এতদিন মানুষের ওপর নজরদারি চলছিলই। এবার শুরু হল গাড়ির ওপর নজরদারি। যার পোশাকি নাম ফাস্টট্যাগ। অনেকেই ভাবতে পারেন এ আবার নতুন কী, আমরা তো নজরদারির আওতাতেই আছি। হেলমেট না পরে শহরের রাস্তায় কোনও সিগন্যাল পেরোলে বা নির্দিষ্ট গতির চেয়ে বেশি জোরে গাড়ি চালালে তো এমনিতেই মেসেজ আসে। তাহলে ফাস্টট্যাগ নতুন কী?
আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী সমস্ত বিষয়ে একটাই শ্লোগান দিয়ে থাকেন। এক দেশ এক কর শ্লোগান দিয়ে শুরু করেছিলেন জিএসটি। এক দেশ এক আইন – তাই হিন্দু মুসলমান উভয় ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ ফৌজদারি আইন হলেও, উনি মুসলমানদের জন্য একে ফৌজদারি অপরাধ বানিয়ে দিলেন। কিন্তু বিষয়টিকে এনে ফেললেন এক দেশ এক আইন- এর আওতায়। সেই ধারা অনুসরণ করেই কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ দফতর চালু করে ফেলল ‘এক দেশ এক ফাস্টট্যাগ’।
কথা ছিল ১ লা ডিসেম্বর ২০১৯ সাল থেকে যে কোনও গাড়ি কোনও টোল প্লাজা পেরোনোর সময়ে সেই গাড়িতে লাগানো একটি ইলেক্ট্রনিক স্টিকার যার পোশাকি নাম ফাস্টট্যাগ সেটার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়া ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে সরাসরি টোল ট্যাক্স দেওয়া যাবে। এটি বাধ্যতামূলক ভাবে চালু হবার কথা ছিল ১লা ডিসেম্বর, কিন্তু যেহেতু প্রস্তুতি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, এবং সবাই এখনও গাড়িতে এই স্টিকার লাগিয়ে উঠতে পারেননি, তাই আগামী ১৫ই ডিসেম্বর থেকে এটি চালু হবে। সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের নির্দেশে দেশের সব টোল প্লাজায় এই ব্যবস্থা চালু হবে। এখনও বহু গাড়িতে ওই ট্যাগ নেই, তাই এই নিয়ম বাধ্যতামূলক হলেও টোল প্লাজ়ায় অন্তত কিছু দিন ফাস্টট্যাগের সঙ্গে নগদে টোল দেওয়ার সুবিধাও চালু থাকবে। এ জন্য প্রতি দিকে একটি লেন নির্দিষ্ট থাকবে। টোল প্লাজ়ায় নগদের গেট দিয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট গাড়ি মালিক নগদেই নির্ধারিত টোল দেবেন। কিন্তু ট্যাগহীন গাড়ি যদি ফাস্টট্যাগের গেটে ঢুকে পড়ে, তখন দ্বিগুণ টোল দিতে হবে।
কী লাগবে এই ফাস্টট্যাগের জন্য ?
ব্যাঙ্কের কাছ থেকে পাওয়া ফাস্টট্যাগের আবেদনপত্র ভর্তি করতে হবে।
গাড়ি রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট যেখানে গাড়ির সমস্ত তথ্য লেখা থাকে।
গাড়ির মালিকের পাসপোর্ট সাইজ ছবি।
ড্রাইভিং লাইসেন্স।
গাড়ির ধরনের (যাত্রিবাহী অথবা বাণিজ্যিক) সঙ্গে মিলিয়ে জমা দিতে হবে কেওয়াইসি নথিও।
এবার আসা যাক অসুবিধার দিকগুলোতে।
যখন অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট টালমাটাল তখন এই ধরনের একটি পরীক্ষা চালু করলে যে মাল পরিবহণকারী গাড়ির চালক আছেন তাঁরা যথেষ্ট অসুবিধায় পড়বেন। সবাই একরকম পরিমাণে এই ডিজিট্যাল পরিষেবা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, সবাই এটিএম,পেটিএম এই জাতীয় ই-ওয়ালেট সম্বন্ধে কি সড়গড়? তাহলে এই জোর করে এই ডিজিট্যাল পরিষেবায় ঢুকিয়ে দেওয়ার কারণ কি? তাহলে কি সরকার চাইছেন এই ব্যবসাবাণিজ্য আরও খারাপ হোক? কিন্তু তা কি কখনও একটা সরকার চাইতে পারে? তাহলে কিসের জন্য এটা হচ্ছে?
