/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/05/chaitali-newCHAITALI-CHATTOPADHYAY-002.jpg)
মেয়েদের অপরাধের ভার বেড়েই চলে, ক্রমশ। (ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্যায়)
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
একটা গল্প বলি? মেয়েদের গল্প। না, প্রাচীনকালের নয়, একদম এই এখনকার। উচ্চবিত্ত পরিবার হলেও, জন্মে ইস্তক তার না-জন্মানের মনোবাসনাই শুনে আসছে সে, বাড়ির তৃতীয় কন্যাসন্তান হওয়ার ফলশ্রুতি হিসেবে। সেই মেয়ে, ধরা যাক তার নাম লতিকা, একটু বড় হওয়ার পর থকেই বাড়ির লোকজনের অভিশপ্ত হিসহিস শুনত এবং টের পেত, “গলার কাঁটা এই মেয়ে!” ওর সঙ্গিনী পুতুলের মতোই ছোটমাপের একটা অপরাধবোধ তখন থেকেই ওর পাশে-পাশে ঘোরাফেরা করত। আশেপাশের বাড়িতে কমবয়সী ছেলেদের দেখত, কী নির্ভার, নিশ্চিন্ত খেলাধুলো সেরে খুশিমুখে বাড়ি ফিরছে! খোলা উঠোন, এক আকাশ আলোর মধ্যে দিয়ে খেলতে গিয়ে লতিকা কোনওদিন সেই মুক্তির মধ্যে শ্বাস নিতে পারেনি। শুধু লতিকা কেন, ওর মতো অনেক বালিকাই নিষেধাজ্ঞার মশারি তুলে খোলা মনে বাইরে আসতে শেখেনি। নিষেধের ভয়ও তো একধরনের অপরাধবোধ। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধবোধ। যা তাকে অন্যদের থেকে ক্রমশ আলাদা করে দেয়। ভীতি জাগায়। বোঝায়, আমি এত শঙ্কাহীন চিত্তে লাফালাফি করতে পারব না। হা-হা হাসি হেসে মাটিতে লুচোপুটি খেতে পারব না। বল নিয়ে, বা চোর-চোর খেলার সময়ে ছেলেদের গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে পারব না। সর্বোপরি, সূর্য ডোবার আগেই ঘরে ফিরতে হবে। এই না-না-না-র পাল্লা ভারী হতে হতে, সেই না-কে মান্যতা না দিলে খানিকটা অন্যরকম জীবনের স্বাদ পাওয়া যায় বটে, কিন্তু অপরাধবোধ তখনও পিছু ছাড়ছে না তো!
আরও পড়ুন, পৌরুষ! আর চাই না
এই লেখার প্রতিপাদ্য কিন্তু, মেয়েরা কীভাবে, নিরুপায়, অপরাধের বোঝা ঘাড়ে নিতে-নিতে, ফ্রক টেনেটুনে হাঁটু ঢাকতে-ঢাকতে, নুয়ে পড়ে, সদ্য বুক জেগে ওঠার অপরাধে কোলকুঁজো হয়ে যায় ক্রমশ!
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/05/chaitali-CHAITALI-CHATTOPADHYAY-1-001.jpg)
ও হ্যাঁ, আরেকজন অপরাধিনীর কথা তো গোড়ায় বলতে ভুলেছি। তিনি, লতিকার মা। শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে সন্তান ছেলে কি মেয়ে হবে, সেটা নির্ভর করে স্পার্ম ঠালছে যে পুরুষ তার ওপর, এখন জেনে বুঝেও, আজও, পরপর কন্যাসন্তানের জন্ম-দেওয়া বধূটি পায় বেশি মনোযোগ।
লতিকার চামড়ায় সেঁটে-বসা আরেক অপরাধের কথা তো উল্লেখ করিনি এতক্ষণ! ও কালো। সুশ্রী নয়। বাজারে পণ্য কিনতে গেলে ট্যারাব্যাঁকা জিনিস কিনতে দেখেছেন কাউকে? দেখেননি তো! তাই, পৃথিবী নামের এই পণ্যশালাটিতে নারী এমন এক পণ্য, তাকে লাবণ্য নিয়ে জন্মাতেই হবে, বাজারে সহজে বিকোনোর জন্য। নাহলে, কানে বর্ষণ করা হবে অভিযোগের পর অভিযোগ। আর সে অপরাধবোধে জর্জরিত হবে সুন্দরী নয় বলে। তার ফরসা চামড়া নয় বলে। রূপ না থাকার গুঞ্জন শুনতে শুনতে সে-ও শেষে ভাবতে শুরু করে দেবে, সে অপদার্থ। অপরাধিনীও বটে। এই সময়ে পাড়ার বড়লোক ছেলের নজরে পড়ল লতিকা। রূপ না থাক, শরীর তো আছে। আস্ত একটা নারীশরীর। ছেলেটির আদরের খিদে মিটে গেলে, সে সরে যায় যখন, লতিকার নিজের বাড়ি, ছেলের বাড়ি, প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে ছি-ছি রব ওঠে, ‘দেখেছ! শাঁসালো ছেলে পেয়ে কীভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে…’, আবার অপরাধের কোপ পড়ল লতিকার ঘাড়ে।
আরও পড়ুন, জেন্ডারঃ কী বুঝি – বুঝি কি?
মেয়েদের অপরাধের ভার বেড়েই চলে, ক্রমশ। সে-অপরাধ, সমুদ্রপ্রায়। লতিকার বিয়ে হবে। সে রূপসী না হলেও, বিদ্যাবুদ্ধির জোরে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি পেল। এবার অপরাধ এল শাঁখের করাতের চেহারা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে আমরা পড়েছি, একটি বউ-হয়ে-আসা-মেয়ে খাতা নিয়ে করবে টা কী, বিদ্যে পেটে শামলা এঁটে চাকরি করতে বেরোবে বুঝি! সে তো সংসার সামলাবে, সংসার প্রতিপালন করবে। যার যেখানে স্থান! তো, আমাদের এই লতিকাও চাকরি করতে গেল যেই, সংসার নড়েচড়ে উঠল। ওমা! শ্বশুরবাড়ির সেবাযত্ন করবে কে! ছেলেমেয়ে তো অবহেলায় বেড়ে উঠবে তবে! এ তো গেল অপরাধের একটি দিক! আর অন্যদিক? চাকুরিস্থল? সেখানেও অসন্তোষ। সার্ভিস রেকর্ডে কালির ছিটে! সে এফিশিয়েন্ট নয়। তার অফিসে আসতে প্রায়ই দেরি হয়। বাড়িতে অসুখবিসুখ লেগে থাকে, ফলে ছুটিও নিতে হয় প্রায়-ই।
অপরাধ, অপরাধ আর অপরাধ। মেয়েজন্মই তো অপরাধ। আর সেই অপরাধের জেরে, কখনও আত্মহত্যা, কখনও মানসিক বিকার। কখনও-বা একটি মেয়ে পিতা, স্বামী ও পুত্রের অধীনতা মেনে মন নামিয়ে, চোখ নীচু করেই কাটিয়ে দিল সারাজীবন। অপরাধী মেয়েদের নামে কলঙ্ক লেপে দেয় সমাজ। আকাশে হোর্ডিং টাঙায়: নারী নরকের দ্বার।
আরও পড়ুন, সৎ অসতীর আত্মকথন