Advertisment

ফুটবলে আচ্ছন্ন বাংলা: শুধু খেলা? না জাতীয় চেতনা?

যিনি আজ পর্যন্ত কখনও কোন ফুটবলাচ্ছন্ন বাঙালির সংস্পর্শে আসেন নি, তাঁর পক্ষে বোঝা অসম্ভব মোহন বাগান-ইস্ট বেঙ্গল নামের মহিমা, বা সেই নামের প্রতি আধুনিক বাঙালির আজও অন্ধ আনুগত্য, তা তিনি এপারেরই হোন বা ওপারের।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
fifa, Worldcup, ফিফা, ওয়ার্ল্ড কাপ, বিশ্বকাপ

কলকাতা যাপন আর ফুটবল (Express photo by Shashi Ghosh)

অদ্রিজা রায়চৌধুরী

Advertisment

কলকাতার ইতিহাসে ৩১ অগাস্ট, ২০১১ দিনটি চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর্জেন্টিনীয় 'ফুটবলের ঠাকুর' লিওনেল মেসি পা রেখেছিলেন শহরে সেদিন। আপনাদের মনে থাকবে, দু'হাজারের ওপর ফুটবল-পাগল শহরবাসী ঘন্টার পর ঘন্টা বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করেছিলেন তাঁদের আরাধ্য দেবতার জন্য, যাঁর কলকাতায় পদার্পণ ঘটেছিল শহরে প্রথমবার ফিফা-আয়োজিত আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডলি ম্যাচের কল্যাণে।

অবশ্য ফুটবল নিয়ে বাংলার পাগলামির গল্প নতুনও নয়, গোপনও নয়। যিনি আজ পর্যন্ত কখনও কোন ফুটবলাচ্ছন্ন বাঙালির সংস্পর্শে আসেন নি, তাঁর পক্ষে বোঝা অসম্ভব মোহন বাগান-ইস্ট বেঙ্গল নামের মহিমা, বা সেই নামের প্রতি আধুনিক বাঙালির আজও অন্ধ আনুগত্য, তা তিনি এপারেরই হোন বা ওপারের। এই আনুগত্যের অবশ্যম্ভাবি পরিণতি হলো বৃহত্তর ফুটবল জগতেও নিজেদের ভক্তির উপাদান খুঁজে নিয়ে তদ্গতচিত্তে বন্দনায় মজে যাওয়া।

যেমন মজেছেন উত্তর ২৪ পরগণার শিব শঙ্কর পাত্র। ফিফা ২০১৮ শুরু হওয়ার মুখে মেসিতে নিবেদিতপ্রাণ এই চা বিক্রেতা নিজের বাড়ির প্রতিটি আনাচ কানাচ নীল-সাদায় রঙ করে ফেলেছেন, মায় বাড়ির ইন্টিরিয়র ডেকোরেশন পর্যন্ত পাল্টে ফেলেছেন তাঁর মেসি-মারাদোনা প্রীতির ব্যাপ্তি বোঝাতে। তাঁর কয়েক ধাপ নিচেই রয়েছে কলকাতার বিভিন্ন পাড়ার ক্লাব, যারা  পছন্দের ফুটবলার এবং টিমের পোস্টারে-দেওয়াল লিখনে ছেয়ে ফেলেছে গোটা শহর।

fifa, Worldcup, ফিফা, ওয়ার্ল্ড কাপ, বিশ্বকাপ টাকি রোডের ধারের একটি মাঠে চলছে ফুটবল প্রশিক্ষণ,(Express photo by Shashi Ghosh)

ঠিক কোথা থেকে আসে এই উন্মাদনা? এমন একটা খেলার জন্য যেটাতে ভারত কবে আন্তর্জাতিক যোগ্যতা অর্জন করবে তার কোন ঠিকঠিকানা নেই? ক্রিকেট, টেনিস, ব্যাডমিন্টনের মতই ফুটবলও আমাদের কাছে এসেছে ব্রিটিশ রাজত্বের দৌলতে। উনিশ শতকের শেষের দিকে ভারতের ব্রিটিশরা ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। খেলাও শুরু করে নিয়মিত। এবং অচিরেই ফুটবল মাঠ হয়ে ওঠে 'নেটিভ'-দের উপর ইংরেজদের প্রভুত্ব প্রদর্শনের জায়গা। বিশেষত বাঙালিদের ওপর, যারা নাকি ছিল শারীরিক ভাবে রোগাপটকা-দুর্বল আর স্বভাবগত ভাবে 'মেয়েলি'!

