Advertisment

অন্য পক্ষ: ঠিক কত নম্বর পেলে কলেজে পড়া যায়?

ধরা যাক একজন ছাত্রী আশি শতাংশ নম্বর পেল উচ্চমাধ্যমিক স্তরে। কোনোভাবেই খারাপ বলা যাবে না। কিন্তু কলকাতার কোন সাধারণ মানের কলেজে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হতে গেলেও এই মূল্যমান যথেষ্ট নয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Graduation Entrance, Higher Education

প্রতীকী ছবি (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ফাইল)

উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সব পরীক্ষা শেষ হয়ে কলেজে ভর্তি হওয়া প্রায় সম্পূর্ণ। সারা দেশজুড়ে এরকম পড়ুয়ার সংখ্যা অবশ্যই এক কোটির আশে পাশে। শুধু প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতকস্তরেই ভর্তি হয় প্রায় ১৫ লক্ষ ছেলেমেয়ে। এর মধ্যে অবশ্য সরকারি জায়গায় (কেন্দ্র এবং রাজ্য মিলিয়ে) আসনের সংখ্যা এক লক্ষের বেশি নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে সরকারি এবং বেসরকারি দুক্ষেত্রেই আসনের সংখ্যা ৩০ হাজারের কাছাকাছি। আমাদের দেশে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বাজেট অবশ্যই প্রতিরক্ষার তুলনায় কম। তবু শুধু শিক্ষাতেই এ বছরের বরাদ্দ ৯৪ হাজার কোটি টাকার বেশি, তার মধ্যে উচ্চশিক্ষায় খরচ ৩৮ হাজার কোটির ওপরে।

Advertisment

সুতরাং সরকারি জায়গায় স্নাতকস্তরে সরকারের খরচ যে বছরে অবশ্যই ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি, সে নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। বরং আসল অঙ্ক এই অনুমানের থেকে অনেকটা আলাদা। কিছু পরিসংখ্যান বলছে যে আমাদের দেশে শিক্ষার যে বাজার তার পরিমাণ অবশ্যই একশো বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে। গুণ করলে তা দাঁড়ায় প্রায় সাত লক্ষ কোটি ভারতীয় মুদ্রা, বা সাত ট্রিলিয়ন। ভারতের চরম উন্নতির পথে ট্রিলিয়ন আজকাল সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। বিজেপি সরকারের দ্বিতীয় ইনিংসে এই ধরনের লক্ষ কোটির কথা শোনা যাচ্ছে বারবার।

আরও পড়ুন, অন্য পক্ষ: বিজেপিতে কি জায়গা ফাঁকা আছে?

গোটা বিষয়টা যেহেতু অনেক বড় বড় সংখ্যা নিয়ে, আর তার তুলনায় প্রতিটি পড়ুয়া অতি তুচ্ছ, তাই নিয়মের সামান্য গোলমালেই ভুগতে হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের। আমাদের দেশে পড়াশোনার সবচেয়ে বিপজ্জনক বয়স ১৬ থেকে ১৮। এমনিতেই এই বয়সে বাচ্চাদের মানসিক পরিবর্তন হয় অনেকটা। কিশোর-কিশোরী থেকে যুবক-যুবতী হওয়ার পথে যাত্রা শুরু তাদের। আর ঠিক এই সময়েই স্কুল থেকে কলেজে যেতে হয়, ঠিক হয়ে যায় ভবিষ্যতের পেশাদারী জীবনের অভিমুখ। একথা মানতেই হবে যে কিছু সূচকের ওপর ভিত্তি করে পড়াশোনার সুযোগ পাবে পড়ুয়ারা। কিন্তু সেটা তো তাদের আগে থেকে জানাতে হবে!

