সংবিধানের ধারাবিবরণীতে আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো, গুরুগম্ভীর আলোচনায় কিংবা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মিছিলে হাঁটা ছাড়া রাস্তাঘাটে, অথবা চায়ের দোকানে, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা আদৌ গ্রাহ্য হয় কি? কখনও প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সমীক্ষা করেছেন কি যে ঠিক কতজন পড়ুয়া হিন্দু ধর্মের?
দেশের কথা থাক, ভুলে যান রাজ্যের কথাও। আমাদের এই শহরের সবচেয়ে শিক্ষিত, প্রগতিশীল এবং বাম থেকে অতিবামপন্থী ছাত্রসংগঠনের উপস্থিতি সত্ত্বেও মোট কটি আলোচনাসভা হয়েছে এই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যে আলোচনায় সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের অস্বাভাবিক সংখ্যালঘুত্বের কথা উঠে এসেছে?
কলকাতা শহরের নামজাদা সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা একবার ভেবে দেখবেন কি, যে তাঁদের পেশায় গত তিরিশ বছরে যে কয়েক হাজার ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছেন, তাদের মধ্যে মোট কতজন সংখ্যালঘু? আজকের দিনে এই লেখার সময় যে কয়েকজনকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁদের সবার কাছ থেকে উত্তর একটাই। মোটের ওপর নামকরা জায়গাগুলোতে হিন্দু পড়ুয়াদের সংখ্যা নিরানব্বই শতাংশের কাছাকাছি। চুঁচুড়া, চন্দননগর, বারাসত, কৃষ্ণনগর, বহরমপুরের মতো মফস্বল শহরের কলেজে সংখ্যালঘুদের অনুপাত সুবিধের না হলেও তুলনায় ভালো।
আরও পড়ুন: গরুর কুঁজে সোনা, কুকুর খাও, কেন বলেন দিলীপ ঘোষ?
একই প্রশ্ন আসবে এ শহরের সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক নেতাদের সংখ্যাগুরুত্ব নিয়ে। বাংলা টেলিভিশনের পর্দায় সন্ধের তর্কবিতর্কের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। উত্তর একই। অর্থাৎ আমাদের এই কলকাতা, যা নাকি সংস্কৃতির পীঠস্থান, যেখানে নাকি গত শতকের শুরুতে বাংলার নবজাগরণ হ্যালোজেনের হলুদ আলো আবিষ্কার করে ফেলেছিল, সেখানে কিন্তু সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব বিশেষভাবে কম। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বৈঠকখানায় বসে থাকা কলকাতার বুদ্ধিজীবী বাঙালিদের লাল চায়ের আসরে টিকিদেরই প্রাধান্য, ছুঁচলো দাড়ি খুঁজতে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগবে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই। আমাদের এই প্রগতিশীল শহরে মধ্যবিত্ত অথবা তার তুলনায় আর একটু বিত্তশালী বিপুল সংখ্যক মানুষের বেশিরভাগটাই হিন্দু। রাজারহাটের আকাশছোঁয়া আবাসনে যাঁরা শাঁখা-সিঁদুর পরে রান্না কিংবা বাসন মাজার কাজ করতে আসেন, অথবা জামাপ্যান্ট পরে গাড়ি চালান, কিংবা রং-মিস্তিরির কাজ করেন, তাঁদের বেশিরভাগকেই দেখে হিন্দু মনে হলেও সত্যিটা তা নয়।
এই কলকাতায় বসে ছাগল-ভেড়া ছাড়াও অন্যান্য চারপেয়ের কাবাব চেবানো ইন্টেলেকচুয়ালদের ঠাকুরঘরে খেলনা পেতলের বাসন মাজার অধিকার পেতে, কিংবা গাড়ি ধোয়ার জন্যে, নিম্নবিত্ত সংখ্যালঘুদের বড় অংশকে সকাল-বিকেল হিন্দু সাজতে হয়। ভোটের জন্যে কিছুটা সংখ্যালঘু তোষণ ছাড়া এ রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলির সংখ্যাগুরু নেতানেত্রীদের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে তাই বিশেষ দায়বদ্ধতা নেই।
