১৯৬৫র তামিলনাড়ু, ১৯৬১র ১৯ মে বরাক এবং ১৯৫২ র পূর্ব বাংলার ইতিহাস মনে পড়ছে।
হিন্দিভাষী স্বার্থের গড়, দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার চেয়েছিল ১৯৬৫ সালে হিন্দিকে একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারি ভাষা করে দিতে। তার প্রতিবাদে অহিন্দি জাতিগুলো গর্জে উঠেছিল, তামিলনাড়ুর রাজপথ তামিল ছাত্র-যুবদের রক্তে লাল হয়ে গেছিল। তামিলনাড়ু বুক চিতিয়ে লড়েছিল হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে৷ তামিলরা অহিন্দি জাতি গুলোকে পথ দেখিয়েছিল, কিছুটা হলেও ঠেকাতে পেরেছিল হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসাত্মক খেলাকে। হিন্দিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একমাত্র সরকারি ভাষা বানানো আটকানো গিয়েছিল।
১৯৬১র ১৯ শে মে আসামে অসমীয়া জাতিবাদী পুলিসের গুলিতে ১১ জন বীর বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন৷ বরাকের বাঙালি লড়েছিলেন বুক চিতিয়ে।
আরও পড়ুন, ঘরে কী কী বই আছে?
গুজরাটি বানিয়া জিন্নাহ পূর্ববঙ্গে এসে 'এক দেশ, এক ভাষা'র ডাক দিয়েছিল৷ বাঙালির উপর চলেছিল উর্দুর স্টিম রোলার। বাঙালি মেনে নেয়নি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রেঙেছিল রফিক, বরকতদের তাজা রক্তে৷ বাকিটা ইতিহাস... পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি পৃথিবীকে দেখিয়েছিল ভাষার জন্য একটা জাতি কী করতে পারে৷
আজ সালটা ২০১৯। ১৪ ই সেপ্টেম্বর ছিল হিন্দি দিবস৷ অহিন্দি জাতির টাকায় হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিজয় দিবস। ভারতের গুজরাটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডাক দিয়েছে ভারতকে হিন্দিভাষী রাষ্ট্র (হিন্দিস্তান) বানানোর। স্লোগান দিয়েছে 'এক দেশ, এক ভাষা'র। অহিন্দি জাতিগুলোর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের ডাক দিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ ভারতের মতো বহুজাতিক ও বহুভাষিক রাষ্ট্রের ভিত্তিকে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীরা৷ অহিন্দি জাতির রাজ্যগুলোতে গুজরাটি ও মারোয়াড়ি পুঁজিপতিদের বাজার তৈরি এবং সেই বাজার ও এলাকা দখলে রাখতে বিরাট জন্মহারের হিন্দি রাজ্য থেকে বাংলার মত অহিন্দি রাজ্যে পিলপিল করে লোক ঢুকিয়ে জনবিন্যাস পাল্টানোই হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য৷ একতার নামে এরা গোটা ভারতকে অখণ্ড উত্তর প্রদেশ বানাতে চায় এরা। ভাষা-মাটি-ব্যবসা-পুঁজি দখলের লড়াই এটা।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ চিরাচরিত সব সাম্রাজ্যবাদের মতই অহিন্দি জাতির অধিকারের আওয়াজকে ভয় পেয়ে কুৎসা ছড়াচ্ছে। এটাই হয়। আমরা অহিন্দি জাতিগুলো হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ব, লড়তে হবেই। বাঙালি জাতির অস্তিত্ব বজায় রাখতে প্রতিরোধই একমাত্র পথ৷ আমাদের মায়ের মাটিকে রক্ষা করতে আমরা শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ব। আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের অধিকার বাঁচাতে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। বাংলাকে রাম-লক্ষ্মণ-আল্লাহ বাঁচাবে না, সেই বাঙালিই বাঁচাবে।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: স্বাস্থ্য পরিষেবা ও নাগরিকত্ব
আজও দক্ষিণের জাতিরা সামনে থেকে পথ দেখাচ্ছে৷ তামিল জাতির নেতা এম কে স্ট্যালিন এখন হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি আন্নাদুরাই ও করুনানিধির লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন৷ কিন্তু আজ আমরাও নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত৷ বাংলার দলগুলো সজাগ না৷ এই বিপদের দিনেও পথে নামছে না৷ বাস্তবে বাঙালির দল বলে কেউ নেই এই বাংলায়৷ কিন্তু আমরা এই প্রজন্ম কিন্তু খেলা ঘোরাতে নেমেছি। আমরা সুভাষচন্দ্র, বাঘাযতীন, সূর্য সেনের জাতি। আমরা কি করতে পারি তা ইতিহাস জানে। আমরা আবারও ইতিহাস গড়তে প্রস্তুত। আগামীর ইতিহাস অন্যরকম হতেই হবে। কারণ এ লড়াই বাঙালীর বাঁচার লড়াই। এ লড়াই জিততেই হবে।
বাঙালী ডাকছে, মা ডাকছে, সাড়া দিতেই হবে।
(গর্গ চট্টোপাধ্যায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনের সংগঠক, মতামত ব্যক্তিগত)