Advertisment

ভারতীয় গণতন্ত্রের সেকাল, একাল, পরকাল?

এখন আমরা এক অদ্ভুত গণতন্ত্রে বসবাস করছি। এই গণতন্ত্র হলো এক প্রতিভাত ধারণা। জ্যামিতিক প্যাডেলের মত। আসলে সমাজটা শ্রেণীবিভক্ত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
indian democracy

মালেগাঁওয়ে প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন। ছবি: অমিত চক্রবর্তী, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

তখন তো আমি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমাদের লিটল ম্যাগাজিনে প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তা হবে ১৯৮০-৮১ সালের কথা। লিখেছিলাম, প্রজাতন্ত্র দিবসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাজনেতাদের ভাষণে উত্তপ্ত করতালিতে স্বাধীনতা নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ঠিক কতখানি স্বাধীনতা পেলাম আমরা? ঠিক কতখানি সামাজিক ক্ষমতা?

Advertisment

সংবিধানে লেখা আছে, সাম্যের অধিকার। কিন্তু সেদিন লিখেছিলাম, ভারতের প্রতিটি নাগরিকের সামাজিক পূর্বশর্ত যদি এক না হয়, তবে সাম্যের অধিকার প্রত্যেক নাগরিক কিভাবে পেতে পারে? কোনও শিল্পপতির পুত্র আর আপনার পুত্র, দুজনেরই ব্যবসা করার অধিকার আছে। কিন্তু এই নাগরিক সমান অধিকার কি সত্য, আজ এত বছর পর যখন আমি ৫৮, আর ভারতের প্রজাতন্ত্রের বয়স হলো ৭১? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের বাংলা অনলাইন পাঠক-পাঠিকাদের জন্য লিখতে বসেও মনে হচ্ছে, সেদিনের যে অবস্থান ছিল, আজও তাতে কোন 'মৌল' পরিবর্তন তো হলো না।

১৯৪৭ সালে দেশের যে অর্থনীতি ছিল, আজ তার চেয়ে আমরা নিশ্চয়ই অনেকটা এগিয়ে এসেছি। এ হলো পুঁজিবাদের বিকাশ। মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের বিকাশ। এদেশ নিশ্চয়ই এগিয়েছে। সামন্ততন্ত্র থেকে যেভাবে পুঁজিবাদ এগোয়। একেই বলে সামাজিক রূপান্তর। কিন্তু এই রূপান্তরের জন্য আমরা যতই পাঁচসালা পরিকল্পনা গ্রহণ করি না কেন, বাস্তবে তো এ হলো সামাজিক ডারউইনবাদ।

তখন ক্লাস ফোরে পড়ি সম্ভবত। হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির কাছে একটা কোয়ালিটি আইসক্রিম এর স্টল থেকে দাদামশাই আমাকে ভ্যানিলা আইসক্রিমের একটা কাপ কিনে দিয়েছিলেন। কাপের মাথার ঢাকনাটা ফেলে আইসক্রিমটা খেতে যেতেই দেখলাম, এক আদুল গায়ের নোংরা ছেলে সেটা তুলে নিয়ে তাতে লেগে থাকা আইসক্রিমটা চাটছে। চাটতে চাটতে ছেলেটি আমার আইসক্রিম খাওয়াটা পুরো দেখছিল। সেদিন আইসক্রিমটা পুরো খেয়েছিলাম, কিন্তু আজ এত বছর পরও অনুতাপ হয়।

আজ গোটা দেশ জুড়ে বিতর্ক হচ্ছে গণতন্ত্র নিয়ে। এক পক্ষ বলছে, মোদী তথা বিজেপির নেতৃত্ব ভারতীয় গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করছে। অখন্ড ভারত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। অসহিষ্ণুতা এবং সাম্প্রদায়িকতার শিকার এদেশ। উদার গণতান্ত্রী বামপন্থী সমাজতন্ত্রী শিবিরের বক্তব্য এটি। আরও মজার ব্যাপার, ব্রিটিশ এবং মার্কিন সংবাদমাধ্যম এই মোদীত্ব এবং হিন্দুত্বের কড়া সমালোচক হয়ে উঠছে। আমেরিকার দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোটের আগে ভারত সম্পর্কে যাই মনোভাব দেখান না কেন, মোদির ওপর নির্ভরশীলও বটে। আবার 'দ্য ইকোনমিস্ট' পত্রিকার প্রচ্ছদ নিবন্ধ হলো, 'অসহিষ্ণু ভারত'। কিভাবে মোদী পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। সেই মার্কিন পুঁজিবাদী সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা আর ভারতের বামপন্থী কমিউনিস্ট এবং উদারবাদীদের সমালোচনা একই সুরে বাঁধা পড়েছে।

