রক্তপাতহীন বিপ্লব করেছে পূর্ব জার্মানি, বার্লিন দেওয়াল ভেঙেছে পশ্চিম বার্লিন। পশ্চিম জার্মানি। বার্লিন দেওয়াল ভাঙাভাঙির বুদ্ধি পূর্ব বার্লিনের বাসিন্দার মগজে ঢোকে নি, ৯ থেকে ১১ নভেম্বরে।
পশ্চিম বার্লিনবাসীরাই দেওয়ালের ওপর উঠেছে, লাফিয়ে নেমেছে পূর্ব জার্মানির জমিনে। পূর্ব বার্লিনের নরনারী পূর্ব জার্মান সরকারের পাসপোর্ট নিয়ে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে প্রেন্সলাউয়র বার্গের বোর্নহোলমার স্ট্রাসে চেকপয়েন্টে। রাত বারোটার আগে (৯ নভেম্বর, ১৯৮৯) চেকপয়েন্ট খোলা হয়। খোলে পূর্ব জার্মান পুলিশ। পাসপোর্ট দেখিয়ে অতঃপর পশ্চিম বার্লিনে প্রবেশ। কারোর হাতে কোনো হাতুড়ি, শাবল ছিল না। দেখি নি। দেওয়াল ভাঙা দূর অস্ত। রাত বারোটার পর বার্লিনের আরও চারটি চেকপয়েন্ট উন্মুক্ত। পূর্ব বার্লিনের মাানুষের পশ্চিম বার্লিনে প্রবেশ, পশ্চিম বার্লিনের মানুষেরও পূর্ব বার্লিনে, বিনা পাসপোর্টে।
বার্লিন দেওয়াল ছিল ১৬১ কিলোমিটার। এই ১৬১ কিলোমিটার দেওয়ালে ঘেরা ছিল, তা নয়। নদী ও বনবাদাড় সীমান্ত কাঁটাতারে ঘেরা। অবশ্য পুলিশ পাহারা, টহল, যথারীতি। আধ কিমি দূরে দূরে ওয়াচ টাওয়ার। কে আছে ভেতরে দেখার উপায় নেই।
বার্লিন প্রাচীরে যে গ্রাফিতি, পূর্ব বার্লিন বা পূর্ব জার্মানির একজন 'শিল্পীও' আঁকেনি। অর্থাৎ, দেওয়ালের পূর্ব পিঠে। দেওয়ালের পশ্চিম পিঠে (যা পশ্চিম বার্লিনে) পশ্চিম বার্লিনের বা পশ্চিম জার্মানির বা পশ্চিম ইউরোপের বা অন্য দেশের শিল্পীরা গ্রাফিতি এঁকেছে। যার যা খুশি। রাজনৈতিক বিষয় থেকে নিসর্গপ্রকৃতি, মুখাবয়ব, এমনকি নগ্ন নরনারীর চিত্র। নানা রঙে। ছোট-মাঝারি-বড়। হরেক রকম মন্তব্য, লেখালেখি। কে, কারা এঁকেছে, কারোর নাম উল্লেখিত নয়। আজকের বিখ্যাত দ্রষ্টব্য পটসডামার প্লাত্সের দেওয়ালে দেখেছিলাম, কোনো বাঙালি কালো কালিতে বিরাট অক্ষরে বাংলা ভাষায় লিখেছে, "শালা"।
আরও পড়ুন: বার্লিন দেওয়াল ধ্বসের ৩০ বছর…’শালা’
বার্লিন দেওয়াল পতনের কয়েক বছর আগে পশ্চিম বার্লিনে ঠাঁই নিয়েছি; পশ্চিম বার্লিনের যে কেউ পূর্ব বার্লিনে যাতায়াতের নিষেধাজ্ঞা ছিল না। উল্টো পূর্ব জার্মানির বা পূর্ব বার্লিনের মানুষের। পূর্ব জার্মানির, যাঁদের বয়স ৬৫, বা বেশি, পাসপোর্ট নিয়ে পশ্চিম বার্লিন বা পশ্চিম জার্মানির কোনো শহরে একদিনের জন্য ভ্রামণিক।
