Advertisment

নওলাখা-তেলতুম্বে: অন্যায় ও নির্মমতার আরেকটি উদাহরণ

এই তদন্তকারী সংস্থা পক্ষপাতদুষ্ট। সমস্ত পাথুরে প্রমাণ থাকা সত্বেও মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় সাধ্বী প্রজ্ঞা কে ক্লিন চিট দিয়েছে এন আই এ। বিশেষ আদালতের বিচারপতি মানেন নি। হয়ত দেখব তিনি কোনোদিন বিচারপতি লোয়া হয়ে গেছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
anand teltumbe, gautam navlakha

জেলে যাবেন আনন্দ তেলটুম্বে ও গৌতম নওলাখা

"তু জিন্দা হ্যায় তু জিন্দেগি কি জিত পর ইয়াকিন কর.."

Advertisment

মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ আদেশে গৌতম নওলাখা এবং আনন্দ তেলতুম্বেকে আগামিকাল (১৪.০৪.২০২০) জেলে প্রবেশ করতে হবে। দুজনেরই বয়স ৬৫ বা তার চেয়েও বেশি।নানা শারীরিক অসুবিধায় আক্রান্ত। তবু যেতে হবে। কারণ ভারতের বিচার স্থাপত্যের সর্বোচ্চ চূড়া সুপ্রিম কোর্ট।তাই তার আদেশই শেষ কথা।

ক্ষমতার বিন্যাসে সুপ্রিম; ক্ষমতাও মারণাস্ত্র সম (lethal)। কিন্তু ন্যায়  বিচারের নিরিখে অভ্রান্ত , তাই  সুপ্রিম, এমনটা একেবারেই নয়। আলোচ্য ক্ষেত্রে সাদামাটা চোখেই দেখতে পারছি, কতটা ভুল। করোনার জন্যেএই একই সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ভারত   ব্যাপী সমস্ত জেলখানায় যাবজ্জীবন দণ্ডিত বন্দিদের, জামিন না পাওয়া বিচারাধীন বন্দিদের মুক্তির সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, রাজ্যে রাজ্যে বিচারপতির নেতৃত্বে সাময়িক "বন্দি মুক্তি" হয়েছে, তখন কিছু অনুমান, ধারণার ভিত্তিতে দুজনকে জেল হেফাজতে পাঠানো হচ্ছে পূর্ণ লক ডাউনের সময়ে। যেন তাঁদের জীবনের অধিকার অন্যদের তুলনা কম। যেন অন্য ধরনের নাগরিক তাঁরা, তাঁদের প্রতি করোনা ভাইরাসেরও অরুচি আছে। এই নির্মমতা ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত স্তম্ভ থেকে অপ্রত্যাশিত।

সুপ্রিম কোর্ট বারে বারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলেছে "ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের বিপুল আর্তনাদে"। দুজনের ক্ষেত্রে এবং আরো নয়জনের  মুক্তির দাবিতে এহেন বিপুল আর্তনাদ দেশ বিদেশ থেকে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়ালে দ্বারেই আটকে থাকে। রক্ত দর্শনই তাহলে ন্যায়বিচার? নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়েই ন্যায়বিচার সম্পাদিত হয় কিনা, সে কথা জিগেশ করি  নিজেকেl

আমেরিকা সহ নানা দেশে আইনি প্রকল্প আছে, যার মাধ্যমে বয়স্ক অভিযুক্ত বা দণ্ডিত বন্দিদের প্রতি সহৃদয়, সহানুভূতি (শারীরিক এবং মানসিক) দেখানো হয়, নিয়মিতভাবে বন্দি মুক্তি হয়।

এক্ষেত্রে ভারতে উল্টো পুরাণ হল কেন? প্রায় দুবছর ধরে বার বার বলা হচ্ছে, ভীম কোরেগাঁও মামলা সম্পূর্ণ সাজানো। যারা হিংসা করল, মৃত্যুর ঘটনা ঘটাল, তারা শাসক দলের তথা হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের অনুগামী বলে "বেকসুর" তকমা পেল। যাঁরা করলেন না, এমনকি এলগার পরিষদের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন না, তাঁরা সন্ত্রাসবাদী তকমা পেলেন, রাওলাট এর উত্তরসূরী ইউ এ পি এ - তে অভিযুক্ত হলেন। গল্পের গরু গাছে উঠল: বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কে মারার সড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত!

