ভারতের জনজীবনে কি 'জর্জ ফ্লয়েড মুহূর্ত' আসবে? এ তো শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ নয়, এ হলো পরিস্থিতির শিকার এক ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানোর গুরুত্ব অনুধাবন করা; প্রান্তিক মানুষদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতিত্ব উপলব্ধি করা; "আমরা" এবং "ওরা", এই গণ্ডিটা মুছে দেওয়া। সর্বোপরি এ হলো নাগরিক উদ্যোগের মুহূর্ত। অবিচার যে আসলে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত, সেই বোধের ধারাবাহিকতা যেন ইদানীং হারিয়ে যাচ্ছে ভারতে।
গত দু'মাস ধরে মিডিয়ায় আমরা দেখে এসেছি পরিযায়ী শ্রমিকদের যন্ত্রণার ছবি। এই যন্ত্রণার দুটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই 'হিউম্যান ট্র্যাজেডি' নিয়ে কোনোরকম প্রকাশ্য শোরগোল হয় নি, এবং যাঁরা এই পরিস্থিতির শিকার, তাঁরা প্রধানত নীরবেই কষ্ট সহ্য করে গেছেন। হয়তো নিজের মনে গজগজ করেছেন, স্বগতোক্তি করেছেন, কিন্তু আমাদের গণতন্ত্র তাঁদের সেই জোর দেয় নি, যার বলে তাঁরা নিজেদের অধিকার দাবি করতে পারেন। পরিযায়ীরাই শুধু নন, জনজীবনের মূলস্রোত থেকে বাদ পড়ার যন্ত্রণা ভোগ করেছেন সংখ্যালঘুরাও। এবং আরও ধারাবাহিক আকারে লাঞ্ছিত হয়েছেন মহিলা, গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র, দলিত, এবং আদিবাসীরা।
এখানেই প্রশ্ন ওঠে: ভারতের গণতন্ত্র কীভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষকে বলিপ্রদত্ত করেও এটা নিশ্চিত করে যে তাঁরা শান্তভাবেই মেনে নেবেন এই ব্যবস্থা? ভারতীয় গণতন্ত্রের এই অতিরিক্ত শান্তভাব নিয়ে কিন্তু আত্মসমীক্ষা এবং পরীক্ষানিরীক্ষা হওয়া দরকার। তিন সেট উত্তর কল্পনা করা যেতে পারে - গণতন্ত্র সম্পর্কে কিছু জাতিগত উত্তর; রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের চরিত্র সংক্রান্ত ইতিহাস ভিত্তিক উত্তর; এবং কিছু উত্তর যা আমাদের সমসাময়িক কালে নিয়ে আসে।
আরও পড়ুন: ঘাড়ের ওপর হাঁটুর চাপ
গণতন্ত্রের একটি কুখ্যাত প্রবণতা রয়েছে, কালক্রমে আপাতবিরোধী হয়ে পড়ার। শুরু হয় 'ডেমস' (গ্রীক ভাষায় 'জনতা')-এর নামে, তবে এই ডেমস-এর গণ্ডিটা পরবর্তীকালে সংকীর্ণ হতে থাকে; প্রায়শই দেখা যায়, একদল মানুষ নিজেদের 'জনতা' শ্রেণীভুক্ত করে ফেলতে সক্ষম হন, তাঁরাই তখন 'জনতা' হিসেবে গণ্য, তাঁদের আইডিয়াই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আইডিয়া হিসেবে পেশ করা হয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় নানা স্তরের নাগরিকের। এছাড়াও 'ডেমোক্র্যাসি' প্রাথমিকভাবে ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা প্রদান করে বটে, তবে পরবর্তীকালে সেই ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় অজ্ঞানের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার অজুহাতে।
