Advertisment

'কালো' বনাম 'ফর্সা': সমাজ কি নেবে এই চ্যালেঞ্জ?

বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ঘরে ঘরে দেখা গেল এই ফর্সা হওয়ার ক্রিম। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কতটা চাহিদা ছিল এমন এক পণ্যের।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
fair and lovely issue

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ... গুরুদেব, আপনি কোন ভাবনা থেকে কৃষ্ণকলিকে কবিতায় এঁকেছিলেন, তার বিশ্লেষণ আমার মতো অধমের কর্ম নয়। হতে পারে সে নিছক আপনার কল্পনার এক নারী, আপনার অনির্বচনীয় রোমান্টিসিজমেরই প্রতীক। এক অতুলনীয় প্রেক্ষাপটে তাকে প্রতিষ্ঠা করেন আপনি। এমনটা যে শুধু আপনিই পারেন, সে তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু শুধুই কি এক কাব্যিক কল্পনা? নাকি কোথাও সংগোপনে সেই সামাজিক বার্তাও ছিল! আমাদের সমাজে কালো মেয়ের ভাগ্যে চিরন্তন ভাবেই যে অবজ্ঞা, অবহেলা বর্ষিত হয়, আপনি অনুরাগ ও আদরে তার বিপরীত এক ভাবনা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন সেদিন? আপনার 'কৃষ্ণকলি' অনুভবী রচনার গুনে এভাবেই অপরূপ ও আলোকময়ী হয়ে ওঠে। কোনও একদিন কাব্যপাঠ, আবৃত্তি ও গানে অমর হয়ে যায় সেই কালো মেয়ে।

Advertisment

কিন্তু তারপর? কৃষ্ণকলিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না সমাজের কোথাও। ফর্সা না হওয়ার তীব্র গ্লানি নিয়ে আজও, এই একবিংশতেও বিদ্ধ হতে হয় তাদের। কাব্য, সাহিত্য, প্রবাদ, কিছুই বদলাতে পারে না পরিস্থিতি।

এমন এক প্রেক্ষাপটে কোনও 'ফর্সা হওয়ার' ক্রিম প্রস্তুতকারক যখন তাদের ব্র্যান্ডের নাম থেকে 'ফেয়ার' অর্থাৎ ফর্সা কথাটাই তুলে দেয়, তখন স্থির পুকুরের জলেও ঢেউ ওঠে বৈকি। হিন্দুস্তান ইউনিলিভার তাদের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড 'ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি' থেকে 'ফেয়ার' শব্দটি মুছে দিতে চলেছে।

সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রবল আলোড়ন ফেলে দেয় আমেরিকায় পুলিশি অত্যাচারে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু। পুলিশের অত্যাচারের সেই ভিডিও ফুটেজ ব্যাপক হারে ভাইরাল হয় বিশ্বজুড়ে। নিন্দার ঝড় ওঠে সর্বস্তরে। তারই প্রতিক্রিয়া স্বরূপ হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের এই পদক্ষেপ। কার্যকারণ বা প্রেক্ষিত যেটাই হোক, এই সিদ্ধান্ত যে যুগান্তকারী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশ্ন হলো, আজ থেকে ৪৫ বছর আগে 'ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি'-র যাত্রা শুরু যে সামাজিক পটভূমিতে, তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে আজ?

আরও পড়ুন: বদলে যাওয়া সময়ে মিডিয়া, আজকের সমাজের আয়না

মনে পড়ছে অনেক পুরোনো কথা। কৈশোর থেকে তারুণ্যে পা রেখেছি সবে। বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ঘরে ঘরে দেখা গেল এই ফর্সা হওয়ার ক্রিম। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কতটা চাহিদা ছিল এমন এক পণ্যের। আর এই চাহিদার মূলে যে সেই চিরন্তন কালো-ফর্সার বৈষম্য, তাও সহজেই অনুভূত। বাড়িতে একটি শিশুর জন্ম হলো? যার গায়ের রং কালো? শোকের ছায়া নেমে আসত পরিবারে। ব্যতিক্রমী কিছু পরিবার বাদ দিলে, এটাই ছিল গোটা দেশের চিত্র।

মেয়েদের কথা ছাড়ুন, ছেলেরাও কালো হলে খুব হেরফের হতো না। এ প্রসঙ্গে এক পরিচিতার ভাষ্য, "আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই ফর্সা। আমার ছেলে ওদের গায়ের রং না পাওয়ায় সবাই কী যে আশাহত!" এটা কিন্তু 'ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি' বাজারে আসার দুই দশকেরও পরের ঘটনা। অর্থাৎ, অবস্থা কোথাও বদলায়নি। ছেলেদের  ক্ষেত্রে সাধারণত গায়ের রং কালো হলেই কালু, কেলো, কালি ইত্যাদি নামকরণ অতি চেনা ঘটনা।

প্রসঙ্গত, মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা। কারণ, কেউ কালো মেয়ে ঘরে আনবে না। মা কালো হলে, ছেলেপিলেও নাকি কালো হবে। তাই 'ফর্সা সুন্দরী পাত্রী' চাই সকলের, পাত্র যেমনই হোক। কালো মেয়ের বিয়ে ও পণপ্রথা হাত ধরাধরি করে চলে। মেয়ে কালো হলে বাবাদের অধিক মাত্রায় টাকা পণের জন্য রাখতে হয়। এর সঙ্গেই একটা নতুন সমীকরণ শুরু হয়, চাকুরীরত কন্যা। কালো মেয়ে যদি চাকুরীরত হয়, তবে তার কৃতিত্বে কিছু নম্বর যোগ হলো।