এই সংক্রান্ত রোমিলা থাপারদের জনস্বার্থ মামলায় (২০১৮) সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যালঘু রায়ে বিচারপতি চন্দ্রচূড় বললেন, প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা সংক্রান্ত কোনও তথ্যপ্রমাণ এদের ১১জনের বিরুদ্ধে নেই তা সরকারও স্বীকার করে নিয়েছেন।

তবু স্পেনীয় ইনকুইজিশনের কায়দায় যেন সবকিছু চললো। ম্যাকবেথ-এ পড়েছিলাম, "ফাউল ইজ ফেয়ার, ফেয়ার ইজ ফাউল"; তারই বাস্তব রূপ চাক্ষুষ করছি।

বিচারপতি থাকাকালীনই বিচারপতি অরুণ মিশ্র কদিন আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বন্দনা করলেন এবং তাঁর আদালত কক্ষেই দুজনের আগাম জামিনের আপিল মামলা তালিকা ভুক্ত হল।

ফলে যা হবার তাই হল। এটা যুক্তি হল সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের? অনেকদিন এই দুজন আদালতের সুরক্ষা পেয়ে আসছেন, তাই আর নয়! এর অন্তর্লীন অর্থ স্পষ্ট: এঁরা সেই সুযোগের অধিকারী ছিলেন না, আদালত দয়া দেখিয়েছেন। এবার চার দেওয়ালের ওপারে অদৃশ্য মনুষ্য জাতির অংশ হতে হবে।বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই সেই না-বলা বার্তা: এরা "অপরাধী"।

সার্বজনীন ন্যায়বিচারের যে অন্যতম প্রধান স্তম্ভ : অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নিরপরাধ - তাকে এই বার্তা কলুষিত করলো।

পশ্চিম বাংলার মানুষ হিসাবে কি আমরা ভুলে গেছি , সারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনারের সুদীর্ঘ সুরক্ষা, অবশেষে জামিন ও কর্মে যোগদান। ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ, তথ্য প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ, গ্রেপ্তার করতে এলে সি বি আই কে বাধাদান, আদালতের সুরক্ষা নিয়ে শিলং এ জেরায় হাজির, আত্মগোপন ইত্যাদির পরেও জামিন। এঁরা দুজন পালান নি, দীর্ঘ দিন নওলাখা গৃহবন্দি ছিলেন, তিনবার পুলিশের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন দুজন, তবু বন্দি নয় জন ও দুজনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত সম্পূর্ণ বিপরীত।

দুজনের আগাম জামিনের আবেদন বম্বে হাইকোর্টে ২০১৯ এর শেষের দিকে খারিজ করা হল, কিন্তু একটি অন্যায্য পদ্ধতির মাধ্যমে। বেশ কিছুদিন যাবৎ সুপ্রিম কোর্ট সিল বন্ধ খামে প্রদত্ত সরকারি রিপোর্ট অকাট্য প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করছেন। অভিযুক্তদের জানানোই হচ্ছে না কি লেখা আছে তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই রিপোর্ট পাঠ করে, অভিযুক্তদের সর্বজনীন ন্যায়বিচারের অধিকার - নিজের আত্মরক্ষার সুযোগ পাওয়া -- তাকে নস্যাৎ করে বিচারপতিরা অভিযুক্ত দের সম্পর্কে নেতিবাচক, সন্দেহভাজন ব্যক্তির ধারণা নির্মাণ করছেন। একাধিক প্রাক্তন বিচারপতিরা তীব্র ভাষায় এই প্রথার নিন্দা করলেও, এই প্রথা দিব্যি অনুসৃত হচ্ছে। বম্বে হাইকোর্ট এই প্রথা অনুসরণ করলেন ও দুজনের আগাম জামিনের আবেদন  নাকচ করলেন।

