Advertisment

ঘাড়ের ওপর হাঁটুর চাপ

অন্তর্জাল ঘেঁটে অল্প পরিশ্রমেই বোঝা যায় যে চিন, কঙ্গো, উত্তর কোরিয়া এসব দেশে গণতন্ত্রের সূচক নিয়ে আলোচনা করা বৃথা। অর্থাৎ ঘাড়ের ওপর হাঁটুর সার্বিক ব্যপ্তি যে বিশ্ব ইতিহাসের মূল বিষয় তা নিয়ে কোন ধন্দ নেই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
floyd USA

অলংকরণ- অভিজিত বিশ্বাস

জর্জ ফ্লয়েডের সঙ্গে কোন অস্ত্র ছিল না। পুলিশদের যে তিনি ব্যাপক আক্রমণ করেছিলেন এমনটাও জানা নেই। যে সমস্ত গল্প শোনা যাচ্ছে, তাতে গত ২৫শে মে নাকি জাল নোট দিয়ে সিগারেট কিনতে যান জর্জ। দোকানের মালিক মাইক আবুমায়ালের বক্তব্য অনুযায়ী জাল নোটের কথা বলা সত্ত্বেও জর্জ সিগারেটের প্যাকেট ফেরত দেন নি, এবং তাঁকে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ মনে হয়েছিল। তারপর বাইরে একটা গাড়িতে বন্ধুদের সঙ্গে বসে ছিলেন জর্জ। এইসময় দোকান থেকে ফোন করে মার্কিন পুলিশকে অভিযোগ জানানো হয়। তারা এসে জর্জকে বন্দুক দেখিয়ে গাড়ি থেকে নামায়। এর মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়ে থাকতেও পারে। হাতকড়া পরতে না চাওয়ার অভিযোগে তাকে মাটিতে ঠুসে ধরে পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিন। গাড়ির পেছনের চাকার ঠিক পাশে এই ঠুসে ধরাটা প্রমাণিত সত্য। তার আগেটুকু নিয়ে বিভিন্ন বর্ণনা এবং তর্কবিতর্ক থাকবে। সে বিচার অনেকটা সময় ধরে চলবে মার্কিন দেশে। ব্যাখ্যা থাকবে ডজন কয়েক। তবে আট মিনিটেরও বেশি সময় ধরে ঘাড়ের ওপর হাঁটুর চাপ সকলেই দেখেছেন ভাইরাল ভিডিও-তে। ছেচল্লিশ বছরের জর্জ মরলেন চুয়াল্লিশ পূর্ণ করা ডেরেকের হাঁটুর বাড়াবাড়িতে, মিনিয়াপোলিসে। আর সেই প্রসঙ্গেই “কালো জীবনের অধিকার” সংক্রান্ত শ্লোগান পেরিয়ে সবশেষে সারসত্য উঠে এসেছে — “আমার ঘাড় থেকে তোমার হাঁটু সরাও”।

