Advertisment

অরণ্যে বসতির নিয়ম

জঙ্গল মানেই সেখানে নানারকমের উদ্ভিদ থাকে- কেবল শাল অথবা সেগুন কি কেবলি ইউক্যালিপটাস বা পাইনের একচেটিয়া গাছেদের সমাহার কখনওই প্রাকৃতিক জঙ্গল নয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Forest, Forest of India

জঙ্গল যে মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় সেই জ্ঞানকে এই দেশের সাধারণ সভ্য মানুষেরা বেশ সহজভাবেই নিজেদের জীবনে মেনে চলতেন

জঙ্গলে যে গাছলতা থাকে তাদের মধ্যে আশ্চর্য কতগুলো ব্যাপার দেখা যায়। কত যে রকমের গাছ একসঙ্গে থাকে! কত রকমের তাদের ধরন, কত আলাদা উচ্চতা, লতা গুল্ম ঘাস মিলে যেন একটা প্রাচীন সংসার। নানা জায়গার জঙ্গলের চেহারাও আলাদা- হিমালয়ের পাইনবন, যদিও আপনা থেকে তৈরি হওয়া জঙ্গল কেটে ফেলে ইংরেজ শাসকদের বসানো এই বিশেষ সরলবর্গীয় বৃক্ষরাজি হিমালয়ের নিজস্ব নয়, তরাইয়ের জঙ্গল, মধ্যপ্রদেশ-ছত্তিসগড় থেকে ওড়িশা হয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ তেলেঙ্গানা পর্যন্ত বিস্তৃত পাথুরে সমতলের সু-ঘন বনাঞ্চল, সুন্দরবন, মহানদী কৃষ্ণা গোদাবরীর মোহানায় একসময়ে কমবেশি বিস্তৃত বাদাবন যাকে বলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, প্রত্যেকের চরিত্র আলাদা।

Advertisment

তবু কিছু স্বভাব দেখি গাছেদের সমাজের নিজস্ব, যেমন মানুষের ছিল বা থাকে। জঙ্গল মানেই সেখানে নানারকমের উদ্ভিদ থাকে- কেবল শাল অথবা সেগুন কি কেবলি ইউক্যালিপটাস বা পাইনের একচেটিয়া গাছেদের সমাহার কখনওই প্রাকৃতিক জঙ্গল নয়। প্রাকৃতিক জঙ্গলে সাধারণ ভাবে দেখা যায় সবচেয়ে উঁচু গাছেদের পাতা অপেক্ষাকৃত হালকা বা ঝিরঝিরি, যেখান দিয়ে রোদ্দুর তার নিচেকার গাছেদের ওপরও পৌঁছতে পারে। বৃষ্টির জলও তাই। আবার তীক্ষ্ণ রোদ বা খুব বেশি বৃষ্টির এলাকায় এর সঙ্গেই থাকে কিছুটা চওড়া পাতার গাছও- বট, কদম্ব বা ওকগাছের মত। বৃষ্টির জল এদের ঘন পাতার চাঁদোয়া বেয়ে কাণ্ড বেয়ে নিচের গাছলতাদের জোর বৃষ্টিফোঁটার আঘাত থেকে কিছুটা রক্ষা করে। তাদের নিচে থাকে গুল্ম, ঝোপঝাড়। এগুলোয় ধরে নানারকমের ফল যা ছোট প্রাণীদের খাবার, পরে মানুষও খেতে শিখেছে। সবচেয়ে নিচে ঘাস। সে ঘাসও আবার স্থানভেদে কতো বিচিত্র রকমের! কোনোটার পাতা মোটা, গোছা গোছা, কোনোটার আবার খুব সরু, কারো পাতায় ঘুমপাড়ানি মৃদুগন্ধ কারো শেকড়ে কর্পূর কিংবা বেকারি-ফ্রেশ বিস্কুটের।

