Advertisment

চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও বিশ্বাস

সর্বরোগহর ডাক্তার কাকুদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের নিরন্তর বিলাপে আপ্লুত হয়ে কোনো চিকিৎসক যদি মনে করেন যে তিনি তাঁর রোগীদের 'সামগ্রিক চিকিৎসা' প্রদান করবেন, তবে তা হবে আজকের দিনে এক অবাস্তব কল্পনা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Medical Treatment, Health in question

কোনও চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীকে যদি যাবতীয় বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়, তাহলে বইপত্র ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে হাজার দশেক গবেষণাপত্র পড়ে ফেলতে হবে

চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি তথা সমগ্র পদ্ধতিটির অমানবিক হয়ে ওঠা নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা হয়েছে। এই প্রসঙ্গটি আলোচনায় এলে সাধারণত চিকিৎসক, নার্সিংহোম ইত্যাদিকে গালমন্দ করার মধ্যেই কথাবার্তা আটকে থাকে। সে পদ্ধতিতে তখনকার মতো গায়ের ঝাল মিটলেও সমস্যার সমাধানের দিকে এক পাও এগোনো হয় না। কিছু ক্ষেত্রে বরং ভুল বোঝাবুঝি বেড়ে সমস্যাটি জটিলতর হয়ে ওঠে।

Advertisment

গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে শুধুমাত্র গালমন্দের সাহায্যে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আমাদের সমাজ নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং চিকিৎসা ক্রমশ মহার্ঘ্য হতে থেকেছে। রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কও তলানির দিকে নেমেছে এবং তার ফলও হয়েছে বেশ খারাপ। তাই আমরা সেই সহজ পথে না হেঁটে একটু অন্যভাবে সমস্যাটিকে বোঝার চেষ্টা শুরু করেছি। রোগের মূল খোঁজার চেষ্টা। আমাদের মনে হয়েছে যে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের চরিত্রের মধ্যেই আছে এর বীজ, যা নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে লাভের ফসল ঘরে তুলতে। আধুনিক চিকিৎসার চরিত্রটি বিজ্ঞান ও প্রমাণ নির্ভর হয়ে ওঠার ফলে কীভাবে তার মধ্যে মানবিক পরিসরটি সংকুচিত হয়েছে এবং ক্রমশ তা ব্যক্তি মানুষের (চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীর) নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বা যাচ্ছে, তা সংক্ষেপে আলোচিত হয়েছে গত সপ্তাহে। ("চিকিৎসা, মানবিকতা ও বিজ্ঞান") আজ দেখার চেষ্টা করব কেন আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞান এমনকি চিকিৎসকের জন্যেও আংশিক বাস্তব আর আংশিক মায়াজাল, যার ওপর ভিত্তি করে বোঝা যাবে কীভাবে বিজ্ঞান বাণিজ্যের কাজে লাগে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এবং পরিষেবায় 'স্পেশালাইজেশন'-এর গুরুত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। স্পেশালাইজেশন এতটাই বেড়েছে যে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এখন আর একটি বিষয় বলে চিহ্নিত করা উচিত নাকি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অনেকগুলি আলাদা বিষয়ের সমাহার হিসেবেই ভাবা কর্তব্য, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। চিকিৎসার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এর প্রভাবের কথা পরে আলোচনা করব। প্রথমে জ্ঞানের জগতের গোলযোগটা দেখা যাক।