Advertisment

লকডাউন ও মহম্মদ রফির ভাই

ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর উত্তাল মার্কিন দেশ। ভাঙচুর কিংবা লুটপাটও হয়েছে যথেষ্ট। তাঁর স্মরণ এবং শেষকৃত্যে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ। রেভারেন্ড শার্পটন বলেছেন, “আমরা সারা বিশ্বজুড়ে এই প্রতিবাদের মিছিলে, কারণ আমাদের সবার অবস্থা জর্জের মত। আমরা শ্বাস নিতে পারছি না। চলো, জর্জের নামে উঠে দাঁড়াই, আর গর্জে উঠি, আমার ঘাড় থেকে তোমার হাঁটু সরাও।” আট মিনিট ছেচল্লিশ সেকেন্ডের নীরবতা পালন করতে বলেছেন তিনি, ঠিক যতক্ষণ ডেরেকের হাঁটু জর্জের ঘাড় দাবিয়েছিল। এই যে হাঁটু দিয়ে ঘাড়ের ওপরটা ডলে দেওয়া, চেপটে যাওয়া মানুষটা যত ক্লান্ত হয়ে পড়বে তত তাকে আরও বেশি করে রাস্তার সঙ্গে লেপটে দেওয়া, যত তার নড়াচড়া কমবে তত জয়ের উপলব্ধি, এই জায়গাটিতেই একটা অংশের মানুষের পরিতৃপ্তি। সেখানে কিন্তু ডান-বাম নেই। হিটলার কিংবা মুসোলিনির অত্যাচার অথবা স্টালিন কিংবা চাওসেস্কু, ঈশান থেকে নৈঋত সব কোণেতেই শাসকদের রক্তচক্ষু মাথা থেকে পা পর্যন্ত লম্বা। যেকোন অঙ্গ ব্যবহার করে শাসক চেপে ধরতে পারে শাসিতের ঘাড়। সেখানে ক্ষমতা পেলেই অন্যকে অত্যাচার করার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা, তা মানুষেরই চরিত্র। আর শাসক তো আরও বেশি করে মানুষ, আরও অনেকটা বড় আকারের মানুষ — শরীরের মাপে না হলেও হিংস্রতায়। একটু গুছিয়ে ভাবলে দেশের রাজা, গজা, মন্ত্রী, পারিষদ, পুলিশ, প্রশাসক, তাদের চেলা, চামুণ্ডা সব মিলেমিশে বেশ কয়েকটা লোক, যাদের সংখ্যা শতাংশের হিসেবে নগণ্য, কিন্তু ক্ষমতা অসীম। এরাই তিয়েন আন মেন স্কোয়ার থেকে হংকং পর্যন্ত কম্যুনিস্ট নামে লোক ঠ্যাঙ্গায়। এরাই আফগানিস্থানের তালিবান, মধ্যপ্রাচ্যের আইএসএস, সংস্কারের নামে সরকারি সাহায্যকে চুলোয় পাঠানো ফ্রান্সের ম্যাক্রঁ, ক্ষমতা দখলের পথে প্রচুর বিরোধী লাশের ওপর দিয়ে হাঁটা তুর্কীর এরগোদান, নিজের দেশে বিরোধীদের ভ্যানিশ করে দেওয়া পুতিন সাহেব, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমাদের দেশেও শাসকের অভাব নেই। কেন্দ্র, রাজ্য, পৌরসভা, পঞ্চায়েত, গ্রামের সমবায়, পাড়ার ক্লাব, সব জায়গাতেই শাসক এবং প্রশাসক। একজন আসে একজন যায়। অত্যাচার নির্মূল হয় না কখনো। শাসকের মুখ দেখে কিছুটা বাড়ে কমে এই আর কি। যেমন ট্রাম্পকে যদি ওবামার সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে আপাত পার্থক্য একেবারে পরিষ্কার। ওবামার আট বছরের শাসনকালে কি মার্কিন দেশে পুলিশি অত্যাচারের গল্প নেই? অবশ্যই আছে। তবে ঠিক এতটা বাড়াবাড়ি বোধহয় হয় নি। তার কারণ আইনরক্ষকরা জানতেন যে দেশের মাথায় এমন একজন মানুষ বসে আছেন যিনি কিছুটা সংবেদনশীল। সোভিয়েত দেশে ব্রেজনেভকে মনে পড়ে, যখন সে দেশটা ভাঙল? সে স্বাধীনতা কিন্তু বেশিদিন টানতে পারলেন না সেখানকার মানুষজন। তার থেকে পুতিন যে অনেক বেশি কঠোর এমনটাই মনে হয় হাবভাব দেখে। আজকের দিনে রাশিয়াতে মানুষের স্বাধীনতা দিন দিন কমছে। অন্তর্জাল ঘেঁটে অল্প পরিশ্রমেই বোঝা যায় যে চিন, কঙ্গো, উত্তর কোরিয়া এসব দেশে গণতন্ত্রের সূচক নিয়ে আলোচনা করা বৃথা। অর্থাৎ ঘাড়ের ওপর হাঁটুর সার্বিক ব্যপ্তি যে বিশ্ব ইতিহাসের মূল বিষয় তা নিয়ে কোন ধন্দ নেই। তবে ইউরোপের কয়েকটি দেশ, বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয়া, আবার দক্ষিণ গোলার্ধে নিউজিল্যান্ড এরকম কয়েকটি জায়গা আছে যেখানে হাঁটুর চাপ সত্যিই কম।