অধিকার সম্পর্কে নানা ধারণার অনুপ্রেরণা যোগায় গণতন্ত্র, তবে শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সেই অধিকার খর্ব করার অনুমতিও দেয়। অল্প কথায় বলতে গেলে, অভিজাত এবং আমজনতা, সক্রিয় নাগরিক এবং বাধ্য নাগরিক, অধিকার এবং শৃঙ্খলা, এদের মধ্যে টানাপোড়েন নিয়েই গণতন্ত্রের জীবন। এটা কিন্তু স্রেফ তত্ত্ব এবং বাস্তবের মধ্যে, অথবা ধারণা এবং রোজকার জীবনের মধ্যে তফাতের গল্প নয়। এ হলো গণতন্ত্রের ধারা যে পূর্বনির্ধারিত, তা কল্পনা করে নেওয়ার গল্প। গণতন্ত্রের রাজনীতির পথ অনেক চেষ্টায় খোদাই করে নিতে হয়। আনুষ্ঠানিক ভাবে গণতন্ত্র গ্রহণ করা মানেই যে সেই গণতন্ত্র আপনা থেকেই মজবুত হবে, এই বিশ্বাস অমূলক।
রাষ্ট্রের জীবনে নাগরিক অংশগ্রহণ সম্পর্কে ভারতীয় রাষ্ট্রের মনোভাবে বরাবরই প্রকাশ পেয়েছে ঔদ্ধত্য। এছাড়াও রয়েছে আইন-শৃঙ্খলার আলঙ্কারিক অর্থের ওপর অতিরিক্ত জোর। প্রথম ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এই ধারণা জন্মায় যে নাগরিকরা সক্রিয় প্রতিনিধি হতে পারেন না। অর্থাৎ নাগরিকরা অপেক্ষা করবেন একজন নেতার, যিনি তাঁদের সচল করে তুলবেন এবং তাঁদের পথ দেখিয়ে পরবর্তীতে তাঁদের কার্যকলাপের তদারকি করবেন। একইভাবে, তাঁদের পক্ষে কী ভালো, তা স্থির করবে রাষ্ট্র। এই ধারণা থেকেই জন্ম নেয় পিতা-মাতার প্রতিভূ হিসেবে সরকার, এবং রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক হিসেবে নেতাদের চিত্র। পিতা-মাতা স্থানীয় রাষ্ট্র যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকা নেই, আইন-শৃঙ্খলার ওপর জোর দিয়ে সেই সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেওয়া যায়। সুতরাং অধিকার এবং ব্যক্তি মর্যাদা নিয়ে আলোচনা ততক্ষণ পর্যন্তই অনুমোদিত, যতক্ষণ সেগুলি "শৃঙ্খলা" সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় ধারণার বশবর্তী।
প্রতিবাদী নাগরিকের যে ধারণা আমরা করি, তার বিরুদ্ধে একজোট হয় আইন প্রণেতা, বিচার ব্যবস্থা, এমনকি জনমতও। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের যে উত্তরাধিকার, তার বিরুদ্ধে গিয়েই গণতন্ত্র এবং নাগরিক অংশগ্রহণকে তত্ত্ব এবং আইন, দুইয়ের নিরিখেই দেখা হয় শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজের পক্ষে অসঙ্গত, এমনকি বিপজ্জনক হিসেবেও। হোক সে একে গোপালন মামলা (১৯৫০), অথবা বর্তমান সময়ের কুখ্যাত ইউএপিএ, দুটি বিষয়ের ওপর মূলত জোর দেওয়া হয়: রাষ্ট্র জানে, রাষ্ট্রই ঠিক, রাষ্ট্রের সুবিধা অগ্রগণ্য; এবং নাগরিক উদ্যোগ সন্দেহভাজন, সম্ভবত বিঘ্নকারী, এবং শাস্তিযোগ্য।
আরও পড়ুন: এখনও সময় আছে, গরীবের হাতে নগদ টাকা ধরিয়ে দিক সরকার
অধিকার নিয়ে অবদমিত আলোচনা এবং সাধারণ মানুষের কর্তৃত্বকে বেআইনি গণ্য করার এই প্রেক্ষিতে আমরা এসে পৌঁছেছি এমন এক মুহূর্তে, যেখানে সমালোচনা প্রায় দেশদ্রোহিতার সামিল, প্রান্তিক গোষ্ঠীদের অধিকারের দাবি মানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, এবং সামাজিক অবিচারের শিকার কারোর প্রতি সহমর্মিতা দেখানো হয় হাস্যস্পদ, নাহয় নিষিদ্ধ। বর্তমান শাসনব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপকে এক ভয়াল শিল্পে পরিণত করেছে।