ধরা যাক, একজন ছাত্রী ৮০ শতাংশ নম্বর পেল উচ্চমাধ্যমিক স্তরে। কোনভাবেই খারাপ বলা যাবে না। কিন্তু কলকাতার কোনও সাধারণ মানের কলেজে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হতে গেলেও এই মূল্যমান যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে মুশকিল দুদিক থেকেই। এক হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণে নম্বর বেশি দেওয়া।

সেই কারণেই আশির দশকের ৮০ আর আজকের ৮০ সমান নয়। ফলে অনেক বেশি ছাত্রছাত্রী তাদের কৃতিত্বের তুলনায় অধিক নম্বর পাচ্ছে। নিজেদের সঠিক অবস্থান বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে ব্যাপক। সত্যিই হয়ত আজকের দিনে উচ্চমাধ্যমিকে ৮০ শতাংশ নম্বর পাওয়া কোন ছাত্র রসায়নে স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করার যোগ্য নয়। অর্থাৎ ৮০ সংখ্যাটি এখানে ভুল দিকনির্দেশ করছে। সে যদি উচ্চমাধ্যমিকে ৫৫ শতাংশ নম্বর পেত, তাহলে তার নিজের কী করা উচিৎ সেই সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হতো অনেক বেশি।

মুশকিলের দ্বিতীয় দিকটি হলো, আজকের দিনে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বেড়েছে অনেক, এবং তাদের পড়াশোনার মানও আজ থেকে কয়েক দশক আগের তুলনায় ভালো। স্বভাবতই প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। ফলে সত্যি হয়ত সে ৮০ শতাংশ নম্বর পাওয়ার যোগ্য। এদিকে নীতিনির্ধারকদের অপদার্থতায় স্নাতকস্তরে সরকারি কলেজের সংখ্যা সেই অনুপাতে বাড়ে নি। তাই সঠিক জায়গায় পড়ার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে বেসরকারি জায়গায় পড়তে গেলে প্রচুর টাকা দিতে হয়, এদিকে পাশ করে চাকরি জোটে না। পুরোটাই অদ্ভুত এক গোলমেলে চাকায় জড়িয়ে গেছে।

আরও পড়ুন, রাজনীতিনামা: এনআইএ সংশোধনী বিল পাশ, সকলের এক রা!

সাধারণ কলেজের সমস্যা ছাড়িয়ে ফিরে আসা যাক দেশের সবচেয়ে উচ্চমানের প্রযুক্তি বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠানগুলিতে সুযোগ পাওয়া সম্পর্কে। আমাদের দেশে লাখ দশেক অত্যন্ত ভাল ছেলেমেয়ে লাখ খানেক আসনের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বুঝতে হবে, এই দশ লাখ প্রতিযোগী অসাধারণ। পৃথিবীর যে কোনও দেশে, যে কোনও নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরা স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করার যোগ্য। এবার দশে-এক-এর অঙ্কে হেরে যাচ্ছে ন'জন।

এই হার কিন্তু অনেকটাই যদ্দৃচ্ছ এবং যুক্তিহীন কারণে। ধরুন, একই নম্বর পেয়েছে ৫০০ জন। এদের মধ্যে একজনের স্থান যদি ৭০০ হয়, তাহলে শেষের দিকে তা ১২০০'র কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। কী নিয়মে ঠিক হবে এই ৫০০ থেকে ১২০০? পরীক্ষার আগেই কর্তৃপক্ষ ঠিক করে রাখেন কিছু নিয়ম। ধরা যাক, ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষার কথা। সবাই জানেন দেশজোড়া এই পরীক্ষার নাম ‘নিট’। সম্ভবত ৭২০ নম্বরের মধ্যে এই পরীক্ষা হয়। ৫৫০ মতো পেলে ভাল সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পাওয়া যায়।

ধরা যাক, ৫৩৭ নম্বর পেয়েছে ৫০০ জন। এবার যারা জীববিদ্যায় বেশি পেয়েছে, তাদের বেশি কৃতিত্ব দেওয়া হবে। সেখানেও হয়ত দেখা গেল, ৩০০ জন একই নম্বর পেয়েছে। এবার ঠিক হলো, রসায়নের নম্বর দিয়ে আলাদা করা হবে তালিকা। তাতে হয়ত ৩০০ থেকে কমে হল ২০০ জন। অর্থাৎ সেভাবে হিসেব করেও ২০০ পরীক্ষার্থী একই নম্বর পেল। এবার হয়ত বলা হলো, জন্ম তারিখ যাদের আগে, তাদের বেশি সুবিধে দেওয়া হবে। সেখানেও মিলে গেল জনা কুড়ি। এভাবেই বারেবারে টাইভাঙ্গা চলছে নির্দোষ পড়ুয়াদের নিয়ে। যারা পরীক্ষা দিচ্ছে, তারাও হয়তো সবসময় মাথায় রাখতে পারে না, কীভাবে ঠিক হচ্ছে নম্বরের সঙ্গে স্থানের সম্পর্ক।

