বাকিরা দুধ খায় আর ছাগলের সেজ ছেলে আনন্দে লাফায়। বিরোধীদের অবস্থা ঠিক তাই। বিজেপির দুর্বলতা দেখে ভীষণ উৎসাহিত বিরোধী কয়েকটি দলের কিছু নেতানেত্রী। কিন্তু সারমর্ম হলো, দুই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতা ধরে রাখল বিজেপিই। তাদের ভোট বেশ খানিকটা কমেছে, কমেছে আসনও। কিন্তু খুব কিছু কি গেল এল তাদের? বিজেপি এবং তাদের সহযোগী আরএসএস এর শীর্ষনেতাদের মধ্যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং শিক্ষিত মানুষ আছেন। তাঁদের হিসেবে কি খুব ভুল হলো এবার? একেবারেই নয়। আর সেটা বোঝার জন্যে শুরুতেই দেখে নেওয়া যাক হরিয়ানার কিছু পরিসংখ্যান।
চারটি মূল দলের কথা এখানে বলতে হবে - বিজেপি, কংগ্রেস, আইএনএলডি (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোকদল) আর জেজেপি (জননায়ক জনতা পার্টি)। শেষের দুই দল আসলে দেবী লালের সেই পুরনো লোকদলের অংশ বিশেষ। ২০১৪ লোকসভায় বিজেপি পেল ৩৪.৮ শতাংশ, কংগ্রেস ২২.৯ শতাংশ, আর আইএনএলডি ২৪.৪ শতাংশ ভোট। সেই বছরের বিধানসভায় এই সংখ্যাগুলি খুব সামান্য বদলে গিয়ে হল যথাক্রমে ৩৩.২ শতাংশ, ২০.৬ শতাংশ, ২৪.১ শতাংশ। মাত্র এক তৃতীয়াংশ সমর্থন পেয়েও বিরোধী ভোট ভাগ হওয়ার সুবিধে পেল বিজেপি। লোকসভায় তারা জিতল দশে সাতটি আসন, আর বিধানসভায় নব্বই-এ সাতচল্লিশ। এর আগে পর্যন্ত যে হরিয়ানায় লড়াই চলত কংগ্রেস আর লোকদলের, সেখানে ক্ষমতা দখল করে নিল বিজেপি।
আরও পড়ুন: সিপিএমের ১০০ বছর, সংকট যতটা মার্ক্সবাদীদের ততটা বামপন্থীদের নয়
এরপর আবার নির্বাচন ২০১৯-এ। লোকসভায় সবকটি আসন পেল বিজেপি। ভোট শতাংশ বিজেপি ৫৮.২, কংগ্রেস ২৮.৫, আইএনএলডি ১.৯ এবং জেজেপি ৪.৯। দেশভক্তির হাওয়ায় বিজেপি উড়িয়ে দিল বাকি সমস্ত প্রতিপক্ষকে। হরিয়ানার প্রচুর মানুষ দেশের বিভিন্ন সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। পড়শী দেশের সঙ্গে অশান্তি তাই সরাসরি প্রভাব ফেলল লোকসভা নির্বাচনে। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে পুরনো লোকদলের ভোটের ভাগ পুরো চলে গেল বিজেপির দিকে। আর লোকসভায় যেহেতু বিজেপির মূল প্রতিপক্ষ ছিল কংগ্রেস, তাদের ভোটও সামান্য বাড়লও, কিন্তু তা বিজেপির তুলনায় অনেক পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয়। লোকসভার আসন সংখ্যাকে যদি বিধানসভার হিসেবে ভাগ করা যায় তাহলে বিজেপি পেয়েছিল ৯০ এর মধ্যে ৭৯টি আসন, কংগ্রেস ১০ আর জেজেপি ১।
এবার দেখা যাক সদ্যসমাপ্ত বিধানসভার ফল। মনে রাখতে হবে, আইএনএলডি-র বেশ কিছু নেতা লোকসভা নির্বাচনের পর যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। তাঁদের অনেককে প্রার্থীপদ দিয়েছে বিজেপি। কিন্তু তার পরেও ভোট শতাংশের হিসেবে বিজেপি ৩৬.৫, কংগ্রেস ২৮.১, আইএনএলডি ২.৪ এবং জেজেপি ১৪.৯। মাস তিনেক আগের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় প্রায় ২২ শতাংশ ভোট কমল বিজেপির, আর সেই ভোট মূলত সরে গেলো জেজেপি-র দিকে, যারা আইএনএলডি ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল। এটাও লক্ষ্যণীয় যে আইএনএলডি ছেড়ে বিজেপির দিকে যাওয়া নেতৃত্ব মোটেই সফল হলেন না এই বিধানসভা নির্বাচনে। যুবনেতা দুষ্যন্ত চৌতালা বিজেপি এবং কংগ্রেস বিরোধী ভোট নিয়ে এলেন জেজেপির কাছে। অর্থাৎ একেবারে সহজ হিসেবে পুরনো লোকদলের যে ভোট এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছিল তা ফিরে এলো নতুন রূপের জেজেপি-তে। আসনের হিসেবে বিজেপি ৪০, কংগ্রেস ৩১, আইএনএলডি ১ আর জেজেপি ১০।