চেতনার উন্মেষ কালেই উঠতে বসতে যে মেয়ে জেনে যায়, সে 'কালো', এক গাঢ় হীনমন্যতা ঘিরে ধরে তাকে। সে যেন হতভাগ্য। নিজেকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে প্রতি পদে বাড়তি লড়াই করতে হয় তাকে এ বাবদ, ঘরে ও বাইরে। এই সমস্ত ভাবনা, প্রথা, রীতি, সবটাই যে মধ্যযুগীয়, তা জানার পরও পরিস্থিতির খুব বদল হয়নি। আক্ষেপ, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজও এ ব্যাপারে কোথাও এতটুকু এগোয়নি, তার প্রমাণ 'ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি'-র পরেও বহু ফর্সা হওয়ার ক্রিম বাজারে এসেছে। এসেছে এবং চলছে।

হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের এই সিদ্ধান্তের অনুসারী হয়েছে আর এক প্রখ্যাত ব্র্যান্ড ল'রিয়াল। তারাও তাদের ত্বক পরিচর্যা ব্র্যান্ডগুলি থেকে 'ফেয়ার', 'লাইট', 'হোয়াইট', এই শব্দগুলি বাদ দেওয়ার কথা জানিয়েছে। বাকিদের ভাবনার জগতে কতটা প্রভাব ফেলবে এই পদক্ষেপ, সে তো সময়ই বলবে। কিন্তু সেই সময় তো এমনি এমনি আসবে না। সমাজ চাইলে তবেই সেই সুসময় আসবে, যখন গায়ের রং নয়, মানুষের বিচার হবে তার মানবিক গুণ, স্বাতন্ত্র, ও নিজস্বতা দিয়ে। ব্যক্তিত্বই হবে একজন নারী ও পুরুষের পরিচয়। আজ, এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে এ ব্যাপারে আমরা সত্যি কতটা উদার? কতখানি সংবেদনশীল ও পরিণতমনস্ক হয়েছি আমরা, সেই প্রশ্ন প্রত্যেকের উচিত নিজের কাছে রাখা।

এ প্রসঙ্গে বলিউড তারকা বিপাশা বসুর বক্তব্য ভাবার মতো, "দু'দশক ইন্ডাস্ট্রিতে আছি। দেখেছি, এখানে লোকজন এখনও ঘুরেফিরে আমার গায়ের রং নিয়ে কথা বলে। ফিল্মি পত্রিকাগুলিতে লেখা হয় 'দ্য ডাস্কি গার্ল ফ্রম কলকাতা'। আমি বহু ফেয়ারনেস ক্রিমে এন্ডোর্সমেন্টের অফার পাই। কিন্তু নীতিগতভাবে কখনও রাজি হইনি। হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাই।" অভিনেত্রী নন্দিতা দাশও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, "নিঃসন্দেহে কালো-ফর্সা, এই জাতীয় বৈষম্যমূলক ভাবনার পরিবর্তনে এটা এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। রাতারাতি নিশ্চয়ই সব বদলে যাবে না। কিন্তু শুরুটা তো হলো! সেটাই যথেষ্ট ইতিবাচক।"

কিছুটা পরের প্রজন্মের মাসাবা গুপ্তা হিন্দুস্তান ইউনিলিভারেরই একটি প্রতিবেদন ছবিসহ শেয়ার করেছেন ইনস্টাগ্রামে, যেখানে বলা হয়েছে, "আমরা এখন থেকে সবার জন্য ত্বক পরিচর্যা ক্রিম প্রস্তুত করব। কালো-ফর্সা বলে নয়। এটা হবে বৈচিত্রের মধ্যে সৌন্দর্যের উদযাপন। এখন থেকে 'ফেয়ারনেস', 'হোয়াইটেনিং', 'লাইটেনিং' এই শব্দগুলো বর্জিত হবে আমাদের ত্বক পরিচর্যা কেন্দ্রিক পণ্যগুলি থেকে।" মাসাবা একজন আন্তর্জাতিক খ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার। তাঁর কথায়, "এটাই হলো প্রগতি।"

বলিউডের একেবারে নব্য প্রজন্ম, শাহরুখ কন্যা সুহানা খানও এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে বলেছেন, "বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী এই পদক্ষেপ বহু দিনের লড়াইয়ের ফল। গায়ের এই কালো-ফর্সা রঙের ব্যাপারটা এদেশে আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। সমাজের অনেক গভীরে এর শিকড়। আমি এই সিদ্ধান্তকে পূর্ণ সমর্থন জানাই।"

নিন্দুকেরা বলছেন, হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের এই সিদ্ধান্ত আসলে তাদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, তাদের পক্ষে নিঃসন্দেহে এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এত বছরের এক সফল ব্র্যান্ডের খোলনলচে বদলানো মুখের কথা নয়। তারা সেটা নিয়েছে। কিন্তু সমাজ কি নেবে সেই চ্যালেঞ্জ? লাখ টাকার এই প্রশ্নের জবাব লুকিয়ে সময়ের গর্ভে। আপাতত সুদিনের অপেক্ষা।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment