গিরিশের সঙ্গে আমার ঠিক কবে আলাপ, সে কথা মনে নেই। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মেম্বার ছিল গিরিশ, আমিও তাই। তখনই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সূত্রপাত। তারপর বহু বছর ধরে নাট্য প্রশিক্ষণের নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, কখনও আমরা সহমত হয়েছি, কখনও দ্বিমত হয়েছে।
পরবর্তীকালে গিরিশ সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যাকে বলে স্টঞ্চ, রেসপন্সিভ এবং আউটস্পোকেন ছিলেন। নিজের বক্তব্য ছিল সোচ্চার, স্পষ্ট ভাষায় নিজের কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করতেন না। রেখে ঢেকে গিরিশ কথা বলতেন না।
ওঁর নাটক সম্পর্কে বলার কিছু নেই, বহু লোক বলেছেন। ওঁর নাটকের মধ্যে যেটা আমার মনে হয়েছে, একটা কোথাও... 'তুঘলক' নাটকটা আমরা একটা যৌথ উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তাতে কেয়া পার্ট করেছিলেন, আমি ছিলাম একটা চরিত্রে, কুমার রায় করেছিলেন। নাটকটা চলেনি। সত্যি কথা বলতে কী, প্রোডাকশনটা তেমন ভাল হয়নি। আমরা অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে... বোধহয় কোহেশনটা ঠিকমতো হয়ে ওঠেনি। শ্যামানন্দ জালান ছিলেন প্রোডাকশনটার নেতৃত্বে। এটা একটা যৌথ অভিজ্ঞতা ছিল।
এছাড়া নান্দীকারের তরফ থেকে প্রতি বছর নাট্যমেলায় আমরা যে একজন নাট্য ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা প্রদর্শন করে থাকি, তার মধ্যে একবার গিরিশ কারনাডকেও আমরা সম্মান প্রদর্শন করেছিলাম, মানে সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেরা সম্মানিত হয়েছিলাম। সেবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। সম্মান দেওয়ার সময়ে আমি বলেছিলাম যে আমাদের সাধ্য বড় কম, অর্থ জোগাড় করতে বড় কষ্ট হয়, তাই আমরা এই ১০,০০১ টাকা দিতে পারছি। এ অর্থের পরিমাণ দিয়ে আমাদের আদর বা আমাদের সম্মাননা পরিমাপ করা যাবে না, তবে এটা ঘটনা যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের যে অর্থমূল্য, এটা তার চেয়ে এক টাকা বেশি। গিরিশ এটা শুনে জিজ্ঞাসা করেন, "তাই, তাই?" এর পরের বছর থেকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০ হাজার টাকা থেকে এক লাফে দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তখন গিরিশ বোধহয় সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান ছিলেন। তার পরের বছর থেকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপকরা বেশি টাকা পেতে শুরু করেন।
আর গিরিশ, আগেই যা উল্লেখ করলাম - সব বিষয়ে সোজা করে স্পষ্ট করে নিজের মত বলতেন। ওঁর নাটকও তাই। থিয়েটার যেহেতু সমাজের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত, সেই সমাজ বিষয়ে ওঁর মতামত ছিল খুব স্পষ্ট। ওঁর নাটকের মধ্যেও, যেহেতু উনি একদিকে রোডস স্কলার, বিদেশি শিক্ষা ভাল করেই পেয়েছিলেন, আবার এদিকেও একই সঙ্গে সংস্কৃতজ্ঞ, পুরাণজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ - এই নিয়ে ওঁর নাটকের মধ্যে একটা ছাপ দেখা গেছে। সব সময়ে সেটা সুসংহত কিনা বলতে পারব না। 'তুঘলক' করতে গিয়ে আমরা দেখেছি যে সাংস্কৃতিক ভাবে একটা চকচকে ভাব রয়েছে এবং সেটা সবসময়েই যেন একটা প্রশ্ন তুলে দেয় আর কী! এখন অনেক দিন হয়ে গেছে, ভুলে গেছি সেগুলো ঠিক কী ছিল, তবে খটকা গুলো মনে রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়ে গিরিশ বলেছিল যে উনি নাট্যকার হিসেবে দ্বিতীয় সারির। সে নিয়ে আমি ওঁকে বলেছিলাম "পাঠকের রসাস্বাদনের যে জায়গাটা, সেটায় তুমি ব্যর্থ হয়েছ।" কিন্তু এখন মনে হয়, বাঙালি পাঠকও তো রবীন্দ্রনাথ পাঠে ব্যর্থই হয়েছেন। শম্ভু মিত্র 'রক্তকরবী' মঞ্চায়িত করার আগে পর্যন্ত তাঁর নাটককে তো বলা হত যে সেগুলো মঞ্চায়নযোগ্য নয়। যাঁরা এসব বলতেন, তাঁদের প্রযোজনার অভিজ্ঞতা কী আমি জানি না। হয়ত তাঁরা ছেলেবেলায় 'মটুক' করেছিলেন, সেখান থেকেই এসব বলতেন। কিন্তু এসবে ক্ষতি হয়ে গেছে। একটা খবরের কাগজে 'ডাকঘর'-এর সমালোচনা করতে গিয়ে একজন বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের বিষয় ভাল, কিন্তু নাটক ভাল না, নাকি নাটক ভাল, সংলাপ ভাল না - এরকম কিছু একটা। এসবে বড় ক্ষতি হয়ে যায় তো!
সব কিছু মিলিয়ে গিরিশ ভারতের নাট্য জগতকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সে জায়গায় তিনি মৃত্যুহীন রয়ে যাবেন।
(রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বাংলা তথা ভারতের নাট্য ব্যক্তিত্ব, নান্দীকার নাট্যসংস্থার কর্ণধার)