রাজনীতি বড় অনিত্য। এই ক্ষমতা আছে, এই নেই। মহারাষ্ট্র আর হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে বিজেপি ধাক্কা খেলেও এখনো বিজেপি-বিরোধী কোনও সুষ্ঠু বিকল্প নেই। 'জো জিতা ওহি সিকন্দর', এই আশু বাক্য অনুসারে এখনও নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহই রাজ্যদুটিতে প্রধান নির্ধারক শক্তি। তবু বলতে হবে, এবারের বিধানসভা ভোটের ফলাফলের পর বিজেপির সিরিয়াস আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন। কেন এহেন প্রবল আক্রমণাত্মক প্রচার অভিযানের পরও এই ফলাফল?
বিজেপি যে এই প্রথম ভোট ধাক্কা খেল তা নয়, বরং এর আগে বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, দিল্লি, রাজস্থান, নানা রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। আবার মোদী এমন এক জনপ্রিয় নেতা যিনি বিধানসভা ভোটের বিপর্যয় সত্ত্বেও ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফলকে সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে সক্ষম হন। মোদীর রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা, তাঁর ব্র্যান্ড ইকুইটি কম হয়েছে কি হয়নি সে ব্যাপারে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। উল্টোদিকে একথাও বলা যায়, মহারাষ্ট্রে দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে।
আর হরিয়ানায়? রাহুল বা গান্ধী পরিবার না থাকা সত্ত্বেও হরিয়ানায় কংগ্রেসের শক্তি বৃদ্ধি দেখে তো একথাও বলা যায় যে এই জয়লাভ আঞ্চলিক জাঠ নেতা ভূপিন্দর সিংহ হুদার যতখানি, ততখানি গান্ধী পরিবারের নয়। অনেক কংগ্রেস নেতা প্রকাশ্যে না হলেও ভিতরে ভিতরে নিজেদের মধ্যে বলতে শুরু করেছেন যে গান্ধী পরিবারকে বাদ দিয়েই কংগ্রেস এখন সামনের দিকে এগোতে পারবে। কিন্তু প্রকাশ্যে একথা বলার সাহস কার আছে?
কোনও সন্দেহ নেই, দেশে আজ এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মোদী সরকার অতি সক্রিয়। নানা ঘোষণা। প্রতিনিয়ত নানা ধরণের কর্মসূচির রূপায়ণ। কিন্তু এই ভোটের ফলাফলে বিজেপি সরকার গঠন করতে যদি পারে তারপরেও, বলতে হবে মোদী এবং অমিত শাহর বিজেপির নেতৃত্বে প্যান-ইন্ডিয়া একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন বাস্তবায়িত বেশ কঠিন হয়ে গেছে। বাজপেয়ী-আডবাণীর সময়ে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সরকার ছিল না। এনডিএর শরিকদের হাতে তামাক খেয়ে বাজপেয়ীকে জোট সরকার চালাতে হয়। মোদীই প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যাঁর নেতৃত্বে বিজেপি এককভাবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু এবার হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র দু'রাজ্যেই আবার বিজেপিকে এনডিএ সংস্কৃতিতে ফিরে আসতে হয়েছে।
নভেম্বর মাসে ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা। জানুয়ারী মাসে দিল্লি বিধানসভা নিবার্চন। মোদীর সামনে এখন মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ হলো, গোটা দেশের মানুষকে এই বার্তা দেওয়া যে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি থেকে পাক সন্ত্রাস বিরোধিতা, এ ধরণের জাতীয় ইস্যু দিয়ে দেশের মানবজমিনে কতটা সাড়া পাওয়া যায়।
কোনও গৌরচন্দ্রিকা নয়। সোজাসাপটা কথা বলতে চাইছি আজ। বিষয়: সদ্য হয়ে যাওয়া মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার বিধানসভা ভোটের ফলাফল। সাংবাদিকতার ভাষায় ‘ডিলেড ইনট্রো’ নয়। জানাতে চাইছি, এই দুই রাষ্ট্রের রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলাফলের রাজনৈতিক তাৎপর্যটা কী।