শতাব্দী ঘুরতে না ঘুরতেই কিন্তু ছবিটা পাল্টাতে শুরু করল। ফুটবল আর শুধুমাত্র খেলা রইল না, হয়ে উঠল বাঙালির জাতীয়তাবাদের প্রকাশ। তাঁর ‘Football and Politics in Bengal: Colonialism, Nationalism, Communalism' শীর্ষক প্রবন্ধে ক্রীড়া ইতিহাসবিদ পল ডিমেও লিখেছেন, "As such, tracing the changing nature of football in Bengal is in many ways an exercise in tracing the history of the region itself," অর্থাৎ, বাংলায় ফুটবলের বিবর্তনের সূত্র ধরে গোটা অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা যায়।

'সাহেবদের' খেলা

ফোর্ট উইলিয়ামে স্থিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কলকাতায় ফুটবলের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। সৈন্যদের শারীরিক সক্ষমতা গড়ে তোলার প্রকৃষ্ট উপায় হিসেবে নানাপ্রকারের খেলাধুলোর চর্চা ছিল বাধ্যতামূলক। যে কোন কারণেই হোক, সময়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাসকারী ইউরোপীয় সিভিলিয়ানদের কাছে ফুটবল হয়ে ওঠে অন্য যে কোন খেলার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। মোটামুটি ১৮৭০ থেকে শুরু করে শহরের উচ্চবিত্ত ইউরোপীয় সমাজের প্রতিনিধিরা একের পর এক ফুটবল ক্লাব গঠন করতে আরম্ভ করলেন।

ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাবের (CCFC)-র পত্তন হলো ১৮৭২ সালে। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের কিছু সদস্য মিলে তৈরি করলেন ডালহৌসি ক্লাব, ১৮৭৮ সালে। ধীরে ধীরে উঠে এল ট্রেডারস ক্লাব, ক্যালকাটা রেঞ্জার্স, আর্মেনিয়ান ক্লাব প্রমুখ। পাশাপাশি শুরু হলো বিভিন্ন ধরনের আন্তঃ-ক্লাব প্রতিযোগিতা, যথা ডুরান্ড কাপ এবং ট্রেডস কাপ। ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বা IFA-র জন্মও এই সময়েই।

মজার ব্যাপার হলো, একদিকে বাংলায় ইউরোপীয় ফুটবল যতই শিকড় গেড়ে বসুক, অন্যদিকে ইংরেজরা কিন্তু সদা সচেষ্ট থাকত যাতে কোন বঙ্গসন্তান ফুটবলের কাছাকাছি ঘেঁষতে না পারে। বাঙালির খেলাধুলোর অভ্যাস নেই, অতএব সে ফুটবল খেলতে পারবে না, এই ধারণা আরও জোরদার হয় ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহের পর, যখন 'নেটিভ'-দের দূরে রাখা কার্যত সরকারি নীতি হয়ে উঠেছিল। এছাড়াও, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্ণ ইংরেজরা আবিষ্কার করল ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় বর্ণবৈষম্যের কার্যকারিতা। ফলত, স্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি হয়ে দাঁড়াল পৌরুষের প্রতীক, এবং পরাধীন রাষ্ট্র স্বভাবতই গণ্য হলো দুর্বল জাতির প্রতিমূর্তি হিসেবে।

বাঙালির জাতীয়তাবাদের প্রতীক

একদিকে যেমন ছিল বাঙালিদের ফুটবল খেলার অযোগ্য প্রতিপন্ন করার প্রবণতা, পাশাপাশি কিন্তু ছিল ' দুর্বল' বঙ্গসন্তানদের শারীরিক ভাবে 'সবল' করে তোলার চিন্তাভাবনাও ! বস্তুত, ব্রিটিশদের একাংশ সত্যিই মনে করতেন, শরীরচর্চার পাঠের মাধ্যমে বাঙালিদের 'সবল' করে তোলা তাঁদের শাসকসুলভ রাজধর্মের মধ্যেই পড়ে। তাঁদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে বাঙালি ছেলেদের ফুটবল খেলতে উৎসাহিত করা।