আরও পড়ুন, ‘অজানা জ্বরে’ ধুঁকছে শহর, বেশি প্রশ্ন নয়

ফেসবুক বা খবরের কাগজে পুরনো দিনের সর্বরোগহর ডাক্তার কাকুদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের নিরন্তর বিলাপে আপ্লুত হয়ে কোনো চিকিৎসক যদি মনে করেন যে তিনি তাঁর রোগীদের 'সামগ্রিক চিকিৎসা' প্রদান করবেন, তবে তা হবে আজকের দিনে এক অবাস্তব কল্পনা। শুধুমাত্র প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জন নয়, সবটা জেনে ফেলাও একজন চিকিৎসকের পক্ষে অসম্ভব। পার্কিনসন রোগের ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন সার্জারিতে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন স্নায়ুশল্য চিকিৎসক এবং ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার বা টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে কাজ করা একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের চর্চা ও পড়াশোনার ক্ষেত্র এতটাই আলাদা যে উভয়েই শল্যচিকিৎসায় প্রশিক্ষিত চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও একজনের সেমিনারে আরেকজনকে শ্রোতার আসনে বসিয়ে দিলে প্রায় কিছুই বুঝতে পারবেন না। অথচ একজন চিকিৎসকের কাছে একজন রোগী যখন আসেন, তখন সমগ্র দেহমন নিয়েই আসেন। শুধুমাত্র একটি বিশেষ রোগ বিশেষ চিকিৎসা করে রোগীর সত্তার বাকিটাকে অগ্রাহ্য করার উপায় থাকে না। ফলে একজন স্পেশালিস্ট চিকিৎসকের পক্ষে অন্যান্য স্পেশালিটির পড়াশোনা কিছুকিছু চালিয়ে যাওয়া জরুরি।

প্রতিটি বিষয় নিয়ে নিয়ত উন্নয়ন ও গবেষণা চলছে। যাবতীয় বৈজ্ঞানিক তথ্য নিজে হাতেকলমে পরীক্ষা করে বোঝা দূরস্থান, তথ্যগুলো সঠিকভাবে আবিষ্কৃত ও পরিবেশিত হয়েছে কিনা (অর্থাৎ কোনটা সঠিক গবেষণা আর কোনটা ভেজাল বা নিম্নমানের) তা যাচাই করে দেখাও একজন ব্যক্তি চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব নয়। এই বাছবিচারের জন্য নির্ভর করতে হয় "পিয়ার রিভিউড জার্নাল"গুলির উপর। জমা পড়া গবেষণাপত্রগুলির মধ্যে অনেকগুলিকে ছেঁটে কিছু নির্বাচিত ও সম্পাদিত প্রবন্ধ এঁরা প্রকাশ করেন। এই নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়েও বহু প্রশ্ন আছে। তবু এর দ্বারা বহু নিম্নমানের গবেষণার মুখোমুখি হবার অভিঘাত থেকে পাঠক বেঁচে যান।

এত কাটছাঁটের পরেও প্রতিদিন অজস্র গবেষণাপত্র প্রকাশিত হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বিষয়গুলিতে। কোনও চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীকে যদি যাবতীয় বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়, তাহলে বইপত্র ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে হাজার দশেক গবেষণাপত্র পড়ে ফেলতে হবে। সবচেয়ে পড়ুয়া ব্যক্তির পক্ষেও এত কিছু পড়ে বুঝে মনে রাখা সম্ভব নয়, বিশেষত যেহেতু বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চা করার অবসর চিকিৎসকের জন্য বরাদ্দ নেই। এই জ্ঞানটি প্রয়োগ করার কাজে, অর্থাৎ চিকিৎসার কাজেই দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে হয়। ফলে কেউ যদি মনে করেন মোটামুটি সচেতন থাকার জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত জার্নালগুলিতে প্রকাশিত শ’পাঁচেক গবেষণাপত্র নিয়মিত পড়বেন, তাহলেও দেখা যায় যে প্রবন্ধগুলির সংক্ষিপ্তসারটুকুই পড়া হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তাতে মোদ্দাকথাটুকু জানা যায়, কিন্তু গবেষণার পদ্ধতি, বিষয় নির্বাচনের যাথার্থ্য, সিদ্ধান্তের নির্ভরযোগ্যতা, আমেরিকায় হওয়া গবেষণার ফলাফল ভিয়েতনামে কতটা প্রয়োজ্য ইত্যাদি জরুরি বিষয়ে কোনো স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করা সম্ভব হয় না।

তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই যে চিকিৎসকেরা যাকে জ্ঞান বলে মনে করেন এবং যে জ্ঞানের ভিত্তিতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার ইমারত গড়ে তোলেন, সেই জ্ঞান নির্মাণের প্রক্রিয়ায় পরের মুখে ঝাল খাওয়ার ভূমিকাই মুখ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আমরা যা বিজ্ঞান বলে বিশ্বাস করি যথাসম্ভব তাকে অবলম্বন করে রোগীদের সেরা চিকিৎসা দেবার চেষ্টা করতে পারি বড়জোর… সেই অব্দিই চিকিৎসকের দৌড়। অবধারিতভাবে এর মধ্যেও এসে পড়ল "বিশ্বাস" শব্দটি, যে শব্দটির প্রাধান্যের কারণে আমরা ধর্ম থেকে শুরু করে সনাতন গ্রাম্য চিকিৎসা পর্যন্ত অনেককিছুর তীব্র সমালোচনা করেছি। জ্ঞানের চর্চা ও প্রয়োগ থেকে বিশ্বাসকে ঝেড়ে ফেলার একটা প্রতিশ্রুতি যেন আমরা দিয়ে ফেলেছিলাম, সেই দায় যেন নিয়ে ফেলেছিলাম নিজেদের কাঁধে, কিন্তু সেই দায়ভার বহন করার জন্য বাস্তবে প্রস্তুত ছিলাম না। এই না পারাটা দূষণীয় কিছু নয় অবশ্য, পারাটাই যেখানে প্রায় অসম্ভব। অবশ্যই কাকে বিশ্বাস করব বা কার কথা মেনে নেবো, তা আমরা স্থির করতে পারি, কিন্তু এই নির্বাচন প্রায়শই হয় পত্রিকা, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নামের ভিত্তিতে। যাদের বিশ্বাস করি, যাদের যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে বিশ্বাস অর্জন করার জন্য, তবু ৯৫% ক্ষেত্রে পরের মুখে ঝাল খেয়ে ব্যক্তিগত যোগ্যতায় জোর দিয়ে কেউ বলতে পারি না, যা জানি বলে ভাবি তা সত্যিই বিজ্ঞানসম্মতভাবে জানি। এ এক সংকট চিকিৎসকের।

আরও পড়ুন, অরণ্যে বসতির নিয়ম

তা বলে আধুনিক চিকিৎসাকে ভূত ঝাড়া বা রেইকির মতো বিশ্বাস-আশ্রয়ী কার্যক্রমগুলির সঙ্গে একাসনে বসিয়ে দেবেন, ব্যাপারটা এতটাও সরল নয়। সবটা জানার প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও সবটুকু বিজ্ঞানসম্মতভাবে জানতে না পারার সংকটটি ব্যক্তি চিকিৎসকের, সমগ্র চিকিৎসা বিজ্ঞানের নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনও অনেক কিছুই জানে না, কিন্তু সেক্ষেত্রে তার অবস্থান অন্যান্য বিজ্ঞানের মতোই। সে জানার চেষ্টা করছে, গবেষণা চলছে, আবিষ্কার চলছে। বিশ্বাসের ভিত্তিতে ভুলকে আঁকড়ে থাকা, পরিবর্তনকে রুখে দেওয়ার প্রবণতা তার চরিত্রলক্ষণ নয়। একজন চিকিৎসক সবকিছু না জানলেও প্রতিটি আবিষ্কারই কেউ না কেউ খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই করছেন এবং প্রতিটি নতুন আবিষ্কারের চুলচেরা বিচার করেছেন কিছু সংখ্যক বিজ্ঞানের অন্যান শাখাতেও কোনো একজন বিজ্ঞানী বা শিক্ষক সেই শাখার (ধরা যাক পদার্থবিদ্যার) সব গবেষণার খবর রাখেন না।