বিজেপি প্রকাশ্যে আস্থা অর্জনের জন্য ‘পারসেপশন’ তৈরির রাজনীতি করলেও ভিতরে কিন্তু চিন্তন-মন্থন শুরু হয়ে গেছে। কেন এমন হলো? বিজেপির অন্দরের সেই ময়নাতদন্ত শুরু হয়ে গেছে। আপনাদেরও জানাতে চাই সেসব নেপথ্যের কিছু কাহিনি।
এ হলো ‘হাফ গ্লাস অফ ওয়াটারের’ তত্ত্ব। অর্থাৎ গ্লাসে অর্ধেক জল আছে। এবং অর্ধেক জল নেই। কংগ্রেস ও শরদ পওয়ারের দল এনসিপি এবং হরিয়ানার কংগ্রেস নেতৃত্ব বলছে, গ্লাসে অর্ধেক জল নেই। এত যে বড় বড় কথা। ৯০টা আসনের হরিয়ানায় বিজেপি বলেছিল, কার্যত সব আসন তারাই পাবে। গতবার মহারাষ্ট্র বিধানসভায় বিজেপি একা লড়ে পেয়েছিল ১২২। আর এবার বড় গলায় বিজেপি ঘোষণা করেছিল, ২০০টা আসনের সীমা অতিক্রম করবে। তার বদলে হলো কী? বিজেপির এবার প্রায় ২০টা আসন কমে গেল। তাও শিবসেনার চেয়ে ৪০টা আসনে বেশি লড়ে।
আবার পাল্টা আখ্যান তুলে ধরেছেন নরেন্দ্র মোদী। দেরি না করে ভোটের ফলপ্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। দিল্লিতে বিজেপির নতুন সদর দফতরে এসে মোদী এবং অমিত শাহ গোটা দেশের সামনে আশাবাদী আখ্যান তুলে ধরলেন।
মোদী জানালেন, হরিয়ানায় কখনওই একই দল একটা ‘টার্ম’ শেষ করে আবার ফিরে আসে না। মহারাষ্ট্রে পাঁচবছর বিজেপি-শিবসেনা যৌথভাবে সরকার চালিয়ে আবার দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসীন হলো। বিজেপি নেতারা আরও বলেছেন, হরিয়ানা নামক রাজ্যটি কোনওদিনই বিজেপির গড় ছিল না। এটি ছিল কংগ্রেস ও লোকদলের গড়। ভজনলাল এবং দেবীলাল। ভজনলাল বৈষ্ণো সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ অজাঠ। আর দেবীলাল লোকদল নেতা ছিলেন জাঠদের নেতা। এই দুই নেতা কখনও একজন কখনও আর একজন, এভাবে প্রায় ৪০ বছর রাজত্ব করেছেন। দু’জনে বিরোধী শক্তি, আবার নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ছিল।
মোদী এই পুরনো জাতপাত ভিত্তিক রাজনীতির আখ্যান বদলে দিতে চান। হরিয়ানায় অ-জাঠ মুখ্যমন্ত্রী, মহারাষ্ট্রে অ-মারাঠা ব্রাহ্মণ মুখ্যমন্ত্রী মনোনীত করে। সে এক সাংঘাতিক পরীক্ষা। প্রথমে তো হরিয়ানায় জাঠ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। মনে পড়ে, দিল্লির যন্তরমন্তরে পর্যন্ত জাঠ বিদ্রোহ এসে আছড়ে পড়ে। আমার মনে হয়েছিল এবার খাট্টারের রাজ্যটা টিকলে হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখলাম মোদীর ব্র্যান্ড ইকুইটি এবং রাজ্য উন্নয়নের ইস্যু তুলে বিজেপি হরিয়ানার রাজনীতিতে এক নতুন ধারা এনে দিল। তাহলে পাঁচ বছর পর এটা কী হলো!
এবার বিজেপির অন্দরের গপ্পো বলি। ভোট প্রচারের সময়ই মোদী এবং অমিত শাহ বুঝতে পেরে যান, হরিয়ানায় হুদার নেতৃত্বে আবার জাঠ ভোট সুসংহত হচ্ছে। সোনিয়া গান্ধী অধ্যক্ষ হওয়ার পর একটা কাজ করেন। তিনি ক্ষুব্ধ হুদার দল ছেড়ে চলে যাওয়ায়। আলোচনা করে আটকে দেন। পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। কংগ্রেস নেতা আহমেদ প্যাটেল আমাকে তখন বলেছিলেন যে, তিনি ম্যাডামের নির্দেশে একমাস হরিয়ানায় ক্যাম্প করে থাকবেন। প্যাটেল হলেন ওল্ড স্কুল কৌশলবাদী।
হুদার কথায়, রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অশোক তোমারকে সরিয়ে সোনিয়া দলিত নেত্রী কুমারী শৈলজাকে সভানেত্রী করেন। জাঠ ও দলিত কম্বিনেশন কাজ দেয়। চৌটালার আইএনএলভি মাত্র একটা আসন পেয়েছে। ওদের খারাপ ফল হওয়ায় জাঠ ভোট অনেকটাই কংগ্রেসের দিকে এসে যায়। সম্ভবত বিজেপি সেদিন বুঝতে পেরেছিল বলেই মোদী ভোটপ্রচারে এত পরিশ্রম করেন। এতগুলি জনসভা করেন। মোদির ব্র্যান্ড ইকুইটি ব্যবহার করার বিধানসভা ভোটে এত প্রয়োজন হলো কেন?
