এ কথা আলাদা ক'রে বলবার কোন দরকার নেই যে একশ জনের ভেতর প্রায় একশ জন নারীই জীবনে কখনো না কখনো যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। ঝগড়া বা হাতাহাতি হলেই যারা অন্যকে মা মাসি এক ক'রে দেবার ভয় দেখায় তারা অবচেতনে এই হেনস্থার তৃপ্তি বহন ক'রে নিয়ে চলেছে। পিতৃতান্ত্রিক মগজ ধোলাইয়ের কারণে মেয়েদের প্রকাশ্যে সে হেনস্থার কথা বলা এতোদিন কল্পনারও অতীত ছিল। সমাজ সংসার সম্মান সবই নাকি রসাতলে যেতো লাঞ্ছিতা মুখ খুললে। অনেক মহিলা নিজেরাও এইরকমই ভাবেন। এখনও।
খুবই অন্যরকম আশার কথা এই যে ইদানীংকালে দেখা যাচ্ছে কিছুই রসাতলে যাচ্ছে না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পীড়কের বেশ শাস্তিও হচ্ছে। এই শাস্তি ভয়ংকর দরকারি, কারণ সম্ভাব্য ধর্ষকের মনে সেটি একধরনের ডিটারেন্ট বা নিষেধবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যা এইধরনের অপরাধ ঠেকাতে কার্যকরী।
আমাদের দেশে এইসব অপরাধে কোন শাস্তি প্রায় হয়না বললেই চলে। হলিউডে হার্ভি উইন্সটাইনের মতো প্রবল প্রতাপান্বিত সিনেমাওয়ালা পুরো ফুটে যায়, হুঁকো নাপিত বন্ধ হয়ে যা তা অবস্থা ! অথচ সিরিয়াল মলেস্টার হিসেবে যার দিকে কমসে কম আঠারোটি তর্জনী, সেই M J আকবরের ঘটানো অপরাধের সুরাহা চাইতে গিয়ে কতোদিন ধরে নাজেহাল হতে হচ্ছে অত্যাচারিতাদের। প্রাক্তন বিজেপি মন্ত্রী অর্থবান আকবরবাবুর অপরাধের সম্পূর্ণ ও শীঘ্র সুরতহাল এখনও কেবল স্বপ্ন। কারণ নিরানব্বই জন বাঘা উকিল তাঁর হয়ে মানহানির মামলা লড়ছেন।
আরও পড়ুন, মি টু নিয়ে কী বলছেন সোহিনী সেনগুপ্ত
যায় বৈকি মানসম্মান যায়, তবে তা যায় একতরফা ভাবে, কেবলমাত্র ধর্ষকের। তাও যখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয় কেবলমাত্র তখনই। অন্যদিকে ধর্ষিতার সম্মান নিয়ে ভাবনাচিন্তার রেওয়াজ থাকলে তো ধর্ষণটাই হত না।
ফলে তথাকথিত মানসম্মানের তোয়াক্কা না ক'রে যে মেয়েরা সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ খুলছেন তাঁদের আইনি জয় হবেই এমন নিশ্চয়তা নেই। সেটা তাঁরা জানেন, তবুও অসহ্য অপমানের স্মৃতি, বহু বছর ধরে বয়ে নিয়ে যাওয়া অবচেতনের ভারকে মুহূর্তের বিস্ফারণে পরিবর্তিত করবার জন্য যে সাহসের এবং সততার দরকার তা এই নারীপ্রজন্ম অর্জন করেছে। এটি অত্যন্ত আশাজনক।
এই মেয়েদের বুঝতে কোনো অসুবিধে হ'লে তা এখনই দূর করা বাঞ্ছনীয়, না হলে পুরো আন্দোলনটাই মার খেতে পারে। প্রজন্মান্তরে চিন্তাভাবনা ধ্যানধারণা সবই পালটে যায়। এই সাইবার যুগে তা পালটায় রকেটের গতিতে। একজন অভিনেত্রীর কাছে ন্যুডিটি নাটকের থেকে বড় কোনো ব্যাপার নয়। যতোদূর জানি ডায়াফ্রেমিক ব্রিদিংএ ঊর্ধ্বাঙ্গে কিছু থাকলে ব্যাপারটি ঠিকমতো সংঘটিত হচ্ছে কিনা নিজেরও বোঝার অসুবিধে হয়। সেকারণে ডেমনস্ট্রেশন দেবার সময় ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত পুরুষশরীর ব্যবহার করাই দস্তুর। এখন কোনও শিক্ষানবিশ অভিনেত্রীকে যদি তার শিক্ষক তার আসল অভিপ্রায় গোপন রেখে ফুসফুসের নীচের সমান্তরাল রেখা বরাবর শ্বাস প্রশ্বাসের কেরামতি শেখানোর অছিলায় কোনো আদেশ দেন, তা পালন করা অন্তত অষ্টম আশ্চর্যের শ্রেণিভুক্ত হবে না।