আরও পড়ুন, চিকিৎসা এবং মানবিকতার মাঝে দাঁড়িয়ে যে দেওয়াল, তার নাম বিজ্ঞান

পোকাপতঙ্গ কিংবা কখনো কখনো বড়োগাছদেরও শেকড়ের সঙ্গে এদের নানা গোপন সম্পর্ক থাকে, ওপর থেকে যা আমাদের মত লোকেদের কাছে স্পষ্ট নয়। এছাড়াও থাকে নানারকম ছত্রাক। বনের যে নিজস্ব জীবজগত, তার অস্তিত্ব বা সুস্থতার সঙ্গে এই গাছলতাগুল্মঘাসের বিন্যাসের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। যে পাখি যখন ডিম পাড়ে সেই সময়মতই সে পায় বিশেষ কোন গাছের ফল, বীজ বা মধু যা তাদের খাবার। কিংবা ঘুরিয়ে বলা যায় যখন যেই ফলফুলবীজ সহজপ্রাপ্য তখন জন্মায় সেই সব পাখি কিংবা জন্তুদের শাবকরা যারা সেইগুলো খায়। সেরকমই ডিম দেওয়া বা বাচ্চা প্রসবের সময় সুর মিলিয়ে থাকে ঘনপল্লব বা পত্রবিরলতার সঙ্গে। কোনটার সংগে কোনটার কার্যকারণ সম্পর্ক অর্থাৎ ডিম আগে না কোকিল আগে, সে নির্ণয় করা ভারি কঠিন।

প্রাণী আর উদ্ভিদের এই অপরূপ পরস্পরলগ্ন অস্তিত্বের সঙ্গে কোথাও সভ্যতায় এগিয়ে আসা মানুষরাও নিজেদের অস্তিত্বকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন। সেই মানুষরা যাঁরা সভ্যতার আদি শিক্ষাকে বুঝেছিলেন, প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে থাকাই মানুষের সবচেয়ে শান্তি আর আনন্দের থাকা। আমাদের এই দেশের প্রায় প্রতিটি সমাজের সামাজিক রীতিনীতির মধ্যে প্রকৃতির সম্পদগুলোকে সম্মান করার যত্ন করার অসংখ্য চিহ্ন এখনও স্পষ্ট দেখা যায়। নদী, মাটি, পর্বত আর জঙ্গল বা অরণ্যানীকে শুধু সম্মান করা নয়, দেখা হয়েছে সৌন্দর্যের উচ্চতম রূপ বলে। মন্ত্রে, অর্চনায়, উৎসবে তাদের দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আজ যাঁরা ধর্মকে হিংসা প্রচারের উপায় বলে ঠিক করেছেন, তাঁরা ভারতীয় ধর্মের স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত নন, একথা স্পষ্ট বোঝা যায়। নাহলে, যাঁরা কোনো এক প্রাচীন সৌধের মালিকানা দখল করার জন্য রক্তবন্যা বইয়ে দেন তাঁরাই অথচ পবিত্র নর্মদা নদীর মাঝখানে নিত্যপূজিত শূলপাণেশ্বর মন্দির কিংবা শত শত বছর ধরে যেখানকার প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গকে এক বিরাট অংশের ভক্ত মানুষরা পবিত্রতম বলে পুজো করে এসেছেন সেই ধাবড়ি কুণ্ডকে সর্দার সরোবরের জলে ডুবিয়ে দেওয়াকে সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন নিজেদের ‘জয়’ বলে, এমনটা কী করে হয়! জঙ্গল যে মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় সেই জ্ঞানকে এই দেশের সাধারণ সভ্য মানুষেরা বেশ সহজভাবেই নিজেদের জীবনে মেনে চলতেন।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘন জঙ্গলের কিছুটা সমাজ নিজে সংরক্ষণ করত ‘পবিত্র বন’ বলে। গুজরাটে সেই অঞ্চলকে বলে ‘দেববনী’ অর্থাৎ দেবতাদের বন। রাজস্থানে তার নাম ‘সরণা’, বিপদে পড়লে যার শরণ নেওয়া যায়, সাঁতাল, মুন্ডা, ভূমিজ ইত্যাদি সমাজে ওই সংরক্ষিত বন হল জাহের। এমন নয় যে কোনো বিশেশ দেবতার মূর্তি বা মন্দিরই এইসব বনের ‘পবিত্র’তার কারণ। বরং বন নিজেই পবিত্র। সাধারণভাবে এসব জায়গায় কোনো পশুচারণ হবে না, বাইরের কোনো জিনিস নিয়ে কেউ বনে ঢুকবে না এবং পবিত্র বনাঞ্চলের গাছ, লতা, গুল্ম এমনকি ঘাসেরও কেউ কোনো ক্ষতিসাধন করবে না, অর্থাৎ কাটা বা ছেঁড়া যাবে না। অথচ এই সব শরণ নেওয়ার আচ্ছাদনে যেতে তো হবেই নাহলে আর ‘সরণা’ বা জাহের কেন? জাহেরের কাজ যদি মঙ্গলসাধন? অকালে-আকালে আশ্রয় দেওয়াই তো বৃহত্তম মঙ্গল!