বিষয়টা যে আজকের এবং পুরোপুরি বিজেপি-নির্ভর, এমনটা নয়। এপার বাংলার সংখ্যাগুরু মনে হিন্দু উগ্রবাদ লুকিয়েই ছিল। দেশভাগ তার একটা বড় কারণ। কিন্তু মধ্যপন্থী কংগ্রেস আর বামপন্থী সিপিএমের দীর্ঘ শাসনকালে তা রাজনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নি। গোলমালটা হিন্দু বা মুসলমান ধর্মের নয়। আসল ঝামেলা লুকিয়ে আছে বাঙালির মনে। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানে কবি আর কবিতা মিলেমিশে গেলেও, দুই জায়গাতেই সংখ্যাগুরুদের প্রভাব অপরিসীম।
আরও পড়ুন: অযোধ্যা মামলা: একতার রায়
ওপার কিংবা এপার, দুই বাংলাতেই কোণঠাসা সংখ্যালঘুরা, কোথাও নাম হিন্দু, কোথাও বা মুসলিম। আমেরিকা বা ইউরোপে গিয়ে থাকার একাকীত্বে দুই বাংলা মাঝে মাঝে এক হলেও, সেখানেও তফাৎ একেবারে চোখে পড়ে না, এমনটা নয়। ওপার বাংলায় সংখ্যালঘুদের ওপর উৎপাতের খবর সংবাদমাধ্যমে পড়তে হয়। ক্রমহ্রস্বমান সংখ্যালঘু জনসংখ্যা অবশ্যই সেখানকার সংখ্যাগুরুত্বের প্রমাণ দেয়। আর এপার বাংলায় সে দাপাদাপি যে উর্দ্ধমুখী, তা দিনের আলোয় প্রত্যক্ষ করছেন সকলে। দূর্গাপুজো এখন কমপক্ষে দু-সপ্তাহের উৎসব। এক নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে গণেশ এবং জগদ্ধাত্রী পুজো। এছাড়া আজকাল বিহার এবং উত্তর ভারতের হিন্দি ভাষাভাষী মানুষের উৎসবেও সামিল কল্লোলিনী কলকাতা এবং আশেপাশের মফস্বল শহর।
এইখানেই একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। উত্তর ভারতে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের মত রাজ্যে, সংখ্যালঘুরা কিন্তু এ রাজ্যের মতো পিছিয়ে নেই। সেখানে সচ্ছল মানুষদের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির সংখ্যা এ রাজ্যের মতো কম নয়। সেখানে হিন্দুদের উৎসব অবশ্যই অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো বিজেপির উত্থানের সঙ্গে তা সমানুপাতে পরিবর্তিত হয় না।
অযোধ্যা রায়ের পর কলকাতার শিক্ষিত সমাজের বক্তব্যে বারবার একথা উঠে আসছে যে এরপর কাশী, বৃন্দাবন কিংবা মথুরায় আবার কোনও এক মসজিদ খুঁজে বার করে হিন্দু উগ্রবাদের সলতে পাকাবে বিজেপি। কিন্তু সেই ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি কেন কলকাতার বুকে এক দিনের বদলে পাঁচ দিনের জগদ্ধাত্রী পুজো দেখে একটুও অবাক হচ্ছেন না? চন্দননগর এবং কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো অবশ্যই বহু বছর আগে থেকেই যথেষ্ট বিখ্যাত ছিল, কিন্তু সেখানেও রমরমা বেড়েছে অনেকগুণ। কলকাতার গণেশপুজো আর কয়েক বছর পর না মুম্বইকে ছুঁয়ে ফেলে।
মহারাষ্ট্রেও কংগ্রেসকে সরিয়ে বিজেপি-শিবসেনার সরকার রাজত্ব করেছে। কিন্তু তার জন্যে গণপতি বাপ্পার পুজোর দিন বাড়াতে হয় নি। এই বাংলায় বিজেপি আসার জন্যে উগ্র হিন্দুবাদের প্রভাব বাড়ে নি, বরং বাঙালি মন বিজেপি এবং তৃণমূলকে ব্যবহার করেছে সম্প্রদায়ের চোঁয়া ঢেকুর উগরে দিতে। বাম আর কংগ্রেস ভোট তাই স্বাভাবিক নিয়মে আশ্রয় নিয়েছে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ব্যানারে লড়াই করা বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেসের ঝুলিতে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাঙালি সংস্কৃতিমনস্কতার স্থিতিজাড্যের কারণে বাম-কংগ্রেসের হাতে তিরিশ শতাংশের বেশি সমর্থন ছিল। যেই সে বাঁধ ভেঙে গিয়েছে, অমনি মাত্র দশ শতাংশের আশেপাশে নেমে গেছে সেই ভোট। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা যাদের দেখছি, তারাই এই বাংলার সচেতন জনগণ।
আরও পড়ুন: মহারাষ্ট্রের অচলাবস্থায় অবাক হওয়ার কী আছে?
