Advertisment

ওষুধ নিষেধ

কলেজে বা ফেসবুকে জনপ্রিয় হবার জন্য যেমন কেউকেউ বিচিত্র আচরণ করে "অন্যদের থেকে আলাদা" হতে চেষ্টা করেন, ওষুধ বিক্রেতা কোম্পানির দলও তেমনি বিচিত্র কিছু কম্বিনেশন তৈরি করে নিজেদের স্বতন্ত্র গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাজার ধরার চেষ্টা করেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
medicines-l

৩২৮টি ওষুধের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার

প্রয়োগে যা মহৌষধি, অপপ্রয়োগে তাই বিষ। চিকিৎসা করার সময় এই কথাটা চিকিৎসকদের মনে রাখতে হয়। অবশ্য একা চিকিৎসক মনে রাখলে সমস্যা মেটে না। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখন আর চিকিৎসক রোগী অনুসারে নিজের আন্দাজমতো ওষুধ প্রস্তুত করে দেন না। ওষুধ তৈরি হয় কারখানায়, তৈরি হয় ঢালাও এবং ছাঁচে ফেলে, তৈরি করেন রোগীর সঙ্গে সম্পর্কহীন বিভিন্ন সংস্থা। চিকিৎসক সেসব ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন কেবল। সবক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শেরও প্রয়োজন হয় না। Over the counter (OTC) ওষুধ রোগী নিজের ইচ্ছামত কিনে খেতে পারেন, যদিও বাস্তবে আমাদের দেশে শহুরে শিক্ষিত কিছু রোগীর কথা বাদ দিলে এই ক্রয়বিক্রয়ে সাধারণত দোকানদারের ইচ্ছাই প্রতিফলিত হয়। একদিনের সর্দিজ্বরে প্যারাসিটামলের সাথে অ্যান্টিবায়োটিকের অসম্পূর্ণ কোর্স গছানো থেকে শুরু করে থ্যালাসেমিয়া রোগীকে মাসের পর মাস আয়রন টনিক খাওয়ানো অব্দি অনেক কিছুই তাঁরা করে থাকেন বাণিজ্যিক স্বার্থে। ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিও প্রায়শ গুণমান নিয়ে চিন্তিত নয়। সুতরাং বিভিন্ন সংস্থার তৈরি একই ওষুধে সমান ফল হবার নিশ্চয়তা নেই। শুধু তাই নয়, কলেজে বা ফেসবুকে জনপ্রিয় হবার জন্য যেমন কেউকেউ বিচিত্র আচরণ করে "অন্যদের থেকে আলাদা" হতে চেষ্টা করেন, ওষুধ বিক্রেতা কোম্পানির দলও তেমনি বিচিত্র কিছু কম্বিনেশন তৈরি করে নিজেদের স্বতন্ত্র গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাজার ধরার চেষ্টা করেন। এসব কম্বিনেশনের মধ্যে কয়েকটি সুবিধাজনক, কয়েকটি অবৈজ্ঞানিক, আর কয়েকটি বস্তুত ক্ষতিকারক। রোগীর পক্ষে এসব খুঁটিনাটি জানা প্রায় অসম্ভব। তিনটের বদলে একটা বড়ি খেতে হলে ভালো লাগাই স্বাভাবিক। এমনকি চিকিৎসকেরাও কিছু ক্ষেত্রে কম্বিনেশনের জটিলতা না বুঝে তা ব্যবহার করে ফেলেন রোগীর "পিল বার্ডেন" কমানোর জন্য অথবা কম্বিনেশনটিকে বেশি কার্যকর ধরে নিয়ে।

Advertisment

সরকারের, অতএব, দায়িত্ব থেকেই যায় ওষুধের বাজারটিকে নিয়ন্ত্রণ করার। এই নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শমতো হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে সরকার শুধুমাত্র চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে চলতে পারেন না, রাজনীতি এবং অর্থনীতির শর্তাবলি মেনে চলার দায় থাকে। উপরন্তু সরকার কোনো অপৌরুষেয় সত্তা নন, কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সমন্বয়। সুতরাং সরকারের চোখেও স্বজন-দুর্জন-অভাজন ভেদ আছে, যা বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থার কাজের মূল্যায়নে প্রভাব ফেলে। সবকিছুর সংশ্লেষেই নির্মিত হয় সরকারি সিদ্ধান্ত, তা সে ওষুধের অনুমোদন হোক বা ওষুধ বাতিলের নির্দেশ।

ওষুধ প্রয়োগের সময় কিছু মৌলিক বিষয় খেয়াল রাখা দরকার।
১) ওষুধটি শরীরে প্রবেশ করে কী কাজ করে? এর নাম "ফার্মাকোডায়নামিক্স"।

২) কোন রাসায়নিক পদ্ধতিতে ওষুধটি এই কাজ করে?