আরও পড়ুন, ‘সব পেয়েছির দেশে’ হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সন্তানরা

সেই প্রবেশের, শরণ নেওয়ারও ছিল নানা নিয়ম, সমাজের নিজের তৈরি সেইসব নিয়ম সমাজের সদস্যরা মেনেই চলতেন। পরপর বছর বৃষ্টিহীন গেলে গ্রামের কিছুজন বসে নিজেদের মত করে দেবতার আদেশ চাইতেন, তবেই দেববনীতে ঢোকা যাবে। প্রবেশ করবে কিন্তু সকলেই। ‘সরণা’র নিয়ম আবার একটু আলাদা। জলের বা খাবারের খুব অভাব হলে গ্রামসমাজ সরণায় যাবে, নিজেদের আর পশুদের প্রাণ বাঁচাতে কিন্তু সেই প্রয়োজন মেটাতে হবে খুব সাবধানে, কোনও কিছু নষ্ট বা অপচয় না করে। অজন্মা বা খরায় খাবার অভাব বাড়লে, অসুখবিসুখে আক্রান্ত হলে আদিবাসীরা জাহেরে যাবেন। যাবার আগে পুজো করে তাঁদের নিজেদের দেবতাকে জানাবেন, সকলে একসঙ্গে যাবেন। সেখান থেকে নিজেদের খিদেতেষ্টা মেটাবেন, বন থেকে ওষুধপালা তুলবেন কিন্তু সেই ‘না-হলেই-নয়’ ছাড়া আর কোন গাছলতাশেকড় জাহেরের বাইরে আনবেন না। বলাই বাহুল্য, নিতান্ত বিপদের সময়টুকু পার হয়ে গেলে এই পবিত্র বন গুলি আবার থাকত নিজেদের মত, ফলে দ্রুত সেগুলি পূরণ করে নিত সেই আপৎকালীন ব্যবহারের ক্ষয়।

সোনার ডিম দেওয়া রাজহাঁস কেটে সব ডিম ‘এক্ষুণি’ বার করে নেবার মত উৎসন্ন লোভ ছিল না সেই সভ্যতার, তাই হাজার হাজার বছর ধরে শিল্প, কৃষির সম্পন্নতার পাশাপাশি চারুশিল্প, কৃষিপ্রযুক্তি সঙ্গীত, দর্শনচিন্তার কুশলতায় সারা ইউরোপকে আকর্ষণ করেছিল তাঁদের সৃষ্টিমঞ্জুষা।

বনকে রক্ষা করার সাথে সাথে এ দেশের সমাজ অকল্পনীয় কুশলতায় রক্ষা করেছিল নিজেদের জল-ব্যবস্থাকেও। সে গল্পের প্রবেশমুখ বারান্তরে।

(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)

এই সিরিজের সব লেখা একত্রে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

Jol Mati
Advertisment