Advertisment

পোলবা আরও একবার বুঝিয়ে দিল, সব পেশা সমান নয়

পেশাদারিত্ব খুব ভালো কথা। তবে, এর সঠিক পরিভাষা অনেকেরই হয়তো জানা নেই। পেশাদারিত্ব মানে শুধু একটি নির্দিষ্ট কাজের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন নয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
polba poolcar accident

পোলবা দুর্ঘটনাস্থল ও ঋষভের ফাইল ছবি

আট দিন। মৃত্যুর সঙ্গে অসম যুদ্ধ এক ছোট্ট প্রাণের।

Advertisment

এই আট দিন চরম আশঙ্কা, হতাশার মাঝেও আশায় বুক বেঁধেছিলেন তার মা-বাবা, আত্মীয়-প্রতিবেশী, পরিচিতের দল। এমনকি আমরা, এই অপরিচিতরাও, টিভির খবরে চোখ রেখে আশা-নিরাশায় দোদুল্যমান থেকেছি। সব অসহায়ত্বের শেষ ভরসা ঈশ্বরকে ডেকেছি, আহা, ছেলেটা ফিরুক মায়ের কোলে।

সব আশা অন্ধকারে ডুবেছে। সব প্রার্থনা বিফল হয়েছে। ডাক্তারদের চূড়ান্ত চেষ্টা বাঁচাতে পারেনি ঋষভকে। ঋষভ সিং। সাত বছরের এই শিশুর প্রাণ কেড়ে নিল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।

দুর্ঘটনা, নাকি কিছু মানুষের চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা? ঋষভের মৃত্যুর পর তার বাবার করুণ আকুতি, "আর কোনও ঋষভের পরিবারে যেন এমন চরম ক্ষতি না হয়", পৌঁছবে কি এইসব দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের কানে?

পোলবার পুলকার দুর্ঘটনা ও তার পরবর্তী ঘটনাক্রম নিয়ে বিস্তারে যাব না। সংবাদমাধ্যম সূত্রে সবাই সেসব জানেন। সত্যি কথা বল,তে পুলকার দুর্ঘটনা এর আগেও হয়েছে। বার বার হয়েছে। দুর্ঘটনার গুরুত্ব অনুপাতে কিছুদিন হইচই হয়েছে। তারপর আবার যে কে সেই। কিন্তু এবারের ঘটনা পুরোনো সব কাহিনি ভুলিয়ে দিয়েছে। নিঃসন্দেহে ঋষভের মর্মান্তিক পরিণতি এর বড় কারণ। অতি বড় কঠিন হৃদয়ও কেঁদে উঠেছে এই ঘটনায়।

অন্যদিকে, এই দুর্ঘটনার কারণ বা প্রেক্ষিত হিসেবে যে তথ্যগুলি উঠে এসেছে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য ও ভয়াবহ। বিধির বাইরে নিয়ন্ত্রণহীন স্পিড, মাঝপথে চালক বা গাড়ির পরিবর্তন, মদ্যপান করে গাড়ি চালানো, ইত্যাদি ইত্যাদি। স্কুলপড়ুয়া কয়েকটি অসহায় শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে এমন ছেলেখেলা করা যায়? দিনের পর দিন অভিভাবকদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে, যারা এটা করে গেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তির দাবি সকলেরই। প্রশাসন এই ঘটনার পর যথেষ্ট তৎপর হয়েছে। গ্রেফতার, তত্ত্বতালাশ, রাস্তায় নজরদারি, পুলকার মালিকদের সঙ্গে মিটিং, ইত্যাদি চলছে নিয়মের হিসেবে। সেটা কতটা কার্যকর বা স্থায়ীভাবে ফলপ্রসূ হবে সে তো সময়ই বলবে।