৩) শরীর ওষুধটিকে নিয়ে কী করে? ফার্মাকোকাইনেটিক্স। এর আওতায় অনেক কিছু। ওষুধটি অন্ত্র, ফুসফুস, চামড়া, ইত্যাদির কোন জায়গা থেকে কতটা পরিমাণে শরীরে প্রবেশ করে? অ্যাসিড বা খাবারের উপস্থিতিতে তার কোনো পরিবর্তন হয় কিনা? কতক্ষণের মধ্যে রক্তে তার কতটা পরিমাণ দাঁড়ায়? কতক্ষণ প্রয়োজনীয় মাত্রা বজায় থাকে? বৃক্ক, যকৃত, ফুসফুস, ইত্যাদি পথে কতটা রেচন হয়? শরীরে তার কী রাসায়নিক পরিবর্তন (metabolism) হয়? এই মেটাবলিক প্রক্রিয়ায় যে নতুন অণুগুলি তৈরি হয়, তা সক্রিয়, নিষ্ক্রিয় না বিষাক্ত? এরকম অনেক কিছুর ভিত্তিতে ওষুধটির প্রয়োগপদ্ধতি (গিলে খাওয়া, চিবিয়ে খাওয়া, ইনহেলার হিসেবে শ্বাসের সঙ্গে নেওয়া, ত্বকে লাগানো, মাসল, চামড়া বা শিরায় ইঞ্জেকশন দেওয়া, ইত্যাদি), ডোজ (রোগের তীব্রতা বা রোগীর ওজন অনুসারে কী পরিমাণ এবং কতক্ষণ অন্তর দিতে হবে) প্রভৃতি নির্ধারিত হয়।

৪) ওষুধটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী কী?

৫) বিভিন্ন ওষুধ একসাথে প্রয়োগ করলে তারা পরস্পরকে সাহায্য করে নাকি মারামারি করে একজন আরেকজনকে হীনবল করে, পরস্পরের বিপরীত কাজ করে কিনা বা সম্মিলিতভাবে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় কিনা, তা ভাবতে হয়। "Drug interaction" নামক এই বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন অ্যান্টাসিড বা ক্যালসিয়ামের সঙ্গে আয়রন খেলে লোহা শরীরে কম প্রবেশ করে। রিফামপিসিন (ক্ষার) বা কার্বামাজেপিন (স্নায়ুরোগের) জাতীয় অনেক ওষুধ যকৃতের P450 গোষ্ঠীর উৎসেচকের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে শরীরে অন্য অনেক ওষুধের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যার ফলে সেগুলো কাজ করে না। আবার ফ্লুয়োক্সেটিন (অবসাদের) থেকে ওমেপ্রাজোল (অম্বলের) পর্যন্ত অনেক নিত্যব্যবহৃত ওষুধ এর উল্টো কাজ করে। বিপরীত কাজটি করলেই যে অন্য ওষুধের কার্যকরিতা বাড়বে, তাও নয়। যেসব ওষুধ লিভারে বিক্রিয়ার মাধ্যমেই সক্রিয় হয়, তাদের ক্ষমতা হ্রাস পাবে। যেমন ওমেপ্রাজোলের সঙ্গে ক্লোপিডোগ্রেল খেলে অণুচক্রিকার ওপর তার ক্রিয়া কমে যায়।

ওষুধ তৈরি করার সময় আরো কিছু ভাবনা থাকে। যেমন ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, সিরাপ, মিক্সচার, ইঞ্জেকশন, ইনহেলার অথবা চামড়ার ক্ষেত্রে ক্রিম, অয়েন্টমেন্ট, জেল, স্প্রে, প্যাচ, ইত্যাদি কোন চেহারায় ওষুধটি কার্যকর? কতদিন অব্দি কার্যকারিতা বজায় থাকবে? Preservative বা adjuvant (অনুপান) হিসেবে কী ব্যবহার করতে হবে? কতটা সূক্ষভাবে পেষাই করে কতটা চাপে তাদের ট্যাবলেট বানাতে হবে? ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট থেকে কতকক্ষণ ধরে কী হারে ওষুধ ক্ষরণ হলে ভালো হয়, অর্থাৎ immediate release, delayed release, controlled/sustained/extended release ইত্যাদি বিভিন্ন কারিগরির মধ্যে কোনটা ব্যবহার করতে হবে? ভেঙে অর্ধেক করার পর ওষুধটি আর আগের মতো কার্যকর থাকে কি? প্যাকেজিং কেমন হলে ওষুধটি দীর্ঘদিন ভালো থাকবে? এরকম হাজার খুঁটিনাটি ভেবেচিন্তে ওষুধ বানানোর কাজটি সহজ নয়।