মনে আছে, দিল্লি ভোটের সময় যখন রামলীলা ময়দানের সভায় মোদী এলেও তুলনামূলকভাবে লোক কম হয়, তখনই শাহ মোদীকে বলেছিলেন, কেজরিওয়াল ক্ষমতায় আসছে। কিরণ বেদীকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী করা বড় ভুল হয়েছে। মনে রাখতে হবে, কিরণ বেদীকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী করার প্রস্তাবে সেদিন অরুণ জেটলি বড় একটি চরিত্র ছিলেন। কিন্তু অমিত শাহ এ প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন না। মোদী অবশ্য অরুণের প্রস্তাব মেনে নেন।
আজ এই ভোটের ফলাফল দেখে প্রকাশ্যে বিজেপি যাই করুক, ভিতরে ভিতরে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে কি আবার জাঠ-অ-জাঠ এই জাতপাতের রাজনীতি মুখ্য হয়ে উঠছে? কাশ্মীর, ৩৭০ ধারা, পাকিস্তানের বিরোধিতা, পাঞ্জাবের জল পাকিস্তানকে না দেওয়া, করতারপুরে শিখ তীর্থযাত্রীদের নিয়ে যাওয়া, যোগী আদিত্যনাথ থেকে অমিত শাহ সকলকেই প্রচারে নামানো। এসব সত্ত্বেও উন্নয়ন ও মোদির ব্র্যান্ডের চেয়েও কি জাঠ ফ্যাক্টর, আর্থিক অধোগতি এবং স্থানীয় মন্ত্রী ও এমএলএ-দের বিরুদ্ধে মানুষের জনমত তীব্র হয়ে উঠেছে? তা নাহলে ১০ জন মন্ত্রীর মধ্যে সাতজন মন্ত্রী এত বেশি ভোটের ব্যবধানে হেরে যান কেন? চৌটালার নাতি দুষ্মন্তের দল জেজেপি ১০টা আসন পায় কী করে?
অন্যদিকে, গতবারের বিধানসভা ভোটের আসন নিয়ে ঝগড়ায় বিজেপি একা লড়ে। তাতে লাভ হয়নি। মহারাষ্ট্রে এবার তাই কোনও পক্ষই ভুল করেনি। প্রবল স্নায়ুর যুদ্ধে শিবসেনাকে কম আসনই দেয় বিজেপি। বলা হয়, সেই শিবসেনা আজ নেই। শতকরা ভোট বিজেপির অনেক বেড়ে গেছে। শিবসেনা কম আসন মেনে নেয়। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল, বিজেপি বেশি আসন নিয়েও একা তো দূরের কথা, সরকার গড়তে শিবসেনার উপর নির্ভরশীল। উদ্ধবের পুত্র আদিত্য জীবনের প্রথম নির্বাচন জিতেছেন বিপুল ভোটে। শরদ পওয়ার, অজিত পওয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত সত্ত্বেও লাভ হয়নি। পওয়ার পশ্চিম মহারাষ্ট্রে ভাল ফল করেছেন। বরং এনসিপি ভেঙে চলে গিয়ে অনেকে বিজেপি প্রার্থী হয়েও জিততে পারেন নি।
স্নায়ুযুদ্ধের ফল যাই হোক, এটা বিজেপি মানছে, অমিত শাহের একদলীয় শাসনের স্বপ্ন এবার প্রবল ধাক্কা খেল মহারাষ্ট্রে। প্যান-ইন্ডিয়ান একদলীয় শাসনের ইচ্ছেতে কোনও অন্যায় নেই। কিন্তু এবার এত কাণ্ড করে বিজেপিকে আবার এনডিএ সংস্কৃতিতেই ফিরে আসতে হয়েছে।
মোদী বুঝতে পারছেন, জাতপাতের রাজনীতি এত দিনের অভ্যাস ভেঙে উন্নয়নের পথে মোদী নামক ব্র্যান্ড দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা এত সহজ কাজ নয়। তবু আমার মনে হয় না, মোদী এত কিছুর পরে তাঁর রোডম্যাপ বদলে দেবেন। তবু বাইরে বিজেপি আস্থাবর্ধক পেশি প্রদর্শন রাজনীতি করলেও ভিতরে ভিতরে আলোচনা শুরু হয়েছে। এবার কি তবে কৌশল বদলাতে হবে?
আমার মতে, মোদী সরকারের বিরুদ্ধেও জনমত তৈরি হচ্ছে একথা সত্য হলেও জানতেই হবে, এখনও মোদীর বিজেপির কোনও বিকল্প, কোনও বিরোধী নেতার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না সাধারণ মানুষ। আর্থ-সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধির পরও মোদীর উপরই ভরসা রাখেন। মোদী ও বিজেপির বিরুদ্ধে জনমত ক্রমবর্ধমান হতেই পারে। একে বলা যায় law of nature, কিন্তু মানুষ আজও ভরসা রাখছেন মোদীর উপরই। আম জনতার বিশ্বাস, রাজ্য যাই হোক দিল্লির মসনদে বসার জন্য এখনও মোদীর কোনও বিকল্প নেই।