চিকিৎসা পরিষেবার অগ্নিমূল্য ও অমানবিক হয়ে ওঠার কারণ নিয়ে আলোচনার চতুর্থ পর্বে আমরা। এই বিষয়ে অনেকেরই মতামত আছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ক্ষোভের উদগীরণ থেকে শুরু হয়ে বিলের হিসাবে গিয়ে শেষ হয়ে যায়, তাই আমরা গতানুগতিক পথটি ছেড়ে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের চরিত্রের মধ্যে ব্যবসার শিকড়টি খোঁজার চেষ্টা করেছি। প্রথম পর্বে আলোচিত হয়েছে সর্বাত্মকভাবে বিজ্ঞান-নির্ভর হবার চেষ্টা কীভাবে আধুনিক চিকিৎসা পরিষেবা থেকে মানবিকতাকে বিযুক্ত করে।
দ্বিতীয় পর্বে দেখার চেষ্টা হয়েছে বিজ্ঞানমনস্ক ও বিজ্ঞানময় হবার চেষ্টা সত্ত্বেও কীভাবে আমাদের (এমনকি শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকেরও) চিকিৎসা-বিজ্ঞান বিষয়ক ধারণার মধ্যে ঢুকে পড়ে বিশ্বাস, যে বিশ্বাসকে নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করা যায় বাইরে থেকে। এই পর্বে আলোচিত হয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবসায় বা হেলথ ইন্ডাস্ট্রির চরিত্র৷ দেখা হয়েছে কীভাবে রোগী ও চিকিৎসকদের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার যাবতীয় ক্ষমতা বড় ব্যবসায়ীদের কুক্ষিগত করার চেষ্টা হচ্ছে। এইসব আলোচনার ভিত্তিতে আজ দেখার চেষ্টা করব কেমনভাবে আধুনিক চিকিৎসার 'বিজ্ঞান' অংশটিকে কাজে লাগিয়ে নানাবিধ কৌশলে চিকিৎসক ও রোগী উভয়কেই বাধ্য করা হয় বাণিজ্যের সেবায়েত হতে!
চিকিৎসা পরিষেবা বনাম হেলথ ইন্ডাস্ট্রি
আজ কিছু সাদামাটা প্রাত্যহিক উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করি। মন খোলা রাখতে হবে, কারণ আধুনিক চিকিৎসায় বিজ্ঞানের ব্যবহার কিন্তু পুরোটাই ধনতন্ত্রের ষড়যন্ত্র নয়। ওরকম সর্বগ্রাসী কন্সপিরেসি থিওরি কোনো কাজের নয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতিই চিকিৎসাবিদ্যাকে আধুনিক করেছে এবং তার সঠিক প্রয়োগে বেশ কিছু দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা সম্ভবপর হয়েছে এবং কঠিন রোগে আক্রান্ত মানুষের বাঁচার সম্ভাবনা বেড়েছে। এই সত্যটা মেনে না নিয়ে কথা শুরু করলে আমরা শুরুতেই ভুল পথ ধরব এবং সেই পথে চলে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর সম্ভাবনা প্রবল। বিজ্ঞানের এই জরুরি প্রয়োগ কীভাবে চিকিৎসক এবং রোগীকে একটি নির্দিষ্ট দিকে টানতে থাকে, কেমন করে তা একসময় চিকিৎসক ও রোগীর ভাবনার ওপর আধিপত্য করে, কীভাবে আমরা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি এবং কীভাবে ব্যবসা তার নিজস্ব ধর্ম অনুযায়ী এই সমগ্র ব্যাপারটিকে কাজে লাগায়… সেগুলোই দেখার।
উদাহরণ হিসেবে প্রথমে ক্যান্সার চিকিৎসার কথা ধরা যাক। ক্যান্সার একটি মারণ ব্যাধি এবং তাকে ঘিরে মানুষের আতঙ্ক প্রবল। ক্যান্সার চিকিৎসায় লক্ষণীয় বৈজ্ঞানিক উন্নতি হয়েছে এবং হচ্ছে। আধুনিক যন্ত্র প্রশিক্ষণের ফলে শল্যচিকিৎসায় উন্নতি হয়েছে। রেডিওথেরাপির মূল ভাবটি এক থাকলেও তার প্রয়োগ ক্রমশ নিখুঁত হয়েছে। পুরনো যন্ত্রের দ্বারা যে রেডিয়েশন দেওয়া হত, তাতে টিউমারের আশেপাশে অনেকটা জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হত।
