মধুরিমা দত্ত
ঘটনা এক
পুরুষের অধিকার নিয়ে কাজ করা এক সংগঠনের কর্ণধার বলছিলেন, “হেতাল পারেখকে দেখেছেন? কী বিচ্ছিরি যে দেখতে! ওকে কে রেপ করতে যাবে?”
ঘটনা দুই
বেসরকারি ব্যাঙ্কের লেনদেন পড়তির দিকে। জরুরি মিটিংয়ের ডাক। শুরুতেই মুনাফাবাজ বদমেজাজি বসের তীব্র ঝাঁঝ, “অফিসের রিসেপশনে যে এত মেয়ে বসালাম, আমার কোম্পানির লাভটা কী হল!”
ঘটনা তিন
মুর্শিদাবাদের কম আলোকপ্রাপ্ত একটি ছোট্ট শহরের কো-এড ইস্কুল। টিফিনের ঘন্টা পড়লেই ইস্কুলের গেটের সামনে হকারদের থেকে টিফিন কেনার হুড়োহুড়ি। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মেয়েরা বেরোতে পারবে না, নির্দিষ্ট দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন হেডমাস্টার। বলেছেন, “অবসর সময়ে মেয়েরা ছেলেরা একসাথে মিশলে সমস্যা আছে।“ কেন ছেলেদের তালা দিয়ে রেখে উল্টোটা করা হল না? উত্তর নেই।
ঘটনা চার
প্রথম সারির পত্রিকায় করিনা কাপুর, সানিয়া মির্জার ইন্টারভিউ। করিনাকে প্রশ্ন, “বিয়ের পরেও কি সিনেমা করবেন?” সানিয়াকে প্রশ্ন, “মা হচ্ছেন কবে?” কেন সইফকে জিজ্ঞেস করা হয় না বিয়ের পর সিনেমা করাটা তার কাছেও আদৌ ‘অপশন’ কিনা! মা হওয়া যদি বাধ্যতামূলক হয় তবে শোয়েব মালিকের বাবা হওয়াটা কেন বাধ্যতার আওতায় পড়ে না?
চারটি ঘটনার প্রত্যেকটিই বাস্তব এবং অনেকের জীবনে হররোজ শোনা খুব পরিচিত কথোপকথন মাত্র।
এখনও অর্ধেক আকাশ শব্দটার প্রতি মোহ কাজ করে হয়ত। আসলে বুঝি না, কীভাবে শারীরিক সৌন্দর্য, লিঙ্গভেদ, বিয়ে এবং মাতৃত্বের বাধ্যতা ছাড়া ওই অর্ধেক আকাশে আর কিছুই নেই। একদলকে প্রায়ই বলতে শুনি, সমাজ অনেক এগিয়ে গেছে। এখন আর আগের মতো লিঙ্গবৈষম্য নেই। মেয়েরাও তো চাকরি করছে। যেন মেয়েদের চাকরি করার কোনও কথাই ছিল না। করছে মানেই সব সমস্যা মিটে গিয়েছে। আবার চাকুরিরতা অনেকের মুখেই শুনি, “আমার শ্বশুরবাড়ি খুবই লিবারাল, আমাকে চাকরি করতে দেয়, জিনস পরতে দেয়।“ আসলে বুঝিই না, পরতে দেয়, করতে দেয়- এসব উচ্চারণের মধ্যেই মালিক আর ভৃত্যের সূক্ষ্ম রাজনীতি লুকিয়ে রয়েছে। মনে রাখতে হবে, পাইয়ে দেওয়া স্বাধীনতা, পাইয়ে দেওয়া অধিকারবোধের মতো ছদ্ম ঘাতক কিছুই নেই।
প্রায় কোথাও কোনও বিয়েবাড়িতে কোনও পুরুষকে গোলাপফুল দিয়ে অতিথিদের সম্মান জানাতে দেখিনি। ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনও মহিলা কসাই দেখিনি, মহিলা পুরোহিতও না। বাসন মাজা, কাপড় কাচার বিজ্ঞাপনে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনও পুরুষ চরিত্র নেই। ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই বিয়ের বিজ্ঞাপনে ঘরোয়া পাত্র চাই লেখা চোখেও পড়েনি। আবার “ওসব মেয়েছেলের (এক আশ্চর্য অর্ধনারীশ্বর শব্দ!) কাজ”- জাতীয় অবজ্ঞা বাক্যও রোজই শুনি। সুতরাং লিঙ্গবৈষম্য এখন আর ততটা নেই বলে যারা নিজেদের সান্ত্বনা দিতে চান তাদের কাছেই প্রশ্ন রয়ে যায়, সমস্যা নেই নাকি সমস্যাকে চিনতে ভুল হয় আজও?