ওষুধের কম্বিনেশন বানানোর ব্যাপারটি আরো একধাপ জটিল। দুটো বা তিনটে ওষুধকে একসাথে মিশিয়ে রাখলে তারা নিজেদের মধ্যে ভাবভালবাসা বা ঝগড়া করবে না তো? দুটোই বিপজ্জনক হতে পারে। দুটো ওষুধকে কি একই অনুপানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা সম্ভব? একই ট্যাবলেটে কি তাদের অন্তর্ভুক্তি সম্ভব, নাকি একটি ক্যাপসুলে দুটো আলাদা ট্যাবলেট ভরে দেওয়া হবে দুই ভাইয়ের মতো? এই দুটি ওষুধ একসঙ্গে প্রয়োগ করার আদৌ কি কোনো যুক্তি আছে? করলেও একসঙ্গে সেগুলো শরীরে যাওয়া উচিত নাকি কিছু সময়ের ব্যবধানে? দুটো ওষুধ কি একই জায়গা থেকে একভাবে শরীরে প্রবেশ করে? নাকি কম্বিনেশনের একটি ওষুধ কম মাত্রায় রক্তে মিশবে? এই দুটি বা তিনটি ওষুধ কি সর্বদা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যুক্তিযুক্ত? এরকম শত প্রশ্ন।

পাঠকের সুবিধার্থে খুব বেশি সরল করে বললাম। বাস্তবে প্রশ্নগুলি আরো জটিল এবং তার উত্তর খুঁজে পাওয়া সর্বদা সহজ নয়। ওষুধ বা তার কম্বিনেশন তৈরির সময় এসব জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানো হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব। পাশাপাশি নৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিকগুলো দেখতে হয়। কম্বিনেশনের ছুতোয় একটি প্রয়োজনীয় ওষুধের সঙ্গে আরেকটি অপ্রয়োজনীয় ওষুধ গছিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিনা, অকারণে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কিনা বা বাজার দখলের জন্য অন্য কোনো অন্যায় সুবিধা নেওয়া হচ্ছে কিনা। এসব বিষয়ে সংশয় থাকলে সরকার প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিকে প্রশ্ন করতেই পারেন এবং কিছু ক্ষেত্রে যুক্তিযুক্তভাবে কিছু ওষুধ বা কম্বিনেশন বিক্রিতে আপত্তি জানাতে পারেন, এমনকি নিষেধাজ্ঞাও জারি করতে পারেন। যেকোনো নিষেধাজ্ঞাকেই অগণতান্ত্রিক বলে দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয় এবং অন্যায্য মূল্যে ভুল ওষুধ বিক্রি করা কারো গণতান্ত্রিক অধিকার হতে পারে না। আবার ঔষধ বিষয়ক সরকারি নিষেধাজ্ঞা মাত্রেই বিজ্ঞানসম্মত বা সদুদ্দেশ্য প্রসূত, তা ধরে নেওয়াও অতি-আস্তিকতার পর্যায়ে পড়বে।

বিজ্ঞানসম্মত কম্বিনেশন ওষুধের কিছু সুবিধা আছে। যেমন, কম সংখ্যক বড়ি খেতে হয় বলে রোগীর মানসিক চাপ কম হয়। চারটি ওষুধের মধ্যে একটি খাবার কথা ভুলে যাবার সম্ভাবনা কম থাকে। চারটি ওষুধের পৃথক প্রস্তুতি, প্যাকেজিং, বিতরণ ও বিক্রয়ের খরচা কমে বিক্রয়মূল্য কম হবার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া কিছু কম্বিনেশন বৈজ্ঞানিক দিক থেকেই বেশি ভালো। যেমন অ্যামক্সিসিলিন ও ক্ল্যাভুলিনিক অ্যাসিডের কম্বিনেশনের জীবাণুনাশক ক্ষমতা অ্যামক্সিসিলিনের চেয়ে বেশি এবং এই অধিকতর সক্রিয়তার নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে।

উল্টোদিকে অনেক কম্বিনেশন আছে, যা বৈজ্ঞানিকমতে অর্থহীন অথবা সমস্যাজনক। সমস্যা অনেকরকম হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ কয়েকধরণের সমস্যার উল্লেখ করা যাক।

১) কোন ওষুধ খালি পেটে খেতে হয়, আবার কোনোটি খাবার পর খেতে হয়। এরকম দুটি ওষুধ মিলিয়ে দিলে তা কখন খাওয়া উচিত হবে?