এখন আমরা এক অদ্ভুত গণতন্ত্রে বসবাস করছি। এই গণতন্ত্র হলো এক প্রতিভাত ধারণা। জ্যামিতিক প্যাডেলের মত। আসলে সমাজটা শ্রেণীবিভক্ত। কিন্তু দাসপ্রথার মত নির্মম সময় তো নয়। আঙ্কল টমস কেবিন-এর দিন অতিবাহিত হলেও পুঁজিবাদের সুগার কোটিংয়ে সেই দাস প্রভুরা আজও আছে। এলিটতন্ত্রের গণতন্ত্র নামক এক সর্বরোগহরা বটিকা সেবনে।

এই যে পারসেপশন, গণতন্ত্রের পারসেপশন, এ হলো আধুনিক মিডিয়ার পারসেপশন। 'পিপলি লাইভ' ছবিটি দেখেছেন? আধুনিক মিডিয়া নয়, প্রযুক্তি কীভাবে গরিব-গুরবো রাম-শ্যাম-যদু-দের সমাজের ব্যাপারে উপরের স্তরে তুলে আনে। সে হলো 'টোকেনইজম'। একজন অ্যাসিড আক্রান্ত মহিলা দীপিকা পাড়ুকোনের বন্ধু হয়ে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন সমাজকে। 'ফেমিনা'র কভার স্টোরি হচ্ছে। অভিজাত সমাজ পড়ছে। মন্দ কী? গণতন্ত্র প্রসারিত হচ্ছে। প্রজাতন্ত্র দিবসে কত সাধারণ মানুষ অদৃশ্য নায়ক হয়ে পদ্ম সম্মান পাচ্ছেন, গণতন্ত্র। মন্দ কী? কত কত বাউল আজও না খেতে পেয়ে মরেন। কিন্তু একজন পূর্ণদাস আমেরিকায় গিয়ে গান গেয়েছেন। তারপর আরও কেউ কেউ। মন্দ কী?

'আকালের সন্ধানে' ছবিতে স্মিতা পাতিল অভিনেত্রী। নায়িকা গ্রামের গরিব মেয়ের ভূমিকায়, আর গ্রামের সত্যিকারের গরীব মেয়ে শ্রীলা শ্যুটিং দেখতে দেখতে আঁতকে ওঠে। চিৎকার করে ওঠে সত্যিকারের দারিদ্র্যের যন্ত্রণায়। অলীক মায়া আর বাস্তবতা মিলেমিশে যায়। মনস্তত্ব দার্শনিক উইং তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, "আমার দুই সত্তার মধ্যে যেন দুটো প্রাচীর। আজ এত বছর পর পিছন ফিরে তাকালে মনে হয় প্রাচীরের প্রাচীরত্ব নেই। ট্রান্সপারেন্ট দেওয়াল। আমি এদিক থেকে দেওয়ালের ভেতর ফুঁড়ে ওদিককার সব দেখতে পাচ্ছি।"

এখন বলা হচ্ছে, হিন্দুত্ব হলো রাজনৈতিক দর্শন। কে হিন্দু? কে অহিন্দু? বিজেপির জন্ম তো আজ? কিন্তু ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশরা কি হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ রচনা করার জন্য দায়ী? না, আসলে স্বাধীনতার বহু আগে ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ হয়? অভিনব চন্দ্রচূড় তাঁর সাম্প্রতিকতম বই 'Republican of Religion'-এ বলেছেন, হিন্দু অধিকার জন্মানোর বহু আগেই নিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্র খন্ড খন্ড হয়ে গেছে। ১৮০০ থেকে ১৮৫০, এই সময়ে ভারতে কম হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়নি। কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনে পশ্চিমী ধর্মনিরপেক্ষতার টোটকায় গণতন্ত্রের এই হিন্দু দর্শনও অবহেলিত হয়। জাতির ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকতাকেও আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি। তাও নাকি নিম্নবর্গের ক্ষমতায়ন, উচ্চবর্ণ মানেই শোষক? গরিব ব্রাহ্মণও তো শাসিত হতে পারে 'পথের পাঁচালী'র হরিহরের মতো?

