দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
পুডুচেরির লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে মাননীয়া কিরণ বেদি সোশাল মিডিয়ায় ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয় নিয়ে লিখেছেন, ‘ফ্রান্সকে অভিনন্দন। আমরা জিতেছি।’ নিজেই টুইট করে জানিয়েছেন, যেহেতু পুডুচেরি বা পণ্ডিচেরি একটি ফরাসি ঔপনিবেশিক শহর ছিল, ফলে একই উপনিবেশ শহরের প্রজা-মানসিকতায় লিখেছেন, ‘পুডুচেরির ভাই ও বোনেদের অভিনন্দন, আমরা জিতেছি। আমাদের এই জয়ের উৎসবকে কেন্দ্র করে আমরা একসঙ্গে জমায়েত হতে পারি, একত্র হতে পারি।’ একজন শিক্ষিত আইপিএস অফিসার কোন যুক্তিতে এমন কথা বলতে পারেন, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। প্রসঙ্গত একদা ফরাসি কলোনি পুডুচেরি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় আজ থেকে ৫৬ বছর আগে, ১৯৬২তে।
পণ্ডিচেরির মত হুগলি জেলার চন্দননগরও একসময়ে ফরাসি উপনিবেশ ছিল। এখানেও যেভাবে ফ্রান্সের বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা এবং বিশ্বকাপ জয় নিয়ে হইচই বা উৎসব হলো, একজন চন্দননাগরিক হিসেবে তা দেখে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। ফ্রান্স জেতার পর লোকে ‘থ্রি চিয়ার্স ফর ফ্রান্স, থ্রি চিয়ার্স ফর চন্দননগর’ বলে উল্লাস করেছে। মনে হচ্ছিল চন্দননগর বিশ্বকাপ জয় করে ফেলেছে। যেভাবে কিরণ বেদির বক্তব্যকে নিন্দা করছি, একইভাবে একদা ফরাসি কলোনি চন্দননগরের যে সব নাগরিক ফ্রান্সকে চন্দননগরের সঙ্গে এক করে উল্লাসধ্বনি দিয়েছে তাদের কাজকর্মেরও তীব্র বিরোধিতা করছি, নিন্দা করছি।
১৯৯৮ বা ২০০৬ সালে যখন বিশ্বকাপে ফ্রান্স ফাইনালে উঠেছিল, তখন এতটা ফরাসি প্রীতি দেখা যায়নি। সত্যি বলতে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি জানি, সেই সময়ে শহরে একটা ফ্রান্সের পতাকা খুঁজতে নাজেহাল হতে হয়েছিল। এবারে কোনো একটা গূঢ় কারণে ফ্রান্সকে নিয়ে এতটা মাতামাতি হল। আমার মনে হয়েছে চন্দননগরের ঔপনিবেশিক ইতিহাস না জেনেই এত হইচই হয়েছে। এখানকার কিছু মানুষ চন্দননগরকে ফরাসী শহর বলে গর্ববোধ করেন। সেটা তাঁদের ভুল শিক্ষার ফল বলেই মনে হয়। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, ফরাসি সরকার আমাদের অনেক যত্নে রেখেছিল। প্রজাদের ওপর কোনও অত্যাচার করেনি। গোটা শহরটাকে অট্টালিকা আর বাঁধানো রাস্তা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল। এমনই সব ভুল ইতিহাস জেনেই ফ্রান্সকে নিয়ে গর্ব করে চন্দননগরের কতিপয় নাগরিক।
আসলে একসময়ে বেশ কয়েকটি ইউরোপিয় দেশ হুগলি নদীর তীরে বাণিজ্যের কারণে বসতি স্থাপন করে। পরে কুঠি গড়ে, উপনিবেশ স্থাপন করে। অন্যান্য শহরের মত ফরাসিরাও নিজেদের বাসস্থানের জায়গাটুকুই সাজিয়ে নিয়েছে এবং তা নিয়েছে এখানকারই অধিবাসীদের করের টাকায়। উপনিবেশ গড়ে রাজত্ব চালানোর সময়ে এরা সব কিছুর উপরেই কর চাপিয়েছে। হরিহর শেঠের বইতেই রয়েছে, ‘নদী দ্বারা যে সকল দ্রব্য আইসে এবং যাহারা পাইকারি বিক্রয় হয় তাহার উপর শতকরা এক টাকা কর দিতে হইত।’