আধুনিক যন্ত্রে থ্রি-ডাইমেনশনাল মডেল, নানারকম শিল্ড এমনকি নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরের সামান্য নড়াচড়াটুকুকে মেপে এবং সেই অনুসারে রশ্মির গতিপথ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে আশেপাশের টিস্যুকে বাঁচিয়ে টিউমারটিকে বেছে নিয়ে আক্রমণ করা সম্ভব। এতে চিকিৎসায় সাড়া দেবার সম্ভাবনা বেশি, ক্ষতির সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম। এই নতুন যন্ত্রগুলি স্বভাবতই দামি এবং এই উন্নততর রেডিয়োথেরাপির খরচ বেশি। যখনই বাজারে নতুনতর যন্ত্র আসে, সামনের সারির বাণিজ্যিক হাসপাতালগুলির উপর চাপ থাকে সেই যন্ত্র কেনার, কারণ তা না হলে রোগীরা অন্যত্র চলে যাবেন।
চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও বিশ্বাস
এভাবে যন্ত্র উৎপাদক সংস্থার বাণিজ্য সচল থাকে এবং নতুন যন্ত্রে চিকিৎসার খরচ বাড়তে থাকে ক্রমশ। খেয়াল করলে দেখা যাবে, চিকিৎসার কিছু উন্নতি হল অবশ্যই, কিন্তু নিম্নবিত্ত মানুষ যদি কম খরচে অপেক্ষাকৃত পুরনো চিকিৎসা বেছে নিতে চান, তবে তাঁর সামনে সুযোগ কমে এল। যাতে কোনও পরিষেবা প্রদানকারী চাইলেও পুরনো পদ্ধতিতে স্বল্প খরচে চিকিৎসা দিতে না পারেন (শুধু ক্যান্সার চিকিৎসা নয়, সবরকম চিকিৎসার ক্ষেত্রে), তা নিশ্চিত করার জন্য আছে বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থা যার দ্বারা সর্বদা চিকিৎসক ও হাসপাতালগুলি আতঙ্কিত করে রাখা হয়। সেই বিষয়ে পরে আলোচনা করব। ঘটনা হল, এর ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াচ্ছে যে দাম দিয়ে কিনতে পারলে আপনি উন্নততর চিকিৎসা পাবেন, কিন্তু যাঁরা তা পারবেন না, তাঁদের হয়ত আদৌ চিকিৎসা হবে না। বেসরকারিকরণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই দুই দলের পার্থক্য ক্রমশ প্রকট হবে।
ক্যান্সারের কেমোথেরাপির ক্ষেত্রেও তাই। পুরনো ওষুধগুলি কামানের গোলার মতো। অনেক ধরনের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যেমন কিছু মাত্রায় কার্যকর ছিল, তেমনি শরীরের নিরীহ কোষগুলিকে ধ্বংস করত। পরবর্তীকালে এমন ধরনের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে যা নির্দিষ্ট ধরণের ক্যান্সারের কোষের ওপর একটি নির্দিষ্ট রিসেপ্টর বা নির্দিষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়ার উৎসেচকের উপর কাজ করে, অথবা অ্যান্টিবডির মতো গিয়ে কোষগুলির একটি অংশে আটকে গিয়ে তাদের বেড়ে ওঠা, ছড়িয়ে পড়া, টিউমারের নিজস্ব রক্তনালি তৈরি ইত্যাদি বিভিন্ন কাজকর্মের কোনো একটি রুখে দেয় বা ক্যান্সার কোষগুলিকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। এইসব নতুম ওষুধ একা অথবা অন্য ওষুধের সঙ্গে জুটিতে নির্দিষ্ট ধরণের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত বেশি কার্যকর এবং এদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনায় কম (যদিও খুব কম নয়)।
এই নতুন ওষুধগুলোর দামও অনেক। কীরকম? মনে করুন এক-একটা ট্যাবলেটের দাম কুড়ি হাজার টাকার আশেপাশে। আসলে তো বিদেশি ওষুধ ডলারের অঙ্কে নির্ধারিত দামকে সত্তর পঁচাত্তর দিয়ে গুণ করে আপনার পকেটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পুরনো ওষুধগুলির কম কার্যকরিতা এবং বেশি ক্ষতি নিয়ে এত সংখ্যক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, যে চিকিৎসক আপনাকে আধুনিক ওষুধগুলি নেবার নিদান দিতে বাধ্য, নচেত তিনি অবৈজ্ঞানিক পশ্চাদপদ চিকিৎসা করার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। একথাও খেয়াল রাখতে হবে যে এসব ওষুধ দুম করে প্রয়োগ করা যায় না, কারণ এরা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই কাজ করে। সুতরাং এসব ওষুধ প্রয়োগ করার আগে শুধু সাধারণ বায়োপসি করলে চলবে না, টিউমারের কোষের নাবারুকম জেনেটিক ও রাসায়নিক পরীক্ষা করে দেখতে হবে তা কোন গোত্রের নতুন ওষুধের টার্গেট হিসেবে উপযুক্ত। বলা বাহুল্য, এই পরীক্ষাগুলিও ব্যয়সাপেক্ষ।
