ছে হলেই বেড়িয়ে পরা যায় না আর এখন। মাঝে মাঝেই নিজের ওপর রাগ হয়। নিজের অক্ষমতার ওপর রাগ করি। মনে হয়, আর একটু যত্নে রাখা উচিত আমার শিশুকে। তারপর সন্ধে নেমে আসে ঝপ করে। আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি আমাদের ঘরে এসে কেমন আছ? ভাল আছ তো?”, সে হাসিমুখে উত্তর দেয় কোন এক অচেনা ভাষায়, ‘হঁন’- আমি ঠাহর করতে পারি না কোন সে নক্ষত্রলোক থেকে এসেছে এ মেয়ে আমাদের সৌভাগ্য হয়ে।
ভোররাতে যখন দূর থেকে ভেসে আসে আজানের সুর, আমি মেয়েকে তুলে খাওয়াই। ঘুম পায় – পায়ে ব্যাথা করে- কিন্তু যেই সে ছোট্ট পাদুটি পাখার মতো মেলে দেয় কোলে উঠে -আমি যেন হয়ে উঠি প্রজাপতি। মনে হয়, উড়ে যেতে পারি। মনে হয়, উড়ে যাই। তারপর সে গলা জড়িয়ে ধরে, কাঁধে মাথা রাখে। আমি তখন সত্যি সত্যি উড়ি।