আমরা যারা বার্লিন দেওয়াল পতনের প্রত্যক্ষদর্শী, পতনের ইতিহাস এখনো অতীত নয়, পতনের ৩০ বছর 'এই সেদিন' মনে হলেও, দেওয়াল এখনো রয়ে গেছে। ধ্বংস হয়নি পুরোপুরি। এই দেওয়াল রাজনৈতিক, আর্থিক, এবং বৈষম্যমূলক। ঠিক যে, বার্লিনে একটিমাত্র জায়গায়, তাও কয়েক মিটার, 'আসল' দেওয়াল দন্ডিত, ট্যুরিস্টদের জন্য। যেসব এলাকায় বার্লিন দেওয়াল ছিল, রাস্তার মাঝখানে চিহ্নিত 'Mauer' (দেওয়াল) ১৯৬১-৮৯। সব রাস্তায় (strasse) নয় কিন্তু। যেসব রাস্তায় ট্যুরিস্টদের সমাগম। এখনো বার্লিন দেওয়ালের টুকরো বিক্রি হয়, সরকারি ছাপ মারা। ক্রেতা বিদেশী ট্যুরিস্ট। 'দেওয়াল টুকরো' ব্যবসা তলানিতে। ত্রিশ বছরে ব্যবসা উবে গেছে।
বয়স যাদের ৩৫-৩৬, বার্লিন দেওয়ালের স্মৃতি নেই। বয়স যাদের ৩০, জানেও না বার্লিন দেওয়াল কী ও কেন। স্কুুুুলের পাঠ্যপুস্তকে আছে বটে (পূর্ব জার্মান সরকার তথা পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট দুঃশাসনের কুকথা। সেই তুুলনায় হিটলার, নাৎজি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কম আখ্যান, ইতিহাস)। এই প্রজন্ম বার্লিন দেওয়াল, পূর্ব-পশ্চিম বার্লিন নিয়ে মাথা খামচায় না। উৎসাহও নেই। সমস্যা আজকের জার্মানি নিয়েই। বেকারত্ব বাড়ছে। বাসস্থানের অভাব। তরুণ-তরুণী বিদেশমুখী। রাজনীতি বিমুখ। সুযোগ নিয়েছে এবং নিচ্ছে দক্ষিণপন্থীরা।
আমরা দেখছি সাঁই সাঁই বাড়ছে দক্ষিণপন্থী সমর্থক। কে ভেবেছিল বার্লিন দেওয়াল পতনে, দুই জার্মানির একত্রীকরণে (৩ অক্টোবর, ১৯৯১) সমস্যা আরও ঘনীভূত হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে জার্মানি চক্ষুশূল। দুুুই জার্মানি এক হয়ে, ইউরোপের পয়লা মাতব্বর। বড় দেশে পরিণত, অর্থনীতিতে মাস্তান, রাজনীতিতেও একচ্ছত্র, অঙ্গুলি হেলন, নির্দেশ, কথায় কথায় এদেশ-ওদেশকে (ইউরোপীয় ইউনিয়নের) উঠবোস, বেশি বাড়াবাড়ি করলে 'খবর আছে'। যদিও বলে, 'গণতান্ত্রিক সমতায় আমরা অভিন্ন।' এই অভিন্নতায় কত ফারাক, পোল্যান্ডের মাঝেমাঝে চিৎকার, আখেরে নতজানু।
আরও পড়ুন: বার্লিনের ‘ঘরোয়া’ পুজোর গরিমা আলাদা
গত তিরিশ বছরে জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নে তো বটেই, বিশ্ব রাজনীতিতে রীতিমতন ফ্যাক্টর। ইউরোপীয় ইউনিয়নে জার্মানি সবচেয়ে ধনী দেশ, বিশ্বে চার নম্বর। কিন্তু নিজের দেশের রাজনীতিতে নাজেহাল, গত এক দশকের হালচিত্র দেখুন।