হৃদরোগ জন্য একসময় চিকিৎসকের ভরসা ছিল স্টেথোস্কোপ, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, ইত্যাদি। ক্রমশ উন্নততর 'কার্ডিওফোনিক" স্টেথোস্কোপের পাশাপাশি এল ফোনোকার্ডিওগ্রাম, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাফ, ইকোকার্ডিওগ্রাম। এদের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জানা গেল যে পুরনো স্টেথোস্কোপ-ভিত্তিক ক্লিনিক্যাল পদ্ধতিতে অনেককিছুই সঠিকভাবে জানা বা বোঝা যেত না।
এসব পরীক্ষা সঙ্গত কারণেই অপরিহার্য হয়ে উঠল। ক্রমশ দেখা গেল অ্যাঞ্জিওগ্রাম, কার্ডিয়াক ক্যাথিটারাইজেশন ইত্যাদি ছাড়াও অনেক বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। এগুলোও অপরিহার্য হয়ে উঠল। হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় জমাট বাঁধা রক্তকে গলিয়ে দেবার জন্য প্রথমে এল স্ট্রেপটোকাইনেজ। তারপর অ্যাল্টেপ্লেজ বা টিস্যু প্লাজমিনোজেন অ্যাক্টিভেটর নামক আরও বেশি শারীরবৃত্তীয় এবং বেশি কার্যকর, কম ক্ষতিকর অনেক দামী এক ওষুধ। ক্রমশ এল তার কিছু ভাইবোন বা সন্তান। তারুপর দেখা গেল এসব ওষুধই যথেষ্ট নয়। তাড়াতাড়ি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে দেওয়াই সেরা চিকিৎসা। খেয়াল করুন, চিকিৎসা কিন্তু ধাপে ধাপে উন্নত হয়েছে।
সমস্যা হল, প্রতি ধাপে বেড়েছে খরচ। ওষুধ তো তাও দাম দিয়ে কিনতে পারলে ছোট বা মাঝারি হাসপাতালে প্রয়োগ করা যেত, কিন্তু অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করাতে চাইলে আপনাকে কিছুটা বড় হাসপাতালে যেতে হবে উন্নত যন্ত্র আর প্রশিক্ষিত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সন্ধানে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদেরও ভিড় করতে হবে সীমিত সংখ্যক বড় হাসপাতালেই, কারণ অন্যত্র পরিকাঠামোর অভাবে তাঁরা কাজ করতে পারবেন না। ব্রেন স্ট্রোকের চিকিৎসাও হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসার পথে এগোচ্ছে এবং এই প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি আরও বেশি দামী। অন্যান্য স্নায়ুরোগের চিকিৎসাও ক্রমশ উচ্চ প্রযুক্তি ও দামী ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। স্নাযুরোগ বিশেষজ্ঞরাও বাধ্য হচ্ছেন বড় হাসপাতালের সঙ্গেই যুক্ত থাকতে। একইভাবে পেটের রোগ, শল্যচিকিৎসা ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি শাখা একই অভিমুখে এগোচ্ছে।
দক্ষতা বা পারঙ্গমতার নিরিখে এ অবশ্যই উন্নতি, কিন্তু এভাবে ক্রমশ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় বড় বড় হাসপাতালগুলির হাতে, যেগুলো সরকারি না হলে প্রায় অবধারিতভাবে কর্পোরেট মালিকানাধীন। একজন চিকিৎসকের পক্ষে কর্পোরেট ফাণ্ডিং ছাড়া খুব বড়মাপের পরিকাঠামো গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। ছোট ও মাঝারি মাপের যে বিকল্পগুলো এখনও টিকে আছে, তাদের নিয়ে কিছু বাস্তব সমস্যা যেমন আছে, তেমনি প্রতিযোগিতার বাজার থেকে তাদের মুছে দেবার জন্য যে সংগঠিত প্রচেষ্টা চলছে, তার আলোচনা পরে করব।
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)