মহারাষ্ট্রের পুলিশ ও এন আই এ জানে মামলাটি সাজানো। তাই বিচার প্রলম্বিত করতে চায়। নানা অসাধু পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তারা, এমন অভিযোগ অভিযুক্তের আইনজীবীরা করে আসছেন তথ্য প্রমাণ সহ। এন আই এ ও তাই করবে। উপরন্তু, এই তদন্তকারী সংস্থা পক্ষপাতদুষ্ট। সমস্ত পাথুরে প্রমাণ থাকা সত্বেও মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় সাধ্বী প্রজ্ঞা কে ক্লিন চিট দিয়েছে এন আই এ। বিশেষ আদালতের বিচারপতি মানেন নি। হয়ত দেখব তিনি কোনোদিন বিচারপতি লোয়া হয়ে গেছেন।

সাধ্বীর বেলায় আঁটিশুটি!

দুজনের প্রতি নিষ্ঠুরতার সিদ্ধান্তের আঘাত সামলাতে না সামলাতে এসে গেলো দেশের প্রধান বিচারপতি দের আরেকটি পর্যবেক্ষণ। করোনা ভাইরাস হেতু হঠাৎ চার ঘণ্টার নোটিশে হাজার লাখ পরিযায়ী শ্রমিক, আমাদের দেশের নাগরিক, চরম দুর্দশার মধ্যে পড়লেন আদালত বলেন, সরকার তাদের খাওয়া, থাকার (?) ব্যবস্থা করেছে ।

তাই তারা হকের মজুরি পাবে না। ভাইরাস থেকে জীবন জীবিকা বাঁচানোর দায়িত্ব সরকারের। জীবিকার অর্থ দিয়ে তার জীবন, তার পরিবারের জীবন চলে। সেটা বন্ধ। সেটা সরকারের প্রজ্ঞা? সেই প্রজ্ঞার কোনও বিকল্প ভাবনা আদালত দেখবেন না? সুপ্রিম কোর্টের "উইজডম" সংবিধানের প্রতি একমাত্র দায়বদ্ধতা থেকে উৎসারিত। সরকারের স্বার্থ থাকে: তার প্রাজ্ঞতার চেয়ে তাই আদালতের প্ৰাজ্ঞতা অনেক ঊর্ধ্বে, তার বিবেচনা, পর্যবেক্ষণ ও বিচার শক্তি অন্য মাত্রার। তার হকের মজুরি পাওয়া, তার পরিবারের জীবন সুরক্ষা দেওয়ার কথা যখন আদালতের কাছে পেশ হয়েছে, তখন উচ্চতম ন্যায়ালয় তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারে? যদি হাজার লক্ষ বুভুক্ষু নিরন্ন নাগরিক সুপ্রিম কোর্টের দুয়ারে এসে বলেন, "মুখ ফিরালে, ফিরব না এইবারে।"

পরিবর্তে, এই নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা আমাদের বিবেক কে এক ভয়ানক প্রশ্নের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে: ন্যায়বিচার স্থাপত্যের চূড়াটি ভেঙ্গে পড়ছে?

ভাবি, জীবনের শেষ বেলায় এসে এটাও কি দেখতে হবে  বিচার বিভাগীয় প্রজ্ঞার একটি তালিকা তৈরি হবে; সরকারি প্রজ্ঞার আরেকটি। সেই সরকারি প্রজ্ঞা বিচারবিভাগের পর্যালোচনার বাইরে থাকবে?

পাশাপাশি, যৌথভাবে নতুন ভারত নামক জাতি  -  রাষ্ট্রের প্রকল্প রূপায়িত হবে?বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা, তার নাগরিকের অধিকারের  সুরক্ষার ক্ষেত্রে সক্রিয়তার উজ্জ্বল ভূমিকা অতীত হয়ে যাবে? সবকিছুর বিসর্জন দেখব আমরা?

(সুজাত ভদ্র মানবাধিকারকর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

supreme court Elgaar Parishad coronavirus
Advertisment