scorecardresearch

রাজনীতির গণেশপুজো, গণেশপুজোর রাজনীতি

যাঁরা ভগবানকে নিয়ে ব্যবসা করেন, তাঁদের দায় থাকে বিধাতার অস্তিত্ব জাহির করার। কয়েকজন বন্ধুর পুজো বদলে যায় ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদের অর্থ এবং শক্তির প্রদর্শনীতে।

ganesh puja kolkata
কার গণেশ কত বড়?

কলকাতায় গণেশপুজোর বাড়বাড়ন্ত বেশ কিছুদিন ধরেই। এই সহস্রাব্দের শুরুতেও গণেশপুজোর খবর বিশেষ থাকত না এই রাজ্যে। উত্তর কলকাতার দিকে বাগবাজারে একটা পুজো বেশ জাঁকজমক সহকারে হতো। খুঁজলে হয়ত সারা কলকাতায় অতিপরিচিত বারোয়ারি গণেশ পুজোর খবর পাওয়া যেত খান বিশেক। এখন সেই সংখ্যা সম্ভবত তিন অঙ্ক পেরিয়ে চার অঙ্কের দিকে ছুটছে। তবে গৃহস্থবাড়িতে কিংবা দোকানে যদি গণেশের আরাধনার কথা ভাবেন, তাতে কিন্তু আগেও সংখ্যা কম ছিল না। অর্থাৎ সে সব জায়গায় গণেশ পুজোর সংখ্যা কিংবা ঘনত্ব হয়ত এখনও একইরকম।

কিন্তু অনেকগুণে বেড়েছে রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বারোয়ারি পুজোর আড়ম্বর। সেখানে বারোজন বন্ধু নেই, নিষ্ঠাভরে পুজোর পরিকল্পনা নেই, আছে সময়ের কোন এক ছোট্ট পরিধিতে কিছু রাজনৈতিক নেতানেত্রীর স্বার্থসিদ্ধির কৌশল। সিদ্ধিদাতা গণেশের প্রতি যাঁদের শ্রদ্ধা-ভক্তি খাঁটি, সে সংখ্যা খুব বদলায় নি। বেড়েছে যাঁদের বিশেষ শ্রদ্ধা-ভক্তি নেই তাঁদের দেখনদারি। আর সেখানেই গণেশের পুজো আর পুজো নয়। সেখানে অতিরিক্ত ভক্তির বেশিরভাগটাই ভণ্ডামি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুপ্রবেশ।

আরও পড়ুন: আসাম এনআরসি: খেরোর খাতায় বাঁধা পড়ছে দেশ

কলকাতার পথেঘাটে একদিকে তৃণমূল আর অন্যদিকে বিজেপির গণেশপুজোর যে প্রতিযোগিতা, তা যদি সত্যি গণেশ ঠাকুর দেখে থাকেন তাহলে সবচেয়ে হতাশ হবেন তিনিই। মায়ের চারপাশে সাতবার ঘুরে যে সন্তান সাতবার এ জগৎ পাক দেওয়ার মত উচ্চমানের দার্শনিক তত্ত্ব পেশ করতে পারেন, সেই হাতির মাথাওলা দেবতা আমাদের ঘরের ছেলে। রাজনীতির দাদা নন। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাংলায় গত এক দশকে যে প্রতিযোগিতামূলক ধর্মাচরণ কিংবা সাম্প্রদায়িকতার বাড়াবাড়ি, তার পেছনে দেবতাকে ভালোবাসা কিংবা ভক্তির যুক্তি অবান্তর। 

এই প্রসঙ্গে ভগবানে বিশ্বাস এবং ভগবানকে প্রমাণ করার একটি তুলনামূলক আলোচনার প্রয়োজন। দেবতাকে যাঁরা ভক্তি করেন, আনন্দে বা দুঃখে যাঁরা আশ্রয় চান কোনও এক অজানা স্নেহময় কোলে, তাঁরা কিন্তু দেবতার অস্তিত্ব জোর করে প্রমাণ করতে চান না। এই ভাবধারা মোটের ওপর উদারনৈতিক। ধর্ম যেখানে সুস্থ সমাজকে ধারণ করে, সেখানে মানুষে মানুষে হানাহানি কম। দেবতাও সেখানে ধ্বংস কিংবা মৃত্যুর দানবীয় রূপ নিয়ে হানা দেন না। দু’মাস ধরে যানজট পাকিয়ে কিংবা নিশ্চয়যান রুখে দিয়ে রাস্তার মাঝখানে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না আঝাড়া বাঁশের প্যান্ডেল। লাঠি কিংবা তরোয়াল শূন্যে পাক দিয়ে আল্লা বা রামের মাহাত্ম্য প্রমাণ করার এবং করানোর কোন দায় থাকে না সেখানে।