সরকার আসলে চায় না, টোল প্লাজাগুলোতে কোনও কর্মচারী নিযুক্ত থাকুক, তাদের কাছে প্রতিটি শ্রমিকই উদ্বৃত্ত। সারা দেশে এখনও অবধি প্রায় ৫৬০টি টোল প্লাজা আছে। তাতে গড়ে যদি ২০ জন মানুষও কাজ করেন তাহলে এই প্রত্যেকটি মানুষ কাজ হারাবেন, সঙ্গে তাঁদের পরিবারও বিপদে পড়বে।
যাঁরা সবসময়ে হাইওয়ে দিয়ে চলাফেরা করেন না, কখনওসখনও যাতায়াত করেন, তাঁদের কেন বাধ্য করা হবে এই স্টিকার লাগাতে? যারা প্রায়শই এই রাস্তায় চলাফেরা করেন তাঁদের অভিজ্ঞতা কিন্তু খুব সুখকর নয়। বলা হচ্ছে যে গাড়ি না থামিয়েই চলে যাওয়া যাবে এটা সম্পূর্ণভাবে সত্যি নয়। টোলপ্লাজার যে সামনের বাধা থাকে যা থেকে নাকি এটা দূর থেকে ফাস্ট্যাগ স্টিকার লাগানো গাড়ি চিনতে পারবে, তা বেশিরভাগ সময়েই কাজ করে না। এর ফলে প্রায় প্রত্যেকটি টোলপ্লাজার সামনে দীর্ঘ গাড়ির লাইন পড়ে যায়।
এর পাশাপাশি আরও একটা কথা বলা প্রয়োজনীয়। একটি গাড়ি আগে যেভাবে টোল জমা দিত তখন যে নথি সেই গাড়িটি পেত সেটা দেখিয়ে সামনের আরও কয়েকটি টোল অতিক্রম করা যেত, এখন কিন্তু দ্বিতীয়বার অতিক্রম করলেই সেটি রিটার্ন বা ফেরা হিসেবে গণ্য করা হবে।
এবার আসা যাক সবচেয়ে জরুরি বিষয় মানে নজরদারির বিষয়ে। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং টোলপ্লাজা ছাড়াও এই ফাস্টট্যাগ স্টিকার পাওয়া যাবে অ্যামাজন এবং পেটিএমের মতো সংস্থার থেকে, এবং সেখানে প্রতিটি গাড়ির সমস্ত তথ্য চলে যাবে। কোন গাড়ি কোথায় যাচ্ছে কাকে তুলছে সমস্ত কিছুই একটা কেন্দ্রীভূত তথ্যভাণ্ডারে চলে যাবে। কোনও একজন মানুষ পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বসে ভারতের যে কোনও জায়গায় কী গাড়ি চলছে হাতের তালুর মতো দেখতে পাবে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িও তো নানা সময়ে বিভিন্ন টোল অতিক্রম করে, সেই তথ্য অন্য কারো হাতে চলে গেলে কি ভারতের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা থাকে না? ভারতের মতো দেশ যেখানে একটু শহরাঞ্চলের বাইরে গেলেই মোবাইলের নেটওয়ার্ক থাকে না, সেখানে এই ধরনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে উল্টে ভারতের সুরক্ষাকেই বিপদে ফেলে দেওয়া হয় না কি?
ধরা যাক কোনও দেশের সঙ্গে যুদ্ধ লেগেছে, ভারতের কোন টোলপ্লাজা দিয়ে ভারতের কোন সেনাবাহিনীর গাড়ি চলেছে এটা অন্য দেশের একটি বড় কম্পিউটারের সামনে বসে যদি জানা যায়, যদি দেখা যায় ওই গাড়িগুলোকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে, তাহলে কি প্রতিপক্ষ দেশ সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবে? এখানেও সেই কথাটি বলেই লেখাটা শেষ করা যাক, আসলে প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি গাড়িকে নজরদারিতে রাখাটাই উদ্দেশ্য, পিছনে যতই ডিজিটাইজেশনের কথা বলা হোক না কেন!
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কিছুদিন আগে বলেছিলেন, যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ফেরানোর জন্য আর্থিক নিয়ম করলেই হবে না, ফিরিয়ে আনতে হবে পারস্পরিক বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে, এই সরকার তাহলে কি টোলপ্লাজায় জমা টাকা পাচ্ছেন না, নাকি গাড়িরা টোলট্যাক্স দেন না, কিন্তু অভিজ্ঞতা তো তা বলে না, তাহলে আবারও সেই দুর্নীতি ঠেকাতে সবাইকে দুর্নীতিগ্রস্ত বানিয়ে দেওয়ার এই পদ্ধতি কি সেই বিশ্বাসের বাতাবরণ ফিরিয়ে আনে না আরও নষ্ট করে?
(সুমন সেনগুপ্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার ও সমাজকর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)