অযোধ্যা রায়ের পর সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাওয়া উচিত কেন্দ্রের শাসক দলের। সামরিক জাতীয়তাবাদ এবং উগ্র হিন্দুত্বের যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছিল, তার অনেকটাই বাস্তবায়িত করেছে বিজেপি। সংবিধানকে কিছুটা চমকে দিয়েই হোক কিংবা বিচার ব্যবস্থাকে, জনগণকে যা বুঝিয়েছিল সেই পথেই এগোচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। বরং এটা বলতে হবে যে ক্ষমতার দ্বিতীয় ইনিংসে অত্যন্ত কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত রূপায়িত হওয়ার পরেও দেশে মোটামুটি একটা শান্তি বজায় আছে। কয়েকটি জায়গায় পরিস্থিতি অবশ্যই থমথমে, কিন্তু কখনোই তা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতের বাইরে বেরিয়ে যায় নি।
অযোধ্যা রায় দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত। হাজার পাতার বেশি যে বিশাল তথ্যরাশি পাঁচজন সম্মানীয় এবং মাননীয় বিচারপতি পেশ করেছেন, তার মধ্যে বহু বিষয় আছে যেখানে পক্ষের এবং বিপক্ষের যুক্তি পাশাপাশি পেশ করা হয়েছে। সবশেষে একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন তাঁরা। সেই সিদ্ধান্ত সরাসরি আজকের শাসক দলের পক্ষে গেছে। কিন্তু তার মানেই তো এই নয় যে সেই সিদ্ধান্ত চরম সত্য। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবেদন করার আইনসম্মত উপায় আছে আমাদের দেশের নিয়ম কানুনে।
ন্যায়ালয়ের কোন একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক উপায়ে মতামত পেশ করার অনেক রাস্তা আছে। কিন্তু ঠিক কী ভূমিকা নিল দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি? কংগ্রেস তো ১,০৪৫ পাতার রায়কে মাত্র তিনটি বাক্যে সমর্থন করে ফেলল। বুলবুলের আঘাত সামলাতে ব্যস্ত রাজ্য সরকার, এবং একথা সত্যি যে বিপর্যয় মোকাবিলাই আশু কর্তব্য। আশা করা যায়, এই দুর্যোগ পেরিয়ে গিয়ে অযোধ্যা রায় নিয়ে নীরবতা ভাঙার সুযোগ পাবেন তৃণমূলের সর্বাধিনায়িকা।
কিন্তু আরও সপ্তাখানেক পরেও তাঁর মন্তব্য যদি না শোনা যায়, তাহলে বুঝতে হবে প্রশান্ত কিশোর তাঁকে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার পথেই হাঁটতে বলেছেন, যেখানে অযোধ্যা রায়ের এতটুকু সমালোচনা বাঙালি হিন্দু ভোটের ভাগ কমিয়ে দিতে পারে। আর সবচেয়ে অবাক করার মত বিষয়, বামপন্থী দলগুলির অতি সাবধানী বক্তব্য। হয় তাঁদের পুরো কথা সংবাদমাধ্যম ছাপছে না, নয়তো তাঁরাও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বললে ঝুলির শেষ কয়েকটি ভোটও বেহাত হয়ে যাবে, এই শঙ্কায় কাঁটা।
আরও পড়ুন: অযোধ্যা: আদালতের রায়, বাদুড় চুরি এবং হিজবিজবিজের হাসি
রাজনীতির একটি মূল কৌশল হলো, কিছু মতামত জনগণের মনে পৌঁছে দেওয়া। তা সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে হতে পারে, হতে পারে জনসভায় ভাষণ দিয়ে কিংবা মিছিল করে। আজকের দিনে সন্ধের টেলিভিশন বিতর্কেও অনেক মানুষের কাছে রাজনৈতিক মতামত পৌঁছে দেওয়া যায়। সেখানে বাঙালির কাছে রামের নাম অনেক বেশি করে পৌঁছচ্ছে। মনে রাখতে হবে, “তোমার নাম, আমার নাম, ভিয়েতনাম” যেমন একটা স্লোগান, “জয় শ্রীরাম”-ও তেমনই।
তবে এতকিছু সত্ত্বেও মহারাষ্ট্র কিংবা হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচন প্রমাণ করে দিয়েছে যে শুধু জাতীয়তাবাদ আর হিন্দুত্ব বেচে বিজেপি খুব সহজে রাজত্ব করতে পারবে না। সামনের ঝাড়খণ্ড ভোটে তাই বিজেপির জেতার সম্ভাবনা থাকলেও বিভিন্ন জোট জটিলতায় সেই পথ একেবারে মসৃণ নয়। পশ্চিমবঙ্গের তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচনের দিকেও নজর রাখা জরুরি। সেখানে তিনটি আসনই ভাগাভাগি হবে তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে। লোকসভার হিসেবে বিজেপির ২-১ জেতার কথা।
তবে বিজেপি আর তৃণমূলের মোট ভোট আসলে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার প্রতি সমর্থন। ফলে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রতি সমর্থন প্রমাণ করবে, ঠিক কতটা ধর্মনিরপেক্ষতা তাঁরা জনগণের কাছ থেকে আশা করতে পারেন। এক্ষেত্রে জোটের ভোট যদি দশ শতাংশের নীচে নেমে যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে রক্তাল্পতা বর্তমানে রক্তশূন্যতায় গিয়ে ঠেকেছে। আর কোনোক্রমে সেই সমর্থন যদি কুড়ি শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে তৃতীয় পক্ষ, সেক্ষেত্রে আশা রাখা যায় যে সিপিএম বা কংগ্রেস সঠিক ভূমিকা পালন না করলেও জনগণ জোট বাঁধতে শুরু করেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার ছাতার তলায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও, বাস্তবে সে সম্ভাবনা শূন্যের খুব কাছাকাছি।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)