সবশেষে ফিসফিস করে নিজের দেশ বা রাজ্য নিয়ে আলোচনা করার দায় থাকে। এ প্রসঙ্গে ঘটমান বর্তমানে না ঢুকে বরং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা যাক। মনমোহনবাবুকে তো শাসক বলে মনেই করতেন না ভারতের মানুষ। সেই সময় দেশে গণতন্ত্রের সূচক আজকের থেকে তুলনায় ভালো তো ছিলই। আর রাষ্ট্রের দাদাগিরির দায় বর্তাতো কংগ্রেস সভানেত্রীর ওপর। ফলে বেশিদিন রাজত্ব করা প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে হাঁটুর জোর কম থাকার তালিকায় মনমোহন স্যার একেবারে শুরুতে। বুদ্ধদেববাবুও যে বেশ সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন এমনটাই বলেন অনেকে। তবে এক নন্দীগ্রামই তাঁকে খলনায়ক করে দিয়েছে, সঙ্গে অমর উক্তি ২৩৫ বনাম ৩৫ তো সেই হাঁটুরই মাপ। আজকাল অবশ্য অনেকে হাঁটুকে ছাতি বলেন।

‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বললেই কাজ হয়ে যায় কি?

তাই সেই সব হিসেবের সঙ্গে আজকের তুলনায় নাই বা এলাম আমরা। দেশ চালাতে হাঁটুর জোর যে লাগে সে কথা হাড়ে হাড়ে বোঝেন সকলেই। তবে শাসকের ক্ষেত্রে তা হাঁটুর কঠিন মালাইচাকি, আর শাসিতের ভাগে ঘাড়ের তরুণাস্থি। আপাতত তাই কোভিড পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ঘরে থাকাই ভালো। এখন কিছুতেই জামিন না হওয়া জামিয়া মিলিয়ার পড়ুয়া সফুরা জারগারের কথা আলোচনা করব না আমরা। তিনি গর্ভবতী? তাতে কি? কাত হয়ে লিখতে লিখতে আমার ঘাড়ে ব্যাথা। হাঁটুদের তাই দূরে রেখেছি। সামনে উচ্চমাধ্যমিক, কিন্তু আনফানের পর থেকে রাস্তায় তাঁবু খাটিয়ে পড়াশোনা করছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার যে মেয়েটা তাকে আমি একেবারেই চিনি না। তার কাছে টাকা না পৌঁছে কার্নিক খেয়ে তা দোতলা বাড়ির মালিকের কাছে পৌঁছে গেছে? এমন তো হতেই পারে। অ্যাকাউন্ট নম্বরের সামান্য গণ্ডগোল। বারবার বলছি না আমার স্পন্ডেলাইসিস আছে। আপনাদেরও বলিহারি। এইসব কথা তুলে ঘাড় শক্ত না করেই হাঁটুকে ওয়েলকাম করছেন। এরকম করলেই তো ঘাড় ফাটবে, একঘর পিছিয়ে হাঁটুর চন্দ্রবিন্দু ধার করে। তাই দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করুন, “আমার দেশ, আমার রাজ্য, আমার শহর, আমার পাড়া গণতন্ত্রের সূচকে শীর্ষে, এখানে এক্কেবারে হাঁটুর দোষ নেই”। অনেক নিশ্চিন্তে, ঝামেলা না বাড়িয়ে, দূর দেশের জর্জ ফ্লয়েড কে নিয়ে আপাতত ছোটবেলায় মুখস্ত করা পঙক্তিগুলো বারান্দায় থালা বাজিয়ে সুরে বাঁধি, “ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না ……।”

প্রস্তুত থাকুন, সামাজিক দূরত্বের আপতকালীন দিনগুলিতে ঘাড়ের ওপর হাঁটুর চাপ আরও অনেকটা বাড়বে। এই সময় ঘাড়ের ওপর মাথাটুকুই থাক, মস্তিষ্ক উহ্য।

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

Anyo Paksha
Advertisment