জার্মানির বড় দুটি রাজনৈতিক দল সিডিইউ (ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন) এবং এসপিডি (সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি) ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, জনগণ ভোটে মেজরিটি দিচ্ছে না, সরকার গঠনে কোয়ালিশন করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে, ছোট দলগুলির শক্তি সঞ্চয়। মাথা চাড়া দিয়েছে চরম দক্ষিণপন্থী দল আএফডে (অলটার্নেটিভ ফুর ডয়েচল্যান্ড)।
রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনে আএফডে-র জয়জয়কার। রাজ্য সংসদে আসীন। সাম্প্রতিক উদাহরণ মারাত্মক। থ্যুরিঙ্গেন রাজ্য নির্বাচনে দ্বিতীয় দল। এও বাহ্য। সেন্ট্রাল পার্লামেন্টেও বহু সাংসদ নিয়ে আসীন। অন্যতম বিরোধী দল। 'ছায়া ঘনাইছে বনে বনে, গগনে গগনে ডাকে দেয়া।'
বার্লিন দেওয়ালের পতন নিয়ে যতই জার্মান সরকার 'ফ্রাইহাইট, ফ্রাইহাইট' (Freiheit, স্বাধীনতা, সরকারের তথ্যপ্রচার মন্ত্রণালয় একটি বিশাল রঙিন পোস্টার দেওয়ালে-দেওয়ালে টাঙিয়েছে, পোস্টারে এক নগ্ন নারীর ছবি, লেখা আছে "স্বাধীনতা") চিৎকার করুক, একবার খ্যামটা নাচতে শুরু করলে মুখোশ ক্রমশ উন্মোচিত হবেই।
বার্লিনের দেওয়াল ধ্বসে আমরা ভেবেছিলুম কমিউনিজম গোল্লায় গেছে (সোভিয়েত রাশিয়া সহ পূর্ব ইউরোপে এবং অন্য কমিউনিস্ট দেশে)। ধনতন্ত্রী এবং সাম্রাজ্যবাদীরা বগল বাজাচ্ছিল, ধনতন্ত্রের প্রহারে সব দেশ চাঙ্গা হবে, নানা ফর্মুলাও প্রচারিত, কিন্তু বাস্তবে ভিন্ন দৃশ্য। দেশে-দেশে যুদ্ধ বাঁধিয়েও ফায়দা লুটতে পারছে না আমেরিকা এবং ধনতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক দেশগুলি। সমস্যা নিজেদের মধ্যেই। ব্যাপক সমস্যায় নিজেরাই জর্জরিত। এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার দরকার নেই। অনেকের জানা।
বার্লিন দেওয়াল পতনে, দুই জার্মানির তড়িঘড়ি একত্রীকরণে, সরকারি আস্ফালন, "কমিউনিজম নিপাত"। কী দেখছি আমরা এখন? জার্মানিতেই কমিউনিজমের ঢেউ, থ্যুরিঙ্গেন রাজ্যে গত নির্বাচনে এবং এবারের নির্বাচনেও জয়ী। সরকার গঠন করেছে, এবারেও করছে।
বার্লিন দেওয়াল পতনের পরেও, গত ৩০ বছরে পূর্ব জার্মানিতে কোনও বড় শিল্পকারখানা তৈরি হয় নি। সরকার এবং কোনও বড় কারখানাও আগ্রহী নয়। পূর্ব জার্মানরা বলছে, "বার্লিন দেওয়াল ধ্বসে কী লাভ হলো আমাদের? আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই, কমিউনিস্টরা অন্তত খাবার, বাসস্থান দিত, এখন খাবার, বাসস্থানের জন্য হাহাকার। তখন কি আমরা খুব খারাপ ছিলাম আজকের তুলনায়? বার্লিন দেওয়াল ধ্বস, কমিউনিজমের পতনে আমরা কি পেয়েছি 'ফ্রাইহাইট'?"