আস্তিক মানুষ ভগবানকে নিজের মনে রাখেন। মন্দির, মসজিদ কিংবা চার্চে নয়। দরকারে নিজের আনন্দে সেখানে প্রার্থনা করতে যান, কেউ বাধ্য করে না। তেমনই ইস্কুলের ছোট্ট সরস্বতী পুজো ভগবানকে বিশ্বাস করানোর থেকেও কিছুটা মহত্তর। এক বা দুদিন ধরে নবীন পড়ুয়াদের একসঙ্গে কাজ করার যে আনন্দ, এবং সেই আনন্দকে ভাগ করে নেওয়ার যে শিক্ষা, সেটাই সুস্থ সমাজবোধের পরিচয়। তেমনি আমাদের ঘরের পুজো। তা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। সেখান থেকে যখন কয়েকজন বন্ধু মিলে বাড়ির আচারকে পাড়ার বারোয়ারি পুজোয় পৌঁছে দেয়, সেখানেও থাকে সমাজবদ্ধ প্রাণীদের সামাজিক কর্মকান্ডের পরিচয়। 

আরও পড়ুন: বাংলার সমাজনীতি আর দেশের অর্থনীতি – চায়ে ভেজানো বিস্কুট

কিন্তু সময় এগোয় আর কয়েকশো বছর পরে সে পথেই আসে পুজোর রাজনীতি। সেই অন্য ধারায় যাঁরা ভগবানকে নিয়ে ব্যবসা করেন, তাঁদের দায় থাকে বিধাতার অস্তিত্ব জাহির করার। কয়েকজন বন্ধুর পুজো বদলে যায় ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদের অর্থ এবং শক্তির প্রদর্শনীতে। কার দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল কত উঁচু, কোথায় লোকের ভিড় বেশি, কোন পুজোটা তিন কোটির আর কোনটা সতেরো, কোনটার সভাপতি তৃণমূলের আর কোনটার বিজেপির, এই তর্ক যখন মুখ্য হয়ে পড়ে, তখন সেখানে ভগবানে বিশ্বাস করার দায় নেই।

তবে বিজ্ঞান ভুলে দেবদেবী প্রমাণের বাধ্যবাধকতা আছে। সেখানে মুনাফার গতিপ্রকৃতি বুঝে বিধাতার চলরাশিকে রাজনীতির সমীকরণে ঠুসে দেওয়ার ধান্দাটাই বেশি। ঠিক সেরকমই গণেশপুজোর রমরমা। এ মোটেই মুম্বইয়ের বহু বছর ধরে চলে আসা গণেশপুজোর ঐতিহ্য নয়, বরং এই বাংলায় তৃণমূল আর বিজেপির যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার আর একটি ইনিংস মাত্র। ভক্তি সেখানে মহম্মদ শামির শেষ ছয় ইনিংসের ব্যাটিং গড়। 

দেব বন্দনার দুরকমের দিক আছে। একটা হলো দৈনন্দিন ধর্মযাপন আর অন্যটা বছরের বিভিন্ন সময় বিশেষে তিথিনক্ষত্র ধরে। রোজ সকাল-সন্ধেয় পুজো-পার্বণের মাধ্যমে শুদ্ধ হওয়ার রীতি এ বাংলায় নতুন নয়। ঘরে ঘরে নিত্যপূজা তো থাকেই, সঙ্গে শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা ‘দেবতার জন্ম’ অনেকেরই মনে আছে। সেখানে রাস্তার ধারের একটা পাথর ধীরে ধীরে দেবতার রূপ নেয়। বাঙালির চলার গলি থেকে রাজপথে মা কালি অথবা শনিপুজোর মন্দির এ রাজ্যে অগুনতি। সেটাও আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। এমনটা হতেই পারে যে কেউ কখনও নিজের ধান্দায় এরকম কোন এক রাস্তার ধারের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে বসেছেন।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গির দিনগুলিতে দেশপ্রেম

কিন্তু এই উদাহরণ বিচ্ছিন্ন, এবং সার্বিকভাবে সে অনুসিদ্ধান্ত সত্যি নয়। সামাজিক বিবর্তনে অনেকটা সময় ধরে পথের পাশে গড়ে ওঠা ধর্মস্থান তাই প্রত্যক্ষভাবে কোনও এক বা একাধিক স্বার্থান্বেষী মানুষের লোভের ফল, এমনটা নাও হতে পারে। সেখানে ভক্তের আকুতিও বর্তমান। এরকম রাস্তার ধারের মন্দির বামফ্রন্ট আমলেও ছিল যথেষ্ট। তবে সে রাজত্বে পার্টি অফিসই সব ক্ষমতার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছিল, দেবালয় নয়। তখন মার্কসবাদই সর্বশক্তিমান, ফলে অন্যান্য দেবতা কিছুটা কম গুরুত্ব পেতেন।

তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর বাম-বিদায়ে এ রাজ্যে পুজো-পার্বণের সংখ্যা এবং জাঁকজমক বেড়েছে একলাফে। হয়ত রাস্তার ধারের পাথররূপী দেব সংখ্যায় খুব বাড়েন নি, তবে চাকচিক্য বেড়েছে প্রচুর। আর এখন তো একেবারে রমরমা। আরতির ঘণ্টা কিংবা শঙ্খধ্বনির জোর বেড়ে গেছে অনেকটা। বিজেপি যে এগোচ্ছে, তার প্রমাণস্বরূপ লাউডস্পীকার কিংবা হ্যালোজেন আলোর যোগান বেড়েছে পথের ধারের থানে। ভাঙা দেওয়ালে পড়ছে অপটু হাতের রঙের পোঁচ। কালচে হয়ে যাওয়া ফলপ্রসাদের বদলে শনিবার করে গরম খিচুড়ির জন্যে লাইন গড়াচ্ছে অনেক বেশি।

রোজকারের আরাধনার তুলনায় অনেক বেশি হইচই তারিখ মেনে পুজোতে। গতবছরের আনুমানিক হিসেব বলছে, এ রাজ্যে দুর্গাপুজোর অর্থনীতি এক লক্ষ কোটি টাকা। সেই অঙ্কে রাজনৈতিক নেতারা যে যুক্ত হবেন, তা বলাই বাহুল্য। এর সঙ্গে যদি অন্যান্য পুজোকেও আরও বেশি বিক্রি করা যায়, তাতে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে বৈকি। সঙ্গে দিল্লী থেকে হানা দেবে আয়কর দপ্তর আর তার বিরুদ্ধে চোখ রাঙাবে আমাদের রাজ্য। সময় কেটে যাবে বিভিন্ন দ্বন্দ্বের গল্পে।

সেরকমই আর এক দ্বন্দ্বের উদাহরণে সবশেষে আসতেই হচ্ছে। তা হলো দেবতাকুলের মাঝে বাঙালি এবং অবাঙালির সমীকরণ। রাম আমাদের মা দুর্গার অকালবোধন শুরু করলেও মোটের হিসেবে মা যতটা বাঙালির ঘরের মেয়ে, তুলনায় রামকে সেভাবে বাঙালি বলা শক্ত। তেমনই বারোয়ারি উৎসবমুখরতায় মা দুর্গা কিংবা মা কালি বাঙালির কাছে যতটা জনপ্রিয়, গণেশপুজো অথবা রামনবমী ততটা নয়। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বাংলার নেতাদের গণেশপুজোয় যাওয়া রাজনৈতিক কারণে। আবার সেখানেই অবাঙালি হিন্দুর অংশগ্রহণ অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। সাধারণ বাঙালিও হয়ত কখনও সখনও গণেশপুজোর হইচইতে সামিল হন, তবে তা সার্বজনীন নয়। তাই ধর্মভিত্তিক লড়াইতে দুই রাজনৈতিক দল যখন সরাসরি নেমে পড়ে, তখন তাদের কৌশলে একই ধর্মে বাঙালি-অবাঙালির দ্বন্দ্বও ছাড় পায় না।

সেই প্রেক্ষিতেও গণেশপুজো নিয়ে রাজনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত। কলকাতার আশেপাশে অবাঙালিদের ঘনত্ব অধিক বলেই গণেশপুজোর হইচই শহরে চোখে পড়ছে বেশি। এখানে বেশিটাই ভোটের অঙ্ক, যার ভাগ চাইছে দুই দলই। বাংলার গ্রামেগঞ্জে অবশ্য গণেশ ঠাকুর এখনও ততটা রাজনীতির অস্ত্র হন নি, নিত্যপূজায় গৃহস্থের ঘরেই রয়েছেন। বাংলার সনাতন আচারে তাঁর দেবস্থান তাই পুরোটা বদলে যায় নি। ধর্মবিশ্বাসী মানুষের কাছে এটুকুই ভরসা। বাকিটা দেখবেন রাজনীতির কারবারিরা। চন্দ্রযানে গণেশ ঠাকুরের মূর্তি রাখলে শেষ বাজারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হত কি না সে নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত তো আর গণেশভক্ত আমজনতা দিতে পারবে না। সেই প্রমাণের জন্যে গণেশপ্রেমী রাজনীতিবিদরাই ভরসা। উত্তর কিছু মিলবে কি? 

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Opinion news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Ganesh puja kolkata political rivalry tmc bjp subhamoy maitra