এরপরও কিন্তু অনেক কথা থেকে যায়। শুধু শাস্তি দিয়ে কি অপরাধ আটকানো যায়? সে দুর্ঘটনা হোক বা দুর্ঘটনাজনিত অপরাধ। শাস্তি দিয়ে কি দায়িত্ববোধ শেখানো যায়? এই পুলকারটি যেখানে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়, সেই অঞ্চলের মানুষজনই নয়ানজুলিতে নেমে শিশুদের উদ্ধার করেন। টিভির খবরে দেখছিলাম, তাঁদেরই একজন মহিলা বলছেন, ড্রাইভার জানতই না ওই পুলকারে ঠিক কতজন বাচ্চা আছে! তার এই অজ্ঞতা ঋষভের মৃত্যুর ক্ষেত্রে অনেকটাই যে দায়ী, সে তো পরিষ্কার। ওই মহিলাটি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, "সংখ্যাটা জানা ছিল না বলেই ওদের খুঁজে বের করতে দেরি হয়ে যায়।" ওঁর আক্ষেপ, অসহায়তা, কোথাও যেন আমাদেরও বিবশ করে দেয় । এ যেন সমস্ত শিশুর মা-বাবা, যাঁদের বাচ্চারা পুলকারে যাতায়াত করে, তাঁদের প্রকৃত অবস্থার প্রতীক। তাঁরা প্রত্যেকেই হয়তো আতঙ্কে ভাবছেন, কাদের হাতে ছেড়ে রেখেছি আমাদের সন্তানদের স্কুলে যাতায়াত-কালীন দায়িত্বভার?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উঠে আসে, তা হলো পেশা হিসেবে দায়িত্ব। পেশাদারিত্ব খুব ভালো কথা। তবে, এর সঠিক পরিভাষা অনেকেরই হয়তো জানা নেই। পেশাদারিত্ব মানে শুধু একটি নির্দিষ্ট কাজের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন নয়। কাজের চরিত্র বুঝে দায়িত্ববোধটাকে সঙ্গে রাখাও সমান জরুরি। একজন ডাক্তার আর একজন ব্যাঙ্ককর্মীর কাজ কি এক? একইভাবে, একজন নার্স আর একজন বিউটি পার্লারে কর্মরত ব্যক্তির কাজের চরিত্র এক নয়। মানুষের জীবনের প্রশ্নে ডাক্তার-নার্সের দায়িত্ব অনেক বেশি।

একজন পুলকার চালকের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইভাবে দেখতে হবে। তাঁর হাতে কয়েকটা বাচ্চাকে পথের যাবতীয় প্রতিকূলতা কাটিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি থেকে স্কুল ও স্কুল থেকে বাড়িতে পৌঁছনোর দায়িত্ব। তাঁর উপরে ভরসা করেই অভিভাবক এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্তে থাকেন। এই অনুভবী জায়গাটা ভুলে গেলে, কাজটা দায়সারা হবে। সেই 'দায়সারা' ভাবনারই চূড়ান্ত প্রতিফলন উঠে এল ঋষভের মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে দিয়ে।

আজকের শিশুদের স্কুলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পুলকার ব্যবস্থা চালু হয়েছে বাস্তবতার কারণেই। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবেশ পরিস্থিতির বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে। অধিকাংশই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, যেখানে মা-বাবা দুজনেই কর্মরত। তার মধ্যেও অনেকেই চেষ্টা করেন যাতে ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনায়নের কাজটা নিজেরাই করতে পারেন। যাঁরা একেবারে অপারগ, তাঁরাই পুলকারের ভরসায় বাচ্চাদের ছাড়েন। প্রসঙ্গত, এই পুলকারের ভাবনাটাও বদলে যাওয়া সময়ের একটি রূপরেখা বলা যায়।

এরই পাশাপাশি উল্লেখ জরুরি, গত কয়েক দশকে ছেলেমেয়েদের স্কুল নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অভিভাবকদের চিন্তার জগতে এসেছে ব্যাপক হারে পরিবর্তন। আমাদের শৈশবে সাধারণত যে যার এলাকার স্কুলেই পড়তে যেত। ধীরে ধীরে ভালো স্কুল, একটু দূরে হলেও, সেই নিরিখেই বাবা-মায়েরা স্কুল নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন। কারণটা সেই আর্থ-সামাজিক।

জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তাগিদ, চাকরিক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা যত বাড়ল, তত তার হাওয়া এসে লাগল স্কুল-কলেজেও। আরও একটু এগোলে লেখাপড়ার প্রাথমিক স্তরে। দূর এখন আর দূর নয়! যত দূরেই হোক, 'ভালো' স্কুলের নাগাল পেতে ছেলেমেয়েদের সেখানে পাঠানো আবশ্যক হয়ে দাঁড়াল ক্রমশ। এবার তাদের যাতায়াত প্রসঙ্গ। শুরুতে শুধু স্কুলবাস। যাদের সেটার সুযোগ নেই, তারা পাবলিক ট্রান্সপোর্টেই আসা-যাওয়া করতো। কিন্তু ছোটরা তো পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যেতে পারে না, অতএব অভিভাবকরাই আনা-নেওয়া করতেন শুরুতে। এরপর তাঁরাও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। একদা গৃহবধূ মায়েরাও এসে পড়লেন কাজের জগতে। তাহলে উপায় কী? এভাবেই কখনও দেখা গেল, কোনও একজন অভিভাবকের গাড়িতে আরও কয়েকজন বাচ্চা শেয়ার করে যাচ্ছে। তাঁকে তেলের টাকাটা হয়তো সবাই মিলে দিয়ে দিচ্ছেন। এটা ছিল নিতান্তই এক পারস্পরিক বোঝাবুঝির ব্যবস্থা। এই সূত্রেই পরে কোনও এক সময় বৃহত্তর পরিধিতে শুরু হয়ে গেল পুলকার ব্যবসা।

শুধু ব্যবসায়িক কারণেই কিছু মানুষ তাঁদের গাড়ি খাটাতে শুরু করলেন। মাইনে করা ড্রাইভাররা গাড়ির চালক হিসেবে যোগ দিলেন। অনেক স্কুল, অনেক পড়ুয়া। এদিকে অনেক ক্ষেত্রেই স্কুলের পক্ষেও ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। স্থানাভাব বা অন্য কোনও কারণ। আবার স্কুলের ট্রান্সপোর্ট থাকলেও হয়তো অনেকেই অর্থনৈতিক কারণে সেটার সুযোগ নিতে না পেরে পুলকারের শরণাপন্ন হলেন। মোদ্দা কথা, ফুলেফেঁপে উঠলো পুলকার ব্যবসা। এই ফুলেফেঁপে ওঠা ব্যাপারটার মধ্যেই কোথাও যেন সস্তায় বাজিমাত করার একটা গল্প লুকিয়ে থাকে। ঘড়ির কাঁটা ধরে গাড়ি খাটাও। ড্রাইভারের ওপর সব ছেড়ে দাও। দিনের শেষে হিসেব করে টাকা ঘরে তুলে নিলে, কেল্লা ফতে। বলছি না, সব পুলকার ব্যবসায়ী ঠিক এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টা দেখেন। কিন্তু অনেকেই যে দেখেন, তাতে আর সন্দেহ কী? পোলবার দুর্ঘটনার দিন গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত গতি বলে দেয় চালক থেকে মালিক, সকলেই আক্ষরিক অর্থেই কতখানি অনিয়ন্ত্রিত, অবিবেচক, এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন।

এতকিছুর পর গাড়ির মালিক বা চালকদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নেবে সেটা যেমন দেখার একটা দিক, তেমন তারাও যে অনিয়মের অভিযোগগুলি তুলেছে, খতিয়ে দেখা প্রয়োজন সেগুলিও। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি হলো, গাড়ি চালানোর লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ বিধি প্রয়োগ। শোনা যায়, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য পরীক্ষায় বসা দূর, প্রার্থীকে নাকি আজকাল হাজিরাটুকুও দিতে হয় না। রাস্তায় চলাফেরায় প্রতিমুহূর্তে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম হয়। যেভাবে গাড়ি চালায় লোকজন, অপরের জীবন কোন ছার, নিজের জীবনেরও পরোয়া না করে, তাতে লাইসেন্স থাকা না থাকাটাই এক বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দেখা দেয়।

এহেন মানুষরাই তো পুলকারও চালায়। তাদের কাছে আলাদাভাবে অসহায় কয়েকটি শিশুর প্রতি প্রকৃত দায়িত্ববোধ থাকার আশা করাটাই বোধহয় বাতুলতা। সবচেয়ে খারাপ ব্যপার হলো, আজকাল সকলেই অলিখিতভাবে বিশ্বাস করে, টাকা ছড়িয়ে বা প্রভাব খাটিয়ে সব ম্যানেজ করে ফেলা যায়। ঘৃণ্য, গর্হিত অপরাধও। এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়ে ঋষভের মৃত্যু সত্যি কতটা বিচার পাবে, সংশয় থেকেই যায়।

Advertisment