শিক্ষার খাতিরে ঊর্ধ্বাঙ্গের বহিরঙ্গের আবরণ মোচন আর যৌনতার অনুমতি দেওয়া, দুটো এক নয়, এটা বুঝি নিশ্চয়ই আমরা। তাই মেয়েটি এটা কেন করলো, ওটা কেন করেনি, আমরা তো এমন ছিলাম না, ওরা কেন এতো বেপরোয়া ইত্যাকার গজগজানি বন্ধ রেখে অধীত বিদ্যাটির প্রকৃতি ও পদ্ধতি, অতীত ও বর্তমান সময়ের তফাত ও মানসিকতার যোজন দূরত্বকে হিসেবের মধ্যে রাখলে ভালো হয়। সবথেকে বেশি যা মনে থাকা ভালো তা হলো গোটা ব্যাপারটিকেই অছিলা হিসেবে ব্যবহার ক'রে তার অপব্যবহার করা হয়েছে, অভিযোগের আদত শ্বাসমূল কিন্তু এইটেই। মনে রাখা ভালো, এককালে মেয়েরা যখন অবগুণ্ঠনশূন্য অবস্থায় প্রথম মঞ্চে অভিনয় করতে যায় তাদেরকেও এইভাবে কোণঠাসা করবার চেষ্টা চলেছিল। নটি বিনোদিনীর আত্মজীবনীটি একগুচ্ছ মি-টুর জীবন্ত দলিলে ঠাসা। চ্যাটার্জি সাহেব অজিতেশের ঘাড়ে দায় না চাপিয়ে গিরিশ ঘোষের নাম নিলে সঠিক হতো কিনা জানি না।
বোঝার ভুল থাকলে তা সারিয়ে নেওয়াই ভালো। কারণ মলেস্টারের পেছনে এখন ঘরে বাইরে মি টু-র তাড়া। যেভাবে নিজের সন্তান তার বিপক্ষে বিবৃতি দেয়, প্রকাশ্যে পুত্রবধূ যেভাবে নির্যাতিতার পক্ষ নেয়, তা নিঃসন্দেহে এই আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দিন পাল্টাচ্ছে, হাওয়ায় ব্যাপ্ত সমুদ্রের ঘ্রাণ। মি টুতে যোগ দিক অত্যাচারীর মুখবন্ধ রাখা স্ত্রী এবং নির্যাতিত পুরুষেরাও। প্রথমজনেরা এখন কাঠগড়ায়, দ্বিতীয় শ্রেণি নিঃশব্দ। অনেক পুরুষকে সলিডারিটি ব্যক্ত করতে দেখলাম, কাউকে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারের কথা বলে ব্যক্তিটির দিকে আঙুল তুলে প্রতিকার চাইতে দেখলাম না। এও কি পিতৃতন্ত্রের মগজধোলাই ? ছেলেদের কাঁদতে নেই এই ধারণা যার প্রথম সিঁড়ি?
প্রিডেটরের স্ত্রীই সব অনর্থের মূল, সব জেনেও স্ট্যাটাসের লোভে তার এই নৈঃশব্দ অমার্জনীয়, এই কথা অন্তর্জালে ভাসছে। কে জানে একথা সত্য না মিথ্যে। ছেলে বদমাইশ গুন্ডা হলেই সে যেমন পতিতার পুত্র হয়ে যায় সেরকমই আর কী! পাহারা রেখে যদি কেউ ধর্ষণে উদ্যোগী হতে পারে, তাহলে ঘরের মানুষের মুখ বন্ধ রাখার জন্য সে কতদূর যেতে পারে! সম্মানহীন স্ট্যাটাস ধুয়ে জল খেতে চাইবে কে, কে যাবার জায়গা নেই বলে গার্হস্থ্য হিংসা সয়, এইসব বড় গোলমেলে হিসেব। অব্যাখ্যাত মানসিক নির্ভরতা এবং আকর্ষণ যাকে ভালবাসা নামে ডাকার রেওয়াজ, সেও যেমন একটি।
দেরি হলেও তাঁরাও আসুন। একটা সুযোগ তো এসেছে অন্তত শারীরিক মানসিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। যদি পারেন, ঐ অব্যাখ্যাত হিসেবটিসেবগুলো শিকেয় তুলেই আসুন। মি টু মানে তো আমিও, আমরা সবাই।
(প্রতিভা সরকার অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)