তাহলে সমস্যা কোথায়? চিকিৎসার ক্ষেত্রেই একে আলাদাভাবে সংকট হিসেবে চিহ্নিত করছি কেন? বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার একজন অভ্যাসকারী নিজের সম্যক জ্ঞানের পরিধিটুকুর মধ্যে থেকে পেশাদারি কাজটুকু চালিয়ে যেতে পারেন। যিনি গাড়ির ইঞ্জিন ডিজাইন করছেন, তাঁর স্ট্রিং থিওরি না জানলেও চলে, কিন্তু একজন চিকিৎসক একজন রোগীর মুখোমুখি হয়ে বলতে পারবেন না যে তিনি কিডনির চিকিৎসক বলে ডায়াবেটিসের চিকিৎসার অগ্রগতি সম্বন্ধে তাঁর জানার প্রয়োজন নেই। একবিংশ শতাব্দীর একজন চিকিৎসক যথাসাধ্য চেষ্টা করেন নিজের বিশেষ প্রশিক্ষণের পরিধির বাইরের কিছুতে নাক না গলাতে, কিন্তু রোগীর শরীর-মন তাঁর ইচ্ছাধীন নয়। ফলে প্রায়শই তাঁকে নাক গলাতে হয় সেই ধারণা বা জ্ঞানের ভিত্তিতে, যাকে তিনি বিজ্ঞান বলে বিশ্বাস করেন।

চিকিৎসকের এই বিশ্বাস ঠিক অন্ধ বিশ্বাস নয়, কিন্তু বিশ্বাস। অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বাসটি সঠিক, তার সমর্থনে তথ্য পাওয়া যাবে। তবে তথ্যের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে, তাদের পক্ষে এই বিশ্বাসটির অপব্যবহার করা সম্ভব। তাত্ত্বিকভাবে এটুকু মেনে নিতে হবে। সঠিক চিকিৎসা বলতে আমরা কী বিশ্বাস করি বা করব, এমনকি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ক্ষেত্রেও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় সংখ্যাতত্ত্ব ও অনুসিদ্ধান্তের মাধ্যমে। এই জায়গাটা গোলমেলে। যদি খেয়াল রাখি যে সব গবেষণায় হুবহু একইরকম ফল বেরোয় না, পরস্পরবিরোধী ফলও আসে মাঝেমধ্যে, তাহলে আরও জটিল মনে হবে বিষয়টি। গবেষণাগুলিতে কে বা কারা অর্থ জোগাচ্ছেন, কী উদ্দেশ্যে গবেষণা হচ্ছে, কোন কোন বিষয় নিয়ে গবেষণা হচ্ছে আর কোনগুলো বাদ যাচ্ছে, কোন গবেষণাপত্র ছাপা হচ্ছে আর কোনটি আদৌ ছাপার জন্য জমাই দিচ্ছেন না স্পনসরেরা বা ভালো গুণমান সত্ত্বেও বাদ দিয়ে দিচ্ছেন সম্পাদক, যাবতীয় আবিষ্কারের নিরিখে একেক ধরণের রোগের চিকিৎসার গাইডলাইন তৈরির সময় সেই বিষয়ের সর্বোচ্চ সংস্থা কোন কোন বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে আর কোনগুলিকে কম… সেসবের ওপর নির্ভর করে ব্যক্তি চিকিৎসকের "বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস" কেমন হবে এবং তিনি কীভাবে কাজ করতে বাধ্য থাকবেন। বাণিজ্যের পথ এভাবে খুলে যায়। ব্যক্তি চিকিৎসকের আর ক্ষমতা নেই 'সিস্টেমের' বাইরে বা তার বিরুদ্ধে যাবার। শুধুমাত্র আর্থিক কারণে ক্ষমতা নেই তা নয়, জ্ঞান নামক আয়ুধটির নিয়ন্ত্রণও তাঁর হাতে নেই, যার ভরসায় তিনি লড়তে পারেন।

এর পরের আলোচনা সামগ্রিক ব্যবস্থা বা সিস্টেম সম্বন্ধে।

(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)

Jon O Swasthyo
Advertisment