ভোট নিয়ে যাঁরা উৎসাহী, তাঁদের জন্যে যোগ করা যাক যে ২০১৪ এবং ২০১৯-এর চারটি নির্বাচনেই মায়াবতীর বিএসপি-র ভোট শতাংশ রয়ে গেছে চারের আশেপাশে। সেই রকমই কংগ্রেসের ভোট শতাংশেরও বিশেষ পরিবর্তন হয় নি। এবারের লোকসভা এবং বিধানসভা দুটিতেই তাদের ভোট শতাংশ আঠাশের সামান্য ওপরে। বিধানসভায় আসন জুটেছে অনেক, তার কারণ বিজেপির ভোট কমেছে বিপুলভাবে। আর একটি বড় কারণ জাঠ সমীকরণ। সেটুকু পুরোটাই প্রতিফলিত হয়েছে এবারের ভোটফলে। সেই হিসেব পরিষ্কার বুঝে নেওয়ার পরও বিজেপি অ-জাঠ মুখ্যমন্ত্রীকেই হরিয়ানার কুর্সিতে রেখে দেয় কিনা সেটাই এখন দেখার।
আরও পড়ুন: এক চিমটে বিরোধিতা
মহারাষ্ট্রেও বিজেপি লোকসভার তুলনায় বেশ খারাপ ফল করেছে, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোন মুশকিল নেই। শিবসেনার সঙ্গে তাদের জোট বেঁধে নির্বাচনে নামা। সেই জোট নিয়ে কিছু বিতর্কের গল্প হাওয়ায় ভাসে গত প্রায় দু'দশক ধরে। কিন্তু দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দুটি দল একসঙ্গেই চলছে। ফলে এবারের নির্বাচনের পর শিবসেনার নেতৃত্বে এনসিপি এবং কংগ্রেস একজোট হয়ে মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা দখল করবে, এমনটা একমাত্র ঘোর বিজেপি-বিরোধীরাই কল্পনা করতে পারেন। বাস্তব তার থেকে অনেকটা দূরে।
আর জোটের এই মজার খেলায় আর একবার ফিরতে হবে হরিয়ানার কথায়। বিজেপি পেল ৪০টি আসন, তাদের বিক্ষুব্ধরা জিতলেন দুটি আসনে, বাকি জনা সাতেক নির্দল বা অন্যান্য ক্ষোভ-বিক্ষোভে প্রার্থী হওয়া বিধায়ক। এদিকে হঠাৎ করে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম হইচই শুরু করে দিল যে জেজেপি নাকি কিং-মেকার। রাজা বানাবে তারাই, কিংবা তাদের যুবনেতাই হবেন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী। এরকম অপরিণত ভাবনা কী করে যে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মাথায় এল কে জানে! নিজেদের দুই বিক্ষুব্ধ প্রার্থীর সঙ্গে আর চারজন নির্দল বিধায়ক জোগাড় করা কেন্দ্রের শাসকদলের কাছে দুই আঙুলে টুসকি দেওয়ার মতই সহজ। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে জেজেপিকে কিছু পেতে গেলে বিজেপিকে সমর্থন করা ছাড়া গতি নেই। কারণ কংগ্রেসের ৩১ আর নিজেদের ১০ মিলে ৪৬ ছোঁওয়া অসম্ভব। ঠিক সেটাই হয়েছে। খান দুই পূর্ণমন্ত্রী আর একজন আধা মন্ত্রীর আশ্বাস পেয়েই জেজেপি ছুটেছে বিজেপির দিকে।
সবশেষে আসা যাক উপনির্বাচনগুলোর কথায়। মনে রাখতে হবে, বিজেপি কিন্তু সাধারণভাবে উপনির্বাচনগুলিতে ভালো ফল করে না। তার একটা বড় কারণ হতেই পারে যে বিজেপি এই সমস্ত ছোটখাটো নির্বাচনে খুব বেশি প্রভাব না খাটিয়ে সত্যিকারের জনমত যাচাই করার চেষ্টা করে। সেই নিরিখে তারা স্থির করে গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা কিংবা বিধানসভা নির্বাচনের কৌশল। বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে সংবাদমাধ্যমের সমীক্ষার থেকে অনেক বেশি তথ্য পাওয়া যায় কোনও নির্বাচনের ফলাফলে। অত্যন্ত সংগঠিত রাজনৈতিক দল বিজেপি, এবং তাদের পেছনে আছে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস। নীতির প্রশ্নে দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু এই দুই দলেই ঐকান্তিক প্রচেষ্টা নিয়ে কাজ করেন বহু নিঃস্বার্থ, সৎ, বুদ্ধিমান এবং শিক্ষিত মানুষ। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থের বিষয়টাই অনেক আগে থাকে, থাকে পরিবারের প্রভাব, বিজেপির রাজনীতি তেমন নয়।
আরও পড়ুন: ভাসানের কার্নিভালে জিনপিং