সমস্যা তো শুরু হয় একটি শিশুকে মানুষ করার সময় থেকেই। মানুষ করি না, হয় পুরুষ করি বা নারী। কোন এক অজানা রোগাভ্যাস থেকে মেয়ে সন্তানের জন্য রান্না-বাটি আর বার্বিডল ছাড়া উপহার আমাদের মনেই পড়ে না। ছেলের বেলায় গতিময় গাড়ি আর খেলনা বন্দুক ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না। শিশুকন্যাটি শেখে, ‘বর আসবে এখুনি, নিয়ে যাবে তখুনি।‘ আর শিশু খোকাটি জানে, বীরপুরুষ হওয়াই ভবিতব্য। ছোট থেকেই, খুকু যাবে শ্বশুরবাড়ি, বর আসবে এখুনি আর হাঁটুর নিচে দুলছে খুকুর গোছা ভরা চুলের সৌন্দর্যের প্রতি কন্যাটির অলীক মোহ তৈরি করা হয়। সুতরাং এই শিশু কন্যা বড় হলে কন্যাশ্রীর টাকা যে আদতে মেয়ের বিয়ের জন্যই জমানো হবে এমন তো অলিখিত নিয়মই বলা যায়। ২০১৮ সালে এসেও বেটিকে পড়ানোর জন্য প্রধান উপায় হিসেবে রাখতে হয় বেটিকে বাঁচানো।
বেটি যদিও বা বাঁচল সে জানল গতর খাটানো কাজে তার মজুরি পুরুষের চেয়ে কমই হবে। বেটি বুঝল ধর্ষণ মানে আসলে ইজ্জত বা সম্মান চলে যাওয়া। যা কিনা তার শিক্ষা, চেতনা-জ্ঞান কোথাও না থেকে কেবল যোনিতেই থাকে। বেটি শিখল রিসেপশনের কাজে মেয়েদের ঢালাও সুযোগ দেওয়া আসলে বাজার টানতে শারীরিক সৌন্দর্য বিক্রির কৌশল মাত্র। বেটিকে মানতে হল সিঙ্গল মাদার শব্দটা হালফিলে ইন-ফ্যাশন হলেও সমাজের চোখ পুরুষ-বাবাকে না দেখে তিষ্ঠতে পারে না। ওই যে বলছিলাম, গলদটা গোড়াতেই। কেন একটা মানুষ ‘অর্ধেক আকাশ পেয়েছি এই না কত’- ভেবে শান্তি পাবে? কেন প্রতিটা মানুষ নিজস্ব আকাশ গড়ার স্বপ্ন দেখবে না? কথাটা নারী স্বাধীনতার নয় স্রেফ, কথাটা প্রতিটা মানুষের মৌলিক সুস্থ যুক্তির স্বাধীনতার, কথাটা সাম্যের। স্রেফ ক্রোমোজোমের ভিত্তিতে যেখানে কাজের এবং বেঁচে থাকার পরিধিকে ছোট করে দেওয়া হয় না।
রডে নয়, বরং চিন্তায় শান দিই।