আজ এত বছর পর ভারতের আরেকটি প্রজাতন্ত্র এসেছে। তখনও বিতর্ক চলছে। চলছে। চলছে। আমি সিনিক থেকে সিনিক-তর হচ্ছি। তবু উৎপল দত্তর শেষ বয়সের ছবি 'বৈশাখী মেঘের' শেষে জোর করে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, লাল রংয়ের সে দৃশ্য নাইবা দেখলাম! সাবেকি রচনার উপসংহারের মতো আশা ও প্রত্যাশার কথা নাইবা লিখলাম। যা মনে হচ্ছে সেটা বলাই বোধহয় ভালো। তবে একটা কথা ভালো, আমরা আজও গণতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক কোন অবসান ঘটাইনি।

একদা ভারতের মানুষ ছিল বনবাসী। সেই কোন ছোটবেলা থেকে শুনছি, রাজারও রাগ হলে বনবাসে যেতেন। সবাই জানি, বুদ্ধের প্রথম শিষ্য আরণ্যক প্রাণী। অরণ্যেরও ইতিহাস আছে। তবে ভারতের অরণ্য ধীরে ধীরে ধংস হয়েছে। সংসারী গৃহস্থ জীবন থেকে রাজারা বনে যেতেন। রামায়ণ ও মহাভারতে দুটো শাস্তির কথাই ধরা যাক। বনবাস ১৩-১৪ বছরের জন্য।

সপ্তশতী চন্ডীতে আছে, মন্ত্রী আমাত্য সেনাপতিদের প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য সুরথ রাজা মনের দুঃখে একা একটি ঘোড়ায় চেপে বনে চলে গেলেন। গহন বনের মধ্যে একটা মানুষ যে যাবে, চলাফেরা করবে কী করে? লোকটা খাবেই বা কী? শোবেই বা কোথায়? তিনি বনে বনে ঘুরলেন অথচ কোনও বাঘ তাঁর ঘাড়ে এসে পড়ল না। দস্যুর আক্রমণ হলো না। এমনকি সেখানে তার সঙ্গে দেখা হলো এক সমমনস্ক বন্ধুর। আরও চলতে থাকলে এক দার্শনিক মুনির গলায় অপূর্ব মন্ত্রধ্বনি শুনতে পেলেন। আরম্ভ হলো সপ্তশতী চন্ডী।

এই চন্ডীর সাহিত্য তৎকালীন যে ভারতীয় আরণ্যক সমাজের পরিচয় দেয়, তাতে বোঝা যায় যে ভারতের এই প্রাচীন সভ্যতা অরণ্য-প্রধান ছিল। নাগরিকের ধারণা না এলেও প্রাচীন ভারতে অরণ্য জীবনেও রাষ্ট্র ছিল। ঐতিহাসিক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'দ্য কন্সেপ্ট অফ ভারতবর্ষ'তে লিখেছেন, অরণ্যের সম্পর্কে রাষ্ট্রের ধারনা যেমন ছিল, তেমন প্রাচীন ভারতে অরণ্যই ছিল রাষ্ট্র।

প্রশ্ন, সেদিনের রাষ্ট্র ভাবনা, যা গঙ্গা-যমুনার তীরে গড়ে উঠেছিল, সেখানে সাম্য ছিল কতখানি? সেখানে শাসক ও প্রজার সম্পর্ক কী ছিল? 'মৃচ্ছকটিক'-এর রচনায় দেখেছি রাজা ও প্রজার বিভাজন। অভিজাত সম্প্রদায়, এমনকি তস্করদের প্রবল পরাক্রম। আবার বনবাসীদের বিদ্রোহের কথাও পাওয়া যায় তৎকালীন উপজাতি সমাজে। ভারতের আধুনিক ইতিহাসে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হলেও এখন জানা যাচ্ছে, তার আগেও বহু উপজাতি বিদ্রোহ হয়েছে এদেশে। সাবঅলর্টান ঐতিহাসিকরা এই বিদ্রোহ সম্পর্কে বহু তথ্য জানাচ্ছেন আমাদের। তবে কি ২০২০ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে এই চলতে থাকা অসাম্য আর গণতন্ত্রহীনতাকে দস্তুর বলেই মেনে নিতে হবে!

নাকি প্রজাতন্ত্র দিবসে সেনাবাহিনীর অস্ত্রসম্ভার ও কুচকাওয়াজ দেখতে দেখতে বলা যায়, জয় হো!

Constituition of India Republic Day 2020
Advertisment