২) কোনো ওষুধ দিনে দুবার খেতে হয়, কোনোটি দিনে তিনবার। এরকম দুটি ওষুধ মিশিয়ে দিলে হয় একটির বেশি ডোজ খাওয়া হবে অথবা অন্যটির কম ডোজ খাওয়া হবে।

৩) পরস্পরের সঙ্গে বিক্রিয়াকারী দুটি ওষুধের কম্বিনেশন।

৪) এমন দুটি ওষুধ, যা একসঙ্গে খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেড়ে যায়।

৫) একটি ক্ষতিকর অণু সমন্বিত ওষুধ। যেমন অ্যানালজিন কম্বিনেশনগুলি, যা বহুদিন ধরেই নিষিদ্ধ। সর্দিগর্মির ওষুধে অ্যালার্জি নিরোধক যৌগ আর মাথাব্যথা ও জ্বরের বিরুদ্ধে কার্যকর প্যারাসিটামলের সঙ্গে সিউডোএফিড্রিন বা ফিনাইলেফ্রিন জাতীয় যৌগও মেশানো থাকে, যা বন্ধ নাকের কষ্ট থেকে আরাম দেয় বটে, কিন্তু দুম করে প্রেশার বাড়িয়ে দিতে পারে, এমনকি স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। এগুলো প্রেস্ক্রিপশন ছাড়াই পাওয়া যায়, অথচ সব সর্দির রোগীর এতকিছু একসঙ্গে প্রয়োজন নেই। যেসব ক্ষেত্রে প্যারাসিটামলের বদলে নিমেসুলাইড জুড়ে দেওয়া আছে, সেগুলোকে আরো আগেই নিষিদ্ধ করে দিলে ভালো হত।

৬) একটি কার্যকর অণুর সঙ্গে আরো একটি বা দুটি অকাজের যৌগ জুড়ে দেওয়া ওষুধ, যার দরুন দাম বাড়ে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে।

৭) তিনরকম অ্যান্টিবায়োটিক (ব্যাক্টেরিয়ানাশক) এবং একটি অ্যান্টিফাঙ্গাল (ছত্রাকনাশক) যৌগ জুড়ে তৈরি ওষুধের সঠিক প্রয়োগক্ষেত্র চিহ্নিত করা কঠিন। কোন জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে, তা নিশ্চিতভাবে জেনে অথবা নিদেনপক্ষে আন্দাজ করে, তবেই অ্যান্টিবায়োটিক গোত্রের ওষুধ প্রয়োগ করা উচিত। নচেত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি প্রতিরোধী জীবাণুর পরিমাণও বেড়ে যাবে।

৮) চামড়ার ওষুধে প্রায়শ ছত্রাক বা ব্যাক্টেরিয়া নাশক যৌগের সঙ্গে স্টেরয়েড মেশানো থাকে। স্টেরয়েড থাকলে চুলকানি বা জ্বালা থেকে তৎকাল আরাম মেলে, কিন্তু সংক্রমণটি আরো ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে। কড়া স্টেরয়েড মুখে মাখলে চামড়ার ভয়াবহ বিকৃতিও হতে পারে। অথচ এসব কম্বিনেশন যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়, যা আটকানোর জন্য এগুলোকে নিষিদ্ধ করার যুক্তি আছে।

৯) এমন ওষুধ, যা কার্যকর হলেও নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, তা খোলা বাজারে ছাড়া থাকলে নার্কোটিক্স আইন বলবত করা কঠিন হয়ে যায়।

সুতরাং বিভিন্ন কারণে ওষুধ নিয়ন্ত্রণে সরকারি কঠোরতা প্রয়োজন হতেই পারে। তবে বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ হওয়া সব ওষুধ বা কম্বিনেশনই যে দারুণ সমস্যাজনক ছিল, তাও নয়। কিছু ওষুধ বা কম্বিনেশনের প্রয়োগক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করে তাদেরকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা যেত। কিছু ওষুধ বাতিল হওয়ায় পুলিশের কাজে সুবিধা হয়েছে, কিন্তু চিকিৎসকদের অসুবিধা হয়েছে। যেমন, আফিমজাত ওষুধগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অবশ্যই জরুরি, কিন্তু একেবারে নিষিদ্ধ করে দিলে সমস্যা হয়। কোডিন গোত্রের ওষুধ অমিল হবার ফলে কিছু রোগীর (মূলত ক্যান্সারজনিত) ভয়ানক কাশির উপশম প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আবার মারাত্মক যন্ত্রণার উপশমেও আফিমজাত কিছু ট্যাবলেট বা ইঞ্জেকশন প্রয়োজন হয়, যা পাওয়া না গেলে রোগীর প্রাণান্ত হবে।