ফলে এবারের বিভিন্ন নির্বাচনের তথ্য নিয়ে বিজেপির অন্দরে যতটা কাটাছেঁড়া হবে, দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষে সেই কাজ করার মত মানবসম্পদের বড় অভাব। একটু ফিরে দেখুন ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে। সেখানে সুষ্ঠুভাবে ভোট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দেয় নি তৃণমূল কংগ্রেস। সেরকম হলে রাজ্যের শাসকদল সহজেই বুঝতে পারত যে তাদের সীমাবদ্ধতা ঠিক কোন কোন জায়গায়। বিজেপি কিন্তু অধিকাংশ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে, আর তার ফলে সহজেই অনুধাবন করতে পারছে কোথায় তাদের দুর্বলতা। সেই অনুসিদ্ধান্তে ভর করে তাদের সংগঠন চেষ্টা করছে গোলমাল সামাল দিতে।
যেমন এবারের হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রের নির্বাচন বার্তা দিয়েছে যে অন্য দল ভাঙিয়ে আনা প্রার্থীরা বিজেপির হয়ে খুব ভালো ফল করেন নি। কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে আসা অল্পেশ ঠাকুরও এবার ভোটে হেরেছেন গুজরাটে। পশ্চিমবঙ্গে তা নিয়ে হয়ত সামনের নির্বাচনগুলোতে অনেকটা সতর্ক হবে বিজেপি। অন্যান্য দল, বিশেষত তৃণমূল থেকে যাঁরা দলে দলে বিজেপিতে যাচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে জনমত যে ইতিবাচক না হতেই পারে, সেই আভাস কিন্তু অন্য রাজ্য থেকে আসছে।
অর্থাৎ উৎসবের মরশুমে বিজেপি জনগণকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ দিয়েছে। তার উত্তরে ভারতের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন যে উগ্র জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ব, রাম, অযোধ্যা এইসব দিয়ে ছেলে ভোলানো বেশিদিন চলবে না। দেশের অর্থনৈতিক মন্দার দায় জনগণ চাপিয়েছেন বিজেপির ওপর। অন্যদিকে এটাও পরিষ্কার যে বিরোধী দলগুলো একেবারেই অগোছালো। বিজেপির প্রতি জনগণের যে অনাস্থা, তাকে নিজেদের দিকে টেনে আনার মত জায়গায় এখনও পৌঁছতে পারে নি তারা। দেশের মানুষ রাহুল গান্ধী নেতা হতে চান কি চান না, সেই সংবাদে একেবারেই উৎসাহী নন। তাঁরা জানতে চান, বিরোধীদের নেতা কে? সেই প্রশ্নের উত্তর না মেলা পর্যন্ত বিজেপিকে বেগ দেওয়ার খুব জায়গা নেই।
আরও পড়ুন: অযোধ্যায় রাম মন্দির: মোদী-শাহর প্রতিশ্রুতি পূরণ
তবে বিজেপি যদি এই ভোটের ফলকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের অতি দক্ষিণপন্থী কার্যকলাপ থেকে সরে আসে, তাহলে দেশের মঙ্গল। গুজরাটের বিধানসভা উপনির্বাচনে ছটি আসনের চারটি ছিল বিজেপির আর দুটি কংগ্রেসের। সেখানে এবার ফল তিন-তিন। লোকসভা ভোটে যে জাতীয়তাবোধের উন্মাদনা ছিল তা হ্রাস পেয়েছে অনেকটাই। গত নির্বাচনে বিপুল ধাক্কা খাওয়ার পর কেরালায় আবার ভালো ফল করেছেন বামপন্থীরা। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ফল অবশ্য যথেষ্ট ভালো, কারণ সেখানে ব্যাপক ভোট কাটাকাটি হয়েছে সপা আর বসপার মধ্যে।
উপসংহারে, দেশের বেশ কয়েকটি জায়গা মিলে নির্বিঘ্নে ভোট দিলেন কয়েক কোটি মানুষ। বিজেপি জানতে পারল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রকে পুরোপুরি দখল করা কতটা কঠিন। ভবিষ্যতের জন্যে হয়ত এর মধ্যেই ঘর গোছাতে শুরু করে দিয়েছে তারা। তবে এই আনন্দে বিরোধীরা যদি দীপাবলি উদযাপনে মেতে ওঠে তাতে কিন্তু তাদের ভোট বিশেষ বাড়বে না। সামনে অনেকগুলো রাজ্যে পৌরসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন। সেখানকার নেতানেত্রীদের ভাবনা শুরু করতে হবে যে তাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে সত্যি সত্যি লড়বেন, নাকি তলায় তলায় যোগাযোগ রেখে ঘর বাঁচাবেন নিজেদের। এই দ্বিতীয় বিকল্পটি বজায় থাকলেই আগামী অনেকগুলো বছরের জন্যে নিশ্চিন্তে ক্ষমতায় থাকতে পারবে বিজেপি এবং আরএসএস।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)