এখানকার নাগরিকদের বিয়ে, বাড়ি ঘর তৈরি, নদী বা পুকুর থেকে মাছ ধরতে, এমন কি নিজের জমিতে ধান বা অন্য শস্য তুলতেও কর দিতে হত। তা ছাড়া জমি কিনলে সেলামিস, স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরে চৌখাই ইত্যাদি কর তো ছিলই। এই সব করের টাকাতেই তাদের নিজেদের সাদা অঞ্চল (Vill Blanche) সাজিয়ে তুলত। স্থানীয় নাগরিকদের বাসস্থানকে ওদের ভাষায় বলা হত ‘কালো অঞ্চল’ (Vill Noire)। সেসব অঞ্চলের প্রতি ওদের কোনও নজরই ছিল না।
হ্যাঁ একথা সত্যি, সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে চন্দননগরের ঐতিহ্য প্রাচীন কাল থেকেই। সেটা ছিল তাদের নিজস্ব লোক সংস্কৃতি। শিল্পে, ব্যবসায়ে, সাহিত্যে এক গৌরবজনক ঐতিহ্য তৈরি করেছিল নিজেদের কর্মকুশলতায়। কুটির শিল্পেও এই শহর এক বিস্ময়কর উন্নতি করেছিল। এখানকার বস্ত্রশিল্পের খ্যাতির কথা কে না জানে! ফ্রান্সে চন্দননগরের খ্যাতি ছিল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে। এই শহরকে একসময়ে বলা হত ‘বাংলার শস্যাগার’। সব মুছে গিয়েছিল এদের বদান্যতায়। মূলত বাণিজ্যের প্রয়োজনে এখানে কুঠি গড়ে রাজত্ব শুরু করে ফরাসিরা।
প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে ফরাসি ভাষা শিক্ষাও অবৈতনিক করে দেওয়া হয়েছিল। সরকারি স্কুলগুলিতে ফরাসি ভাষা ও ফরাসি ইতিহাস শিক্ষা শুরু হয়। ছাত্রছাত্রীদের মধ্য ঢুকিয়ে দেওয়া হত ইংরেজরা অত্যাচারী আর ফরাসিরা আমাদের গৌরবময়, স্বপ্নবৎ অতীত।
ফরাসিদের সম্বন্ধে আর একটি কথা শোনা যাচ্ছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে চন্দননগর এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল ফরাসি সরকারের সাহায্যে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই শহর বিপ্লবীদের এক কর্মকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এবং সেটা হয়েছিল ফরাসি সরকারের মদতে। এটাও একদম ভুল তথ্য। যেহেতু ফরাসি অধীনস্থ চন্দননগরে ব্রিটিশ আইন বা শাসন চলতো না, ফলে এখানে অনেক বিপ্লবী আত্মগোপন করার সুযোগ নিতেন। যেহেতু বিপ্লবীরাও ফরাসী সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করতো না, ফলে ফরাসীরাও এঁদের ঘাঁটাতেন না। কিন্তু ইংরেজরা যখনই সুযোগ পেতেন এখানে এসে তাদের ধরে নিয়ে যেতেন বা গুলি করে হত্যা করতো। ফরাসি সরকার এ ব্যপারে ইংরেজদের কিছুই বলতো না। এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে।
ভারত স্বাধীন হবার পরেও শহরটিকে নিজেদের দখলে রাখতে চেয়েছিল ফরাসি শাসকের দল। শহরের স্বাধীনতা সংগ্রামী দল প্রথমে আন্দোলন পরে ভোটাধিকার বলে তিন বছর পর শহরটিকে ভারতের অন্তর্ভূক্ত করতে সমর্থ হয়। ফরাসিরা তো চাইবেই তাঁদের গৌরবগাথা এখনও, ভারতের স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও তুলে ধরতে । আর এসব জেনেও এমন 'স্বর্ণোজ্জ্বল' ইতিহাস স্মরণ করে যদি চন্দননগরের মানুষ ফ্রান্সের জয়ধ্বনি দেয়, সেটা কি শহরের পক্ষে গৌরবের? ফরাসি ঔপনিবেশিক শহর বলে ফ্রান্সের জয়কে 'আমাদের জয়' বলাটা কি সম্মানের ?