ডায়াবেটিস চিকিৎসার বেশ কিছু কম্বিনেশন নিষিদ্ধ হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটিতে মেটফরমিনের ভুল ডোজ ছিল। আবার পায়োগ্লিটাজোনযুক্ত বেশ কিছু ওষুধ নিষিদ্ধ হয়েছে, সম্ভবত হৃদযন্ত্রের ওপর এই যৌগটির প্রভাব ভালো নয় বলে। তবে এসব একেবারে নিষিদ্ধ করার মতো যথেষ্ট এবং নির্ভুল তথ্য আছে কিনা, বলা কঠিন। অবশ্যই এখন বেশ কিছু নতুন ডায়াবেটিসের ওষুধ এসেছে, যেমন কয়েক বছর আগে জনপ্রিয় হওয়া এক্সেনাটাইড, লিরাগ্লুটাইড জাতীয় ইঞ্জেকশন বা গ্লিপ্টিন (DPP-4 inhibitors) গোত্রের বিভিন্ন ট্যাব্লেট থেকে শুরু করে নবতম গ্লিফ্লোজিন (SGLT-2 inhibitors) গোত্রের বিভিন্ন ওষুধ। সন্দেহ নেই, এসব ওষুধের সাফল্যের পক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বেশি, কিন্তু এদের দামও অনেক বেশি। কিছু মানুষ যদি সন্দেহ করেন যে এই নতুন পেটেন্টভুক্ত আমদানিকৃত ওষুধগুলির সামনে বাজার উন্মুক্ত করে দেবার জন্যই সরকার পুরনো ওষুধগুলি ব্যান করে দিতে বাধ্য হলেন আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে, তাহলে তাঁদের সন্দেহকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন।

আমজনতার চিন্তা অবশ্য সর্বদা এতটা রাজনৈতিক নয়। পরিচিত অনেকে বেশি চিন্তিত, তাঁদের নিত্যদিনের জলখাবার "স্যারিডনের" ভবিষ্যৎ নিয়ে। স্ত্রীকে স্যারিডন কিনে না দিতে পারলে বিবাহবিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করছেন কেউকেউ। "তবে কি প্রতিবার মাথাব্যথা হলে ডাক্তারের কাছে দৌড়তে হবে?" প্রশ্ন একজনের। তাঁর মূল চিন্তা আর্থিক, চিকিৎসকের ভিজিট দিতে হবার বেদনা। এই আশঙ্কা সঠিক নয় এখনো। প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ আপনি এখনো বিনা প্রেস্ক্রিপশনে কিনে খেতে পারেন। তবে আপনার যদি হঠাৎ নতুন মাথাব্যথা শুরু হয়ে থাকে, অথবা দীর্ঘদিন ধরে ঘনঘন মাথাব্যথায় কষ্ট পেতে থাকেন, তবে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া মন্দ নয়। আইনক্সের একটি টিকিটের অর্থমূল্যে নিশ্চিত হতে পারবেন আপনার সদ্য শুরু হওয়া মাথাব্যথাটি ব্রেন টিউমারের কারণে কিনা বা হয়ত জানতে পারবেন বহুদিনের অসহ্য মাথাব্যথাটি একেবারে সারিয়ে ফেলা সম্ভব। তখন পটাপট স্যারিডন না খেয়েও সুখী দাম্পত্যজীবন যাপন করা সম্ভব হবে। বারবার ব্রুফেন, ভোভেরান নিয়ে শেষ অব্দি পেটের আলসার বা কিডনির রোগ বাধিয়ে অনেক বেশি ভিজিটের টাকা খরচা করার প্রয়োজনও হবে না।

আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই যে চিকিৎসা এবং ওষুধ প্রয়োগের বিষয়ে বিষয়ে রোগী, রোগীর পরিবার এবং চিকিৎসকদের মনোভাব আরো আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত হওয়া জরুরি। ওষুধ ব্যবসার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকা ভালো। ক্ষতিকর ওষুধের কম্বিনেশন নিষিদ্ধ হওয়াই উচিত, কিন্তু এসব নিষেধ বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। কোনো বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর স্বার্থ সরকারকে প্রভাবিত না করলেই মঙ্গল। পাশাপাশি সাধারণ জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-দুশ্চিন্তাগুলিও যদি সরকার শুনতে শুরু করেন, তবে তাকে সত্যি সুদিন বলা যাবে।

<লেখক আমরি (AMRI) ঢাকুরিয়া হাসপাতালের স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ।>

Advertisment