একই নম্বর পেয়ে একজন হয়ত আর জি করে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে, অন্যজনের কোথাও জায়গা হচ্ছে না। দেশজোড়া প্রযুক্তি বিদ্যার স্নাতকস্তরের প্রবেশিকা পরীক্ষা জেইই মেইনস-এ প্রায় বারো খানা ভিন্ন প্রশ্নপত্র থাকে। তাতে কোনও একটা প্রশ্নপত্রে বেশি নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থী জটিল নিয়মে অন্য একটি প্রশ্নপত্রে কম নম্বর পাওয়া পড়ুয়ার থেকে পিছিয়ে পড়তে পারে। এই জটিল পরিসংখ্যান কে বানাচ্ছেন, কিভাবে তা লাগু হচ্ছে, সেসব বুঝতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে পড়ুয়াদের। তাদের অভিভাবকেরা তো মাথার চুল ছিঁড়ছেনই। অবশ্যই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মেধাতালিকা ছাপাতেই হবে। কিন্তু গোটা বিষয়টায় অনেক বেশি স্বচ্ছতার প্রয়োজন।

আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্যে এগোবো কোন পথে?

শিক্ষাক্ষেত্রে বিপুল সরকারি বিনিয়োগ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান মেলা শক্ত। তা না হলে প্রতিযোগিতা তীব্রতর হবে। আর সেই চাপের ফল ভোগ করবে আজকের মধ্যবিত্ত সমাজ। কলকাতার উপকণ্ঠে কোচিং সেন্টারের বাইরে বৃষ্টিভেজা সন্ধেয় দীর্ঘ অপেক্ষায় ক্লান্ততর হবেন অভিভাবিকারা। ছোট্ট মেয়ে পড়ে বেরিয়ে বাবা মায়ের কাছে বায়না ধরবে গলির পাশে ভুজিয়াওয়ালার দোকান থেকে গরম চানাচুর কিনে দেওয়ার জন্যে। এটুকুই ছুটি। সারাদিনের ক্লান্তিকর স্কুল কিংবা কোচিং ক্লাস সেরে তারপর সারারাত জেগে অঙ্ক নিয়ে লড়ে যাবে সেই কিশোরী। পাশে জেগে বসে অসহায় বাবা-মা।

পরের দিন ইস্কুলের ছাদ থেকে সে যদি ঝাঁপ দেয় শান বাঁধানো মেঝেয়, কিংবা বাথরুমে গিয়ে মুখে জড়িয়ে নেয় শ্বাস-নিরোধক পলিথিন, সেক্ষেত্রে এটুকু শুধু বুঝে নেবেন যে সে আপনারই মেয়ে, অন্যের নয়।

গল্পটা এখানেই শেষ করা ভালো। কারণ রাজনীতিতে এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার লোক কম। সেখানে অনেক বেশি জনপ্রিয় কাটমানি, ভাটপাড়া, পড়শি দেশের সঙ্গে যুদ্ধ, কাঁকিনাড়া আর কর্ণাটকে দলবদল। গৃহশিক্ষকের দরজার বাইরে নিজের ছেলেমেয়ের পড়া শেষে তাদের চটি খোঁজার কাজে যতটা সৎভাবে সময় দিই আমরা, তার থেকে কি একটু সময় বার করা যায় এই সব সমস্যা নিয়ে ভাবার জন্যে? আজকের রাজনীতি বদলাতেই হবে। নাহলে কিন্তু শিক্ষার মুক্তি নেই। আপাতত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একশো আটবার বলা যাক এই কথাটা। অন্য কেউ তো শুনবেন না!

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Anyo Paksha Education
Advertisment