এই ভাবনা দ্রুত প্রভাব ফেলেছিল মধ্যবিত্ত বাঙালিদের অধিকাংশের মননে, যাঁদের শিক্ষাজীবন কেটেছিল 'ইংলিশ পাবলিক স্কুল'-এর আদর্শে তৈরি ব্রিটিশ পরিচালিত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কলেজগুলিতে।ব্রিটিশদের চোখে ' জাতে' উঠতে যে খেলাধুলাতেও পটু হওয়া প্রয়োজন, এটা বুঝতে দেরি হয়নি ইংরেজি-শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিদের।

প্রেসিডেন্সী কলেজ, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সেন্ট জেভিয়ারস কলেজ এবং লা মারটিনিয়ার কলেজের মত প্রখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তুলল তাদের নিজস্ব টিম, এবং এইসব প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনরাই জন্ম দিলেন বাংলার কিংবদন্তী ফুটবল ক্লাবের, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল মোহন বাগান, ভূপেন্দ্রনাথ বোস দ্বারা ১৮৮৯ সালে স্থাপিত।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ফুটবল আর শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসকদের অনুকরণ করার বিষয় ছিল না, শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার পন্থাও হয়ে উঠেছিল। "ফুটবল মাঠে কোন সাহেব বা সৈনিকের মুখে কনুইয়ের গুঁতো অথবা ঘুষি, বা ট্যাকেল করার ছলে তাদের পদাঘাত করা, প্রভূত সাহসের পরিচয় হয়ে উঠেছিল," লিখেছেন কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ফুটবল ময়দান সেইসব বাঙালির রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল, যাঁরা সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন।

ফুটবলের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক এক অভূতপূর্ব মাত্রা পেয়েছিল ১৯১১-র ২৯ জুলাই, যে দিন ইস্ট ইয়র্ককে ২-১ গোলে হারিয়ে আই এফ এ শিল্ড জিতে ইতিহাস গড়েছিল মোহনবাগান। শ্রী বন্দোপাধ্যায়ের লেখনীতে," মোহনবাগানের জয় শুধু খেলার মাঠের জয় ছিল না, ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের অনুঘটকও।

fifa, Worldcup, ফিফা, ওয়ার্ল্ড কাপ, বিশ্বকাপ শান্তি সমিতি কালীঘাট (Express photo by Shashi Ghosh)

স্থানীয় সংবাদপত্র ' নায়ক'-এ মোহনবাগানের জয় বর্ণিত হয়েছিল এই ভাবে, "প্রতিটি ভারতবাসীর আজ আনন্দের দিন। ম্যালেরিয়া-ক্লিষ্ট, খালি পায়ের ভেতো বাঙালিরা আজ গোমাংসভুক ষন্ডামার্কা ইংরেজদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে।"

মোহনবাগানের এই ঐতিহাসিক জয় ফুটবলকে উন্নীত করেছিল জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রতীকে। সাম্প্রতিক অতীতের ইতিহাসবিদরা আরও এক ধাপ এগিয়ে জানিয়েছেন, এই জয়ের প্রভাব পড়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশশক্তির উপরও। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ যেমন ১৯৯৮ সালে 'দ্য টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় লিখেছিলেন, "১৯১১ সালেই ব্রিটিশরা কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়েছিল রাজধানী। মোহনবাগানের ইতিহাসে আগ্রহী গবেষকদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে এই সমাপতন। সত্যিই কি সমাপতন ? প্রশ্ন ওঠেই, কারণ এটা খুবই সম্ভব যে,একই বছরে ঘটা দুটি ঘটনা ছিল কার্যকারণ-যুক্ত। বাংলার দক্ষ ফুটবলারদের এবং বোমা ছোড়ায় সিদ্ধহস্ত বঙ্গজ বিপ্লবীদের হাতে হেনস্থা হওয়ার থেকে বাঁচতেই হয়তো রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চতুর ইংরেজরা।"

ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছে সত্তর বছর আগে। ফুটবল কিন্তু আজও থেকে গিয়েছে বাঙালির গর্বের সূচক হয়ে। বৌদ্ধিক চর্চার বাইরেও বাঙালির অস্তিত্বের মানদণ্ড হয়ে। বাঙালি মানেই ' অলস', এই চিরাচরিত ধারণার মূলে আঘাত করতেও ফুটবল দেখা দিয়েছিল অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে।

FIFA WORLD CUP 2018 Kolkata Football
Advertisment