দুই জার্মানির একত্রীকরণের পরেই সরকার ঘোষণা করে, 'পূর্ব জার্মানিকে গা-গতর চেহারায় পশ্চিম জার্মানির মতো খুবসুরত করতে হবে। অতএব পশ্চিম জার্মানির লোকজন আর্থিক সাহায্য করবে।' অর্থাৎ, পশ্চিম জার্মানরা 'সলিডারিটি অর্থ' দেবে। চাকরি বা ব্যবসার ইনকাম থেকে কাটা হবে। দুই থেকে দশ/পনেরো/কুড়ি/পঁচিশ পারসেন্ট। পাঁচ বছর পরে সুদে আসলে ফেরত দেওয়া হবে। যারা বেকার, সোশ্যাল ডিপার্টমেন্টের অর্থে জীবনযাপন, তারা বাদ। দিতে হবে না। তবে পেনশনপ্রাপ্তকে দিতে হবে। দেবে না পূর্ব জার্মানির কেউ। ভ্রাতৃ মহব্বতে আমরা উদ্বেল হলুম। পূর্ব জার্মানিকে পশ্চিম জার্মানির সমতায় আনতেই হবে।
১৯৯১ সাল থেকে সরকারের একই কথা, সলিডারিটি অর্থ (গেল্ড) আগামী বাজেটের পরেই ফেরত দেবে। আসল ও সুদ সহ। জনগণ হাল ছেড়ে দিয়েছে, সরকারের "গীত" কেউ বিশ্বাস করে না আর।
২০১৫ সাল থেকে আবার উটকো ঝামেলা, দেড় মিলিয়ন উদ্বাস্তুর প্রবেশ সিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ফলে, জনগণের ট্যাক্স বেড়েছে। বাসস্থানের অভাব। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম পাঁচগুণ বেশি। বিদ্যুৎ-জল-গ্যাস, যানবাহনের ভাড়া তিনগুণ।
ধরা যাক, পশ্চিম জার্মানির একজন কর্মী যে কাজ করেন, কাজ বাবদ ১০০ ইউরো বেতন, একই কাজে পূর্ব জার্মানির কর্মীর বেতন ৮০ ইউরো। অর্থাৎ ২০ ভাগ কম। অবশ্য এই বৈষম্যে মারপ্যাঁচ আছে। পূর্ব জার্মানিতে জিনিসের দাম কুড়ি পারসেন্ট কম, পশ্চিম জার্মানির তুলনায়। কিন্তু পূর্বের মানুষ যখন পশ্চিমে আসে, হামেশাই আসে, নিত্যদিনই আসে, যানবাহনের ভাড়া, কেনাকাটির দাম 'পূর্ব জার্মানির' বলে ২০ পারসেন্ট কম নেয় না। বিদেশ ভ্রমণে প্লেনের টিকিটের দামেও ছাড় নেই।
দুই জার্মানির একত্রীকরণের পরে, বিশেষভাবে লক্ষণীয়, পূর্ব জার্মানি থেকে মাত্র দুইজনকে সেন্ট্রাল মন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়, তাও বহু সমালোচনার পরে। পরে বাদ। পূর্ব জার্মানি যে এখনও ধর্তব্য নয়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাছাইয়ে প্রমাণ। সব মন্ত্রীই পশ্চিম জার্মানির। পশ্চিম জার্মানির বাসিন্দা। চান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেলও পশ্চিম জার্মানির (হামবুর্গের)। পিতার দৌলতে পূর্ব জার্মানিতে বাস, পিতা ছিলেন ধর্মযাজক। যাজকতার পরে অবসর। পূর্ব জার্মানিতে থাকতে বাধ্য হন।
আমরা জানি, ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেওয়াল ধ্বস, কিন্তু ধ্বস আগেই। পূর্ব জার্মানির শতাধিক মানুষ (অধিকাংশই যুবক-যুবতী) হাঙ্গেরি ভ্রমণে গিয়ে, নিশ্চয় পূর্ব-পরিকল্পিত, ২০ অগাস্ট ১৯৮৯-এ, কাঁটাতার ছিন্ন করে, হাঙ্গেরির সীমান্ত অতিক্রম করে, অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ। মহা দোটানায় অস্ট্রিয়ান সরকার। ছুটে যান তৎকালীন পশ্চিম জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রী হানস-ডিট্রিখ গেনশার অস্ট্রিয়ান সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন পূর্ব জার্মানি ত্যাগীদের আশ্রয়ের জন্য, এবং নিয়ে আসেন পশ্চিম জার্মানি। এই খবর পশ্চিম জার্মানির মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারিত। পূর্ব জার্মানিতেও ছড়ায়। পূর্ব জার্মান জনগণ উদ্দীপ্ত হয়। বিপ্লব, সংগ্রামে মরিয়া। পূর্ব জার্মান সরকার বাধ্য হয় চেকপয়েন্টগুলো খুলতে, পূর্ব জার্মান সরকারের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর গুন্টার সাভোস্কির চিরকুটের অসমাপ্ত বয়ান পঠনে। ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ সালে। সন্ধ্যায়। অতঃপর বার্লিন দেওয়াল পতন।