যেহেতু জুন মাসে এই আলোচনা করছি আমরা, ১৯৭৫-এ রাষ্ট্রযন্ত্রকে যে কিঞ্চিৎ কাঁচাভাবে দখল করে নিতে চেয়েছিল সরকার, সেকথা ভুলে গেলে চলবে না। তবে এখন যেভাবে নাগরিকদের চুপ করিয়ে রাখা হচ্ছে, তা আরও অনেক সুনিয়ন্ত্রিত এবং সমন্বিত। তবু বলব, প্রতিবাদী নাগরিকদের যেভাবে দমন করেছে রাষ্ট্রযন্ত্র, সেই উদাহরণ দেখিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর মেলে না যে, "অন্য কারোর" প্রতি চূড়ান্ত অবিচার হতে দেখেও কেন নীরব নাগরিক সমাজ।
ব্যাজস্তুতি মনে হতে পারে, তবে দমনের মাত্রা তুলনামূলক ভাবে বেশি হওয়া সত্ত্বেও গণপ্রতিবাদ যে নেই, তার একটা কারণ হলো যে যন্ত্রণা বা অবিচারের শিকার কেউ হতে পারে, সেই ধারণাটাকে শুধু অবৈধ নয়, জনমানসে অদৃশ্য করে দিতেও সক্ষম হয়েছে বর্তমান শাসনতন্ত্র। এই কথনে যা বাস্তব, তা আসল বাস্তবের বিপরীতে হাঁটে।
এই বিকল্প বাস্তবের দুনিয়ায় যে শিকার, সে আসলে অপরাধী (যেমন মুসলমান), যন্ত্রণা হলো ত্যাগের নামান্তর, অথবা অজ্ঞানতা-জনিত অতিকথন (উদাহরণ, পরিযায়ী শ্রমিক), এবং প্রান্তিকতা হলো পূর্ব রাজনীতির ফলাফল (যেমন দলিত বা আদিবাসীদের ক্ষেত্রে)। এই কথনে দুটি পরস্পরবিরোধী সামাজিক শিবির রয়েছে। এক হলো রাষ্ট্র। যা একতা, উন্নতি, এবং সম্ভাব্য কালজয়ের প্রতীক। বাকি সব ভঙ্গুর এবং বিভাজন সৃষ্টিকারী। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশার কথা বলা মানেই রাষ্ট্রের এগিয়ে চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো; প্রান্তিকরা সঙ্ঘবদ্ধ হলেই বাজতে থাকে রাষ্ট্রবিরোধী সুর।
আরও পড়ুন: বিশ্বাস করুন, আর নেওয়া যাচ্ছে না!
এই কথনের শক্তি এমনই যে, সাড়া জাগানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে যন্ত্রণা, লাঞ্ছনা, অথবা অবিচার। এগুলিকে আর কলঙ্ক মনে হয় না, কোনোরকম নৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। এমন কথন যা সত্যকে ভেঙে গড়তে পারে, এবং সেই ভাঙাগড়ার বৈধতা সম্পর্কে আমজনতাকে আশ্বস্ত করতে পারে। তখনই গণতন্ত্রে সহবাস করে একাধিক অবিচার, এবং নীরব নাগরিক সমাজ। বর্তমান নীরবতার নেপথ্যে রয়েছে ভেঙে গড়া বাস্তবের গণ স্বীকৃতি, এবং বিকল্প নীতিবোধের প্রতি আনুগত্য।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বলেন যে জর্জ ফ্লয়েড "ওপর থেকে দেখছেন" এবং বলছেন যে (বেকারত্বের হার হ্রাস পাওয়া) "আমাদের দেশের পক্ষে... বিরাট ব্যাপার", তিনি কিন্তু ফ্লয়েডের পরিণতিকে উল্টেপাল্টে দিচ্ছেন, নতুন করে গণতন্ত্রের ব্যাকরণ লিখছেন। ফ্লয়েডের হত্যা নয়, এই মুহূর্তের খবর হলো বেকারত্বে সামান্য হ্রাস; ফ্লয়েড তাঁর খুনির প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন না, তিনি অর্থনীতির দশা দেখে ক্রুদ্ধ হতেন; সুতরাং একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতিত্ব বদলানোর প্রয়োজন নেই, বরং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে অসম্মান বহন করে এনেছে, তা মুছে ফেলা প্রয়োজন।
এই বক্তব্যটি একটু মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যাবে, ভারত বর্তমানে তার একান্ত নিজস্ব 'ফ্লয়েড মুহূর্ত' খুঁজে পেয়েছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন