এক অপরিচিত হাসপাতালে ঢুকলাম সকালে। প্রায় শুনসান।
ইতস্তত কিছু পরিজন মাটিতে পলিথিনের চাদর বিছিয়ে বসে। তাঁদের প্রিয়জন ভর্তি রয়েছেন চিকিৎসার জন্যে। অনেকেই সুস্থ হয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরবেন। কেউ কেউ ফিরবেন না। রোজকার কর্মব্যস্ত ওপিডি, লম্বা লাইন - আজ নেই।
গেটের সামনে আমার ভাইয়েরা দাঁড়িয়ে। আজ কর্মবিরতি। বেশ কিছু রোগীও দাঁড়িয়ে। অনেকেই এসেছেন দূরদূরান্ত থেকে। অসহায়তা তাঁদের চোখেমুখে। এমার্জেন্সি খোলা থাকলেও, অধিকাংশ মানুষই আসেন বহির্বিভাগে চিকিৎসা পেতে। কী বলা যায় তাঁদের?
আরও পড়ুন, কেন হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ রাখতেই হল?
গেটের বাইরে চায়ের দোকান। পাশে অটোস্ট্যান্ড। এক অটোচালক ভাই বলছিলেন, একজন মরল আর একজন মার খেল। কিন্তু, হয়রানি হচ্ছে কাদের? এই যে মুমূর্ষু রোগীরা রাস্তায় পড়ে আছে….
সত্যিই তো!!
ঘটনায় মিডিয়ার এক বড় অংশের ইন্টারপ্রেটেনশন সেরকমই। গতকাল চিকিৎসকনিগ্রহ সেন্টিমেন্ট নিয়ে টিআরপি-র ব্যাপারটা দেখা হয়ে গিয়েছে। আজ আর একই কথা পাব্লিক খাবে কেন?? অতএব, আজ রোগী-পরিজন সেন্টিমেন্ট।
না, শুধু সেন্টিমেন্ট তো নয়। মুমূর্ষু রোগীরা রাস্তায় পড়ে আছেন, এমনটা না হলেও, প্রশ্নটা অত্যন্ত ভ্যালিড।
একজনের দোষে বাকিরা হয়রান হবেন কেন?
কিন্তু, একটু ঘুরিয়ে প্রশ্নটা যদি করা যায়? যদি ভাবা যায়, এই পরিস্থিতি আটকান যেত? যেতেই পারত, যদি আপনি একটু এগিয়ে আসতেন?
ওয়ার্ডে ঝামেলা যখন শুরু হয়, গণ্ডগোলের একেবারে সূচনার মুহূর্তে, যদি বাকি পরিজনেরা প্রতিবাদ করেন, তাহলে কিন্তু সমস্যা বেশীদূর এগোয় না। না, তত্ত্বের বাণী শোনাচ্ছি না, একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই বললাম। আমার সৌভাগ্য, একাধিকবার যখন এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি, সহায় হয়েছেন পরিজনেরাই। একই পরিস্থিতিতে আপনি কী করেন?
আপনি হাসপাতালে এসে পরিষেবা চান, ভালো কথা। না, ডাক্তার-নার্সরা পরিষেবা দিয়ে আপনাকে দয়া করছেন না। এ আপনার অধিকার। এবং, এই কাজটা ঠিকভাবে করার জন্যেই ডাক্তার-নার্সরা মাইনে পেয়ে থাকেন।
কিন্তু, স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর এমন বেহাল দশা থাকবে কেন, এই প্রশ্ন কখনও করেছেন? চিকিৎসার জন্যে দিনাজপুরের মানুষকে কলকাতা দৌড়াতে হবে কেন, এই প্রশ্ন মাথায় এসেছে? কেন স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ডাক্তার বা নার্স বা টেকনিশিয়ান থাকবেন না উপযুক্ত সংখ্যায়? কেন চিকিৎসা কিনতে হবে অর্থের বিনিময়ে? কেন সরকারবাহাদুর সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা মজবুত করার পরিবর্তে বীমার মাধ্যমে পয়সা গুনে বুঝিয়ে দিয়ে নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলতে চাইবেন? প্রশ্নগুলো মাথায় আসেনি কোনোদিন? আপনার দরজায় সপারিষদ নেতা যখন ভোট চাইতে এসেছিলেন, এই প্রশ্নগুলো করেন নি কেন?
পাশাপাশিই, যেটুকু পরিকাঠামো রয়েছে, সেইখানেও পরিষেবা পাওয়ার জন্যে পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব কিন্তু আপনার। রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন, প্রথমে অধিকারী হও। অর্থাৎ, কিছু বলতে বা পেতে হলে, প্রথমে তার অধিকার অর্জন করুন।
খাবার খেয়ে প্যাকেট বিছানার পাশে ফেলে দেওয়া বা ওঠানামার সিঁড়ির পাশে পানের পিক-থুতু ফেলা দিয়ে যার শুরু, তারই এক্সটেনশন বা কালমিনেশন ডাক্তারকে গালিগালাজের মুহূর্তে মুখ বুঁজে থাকা। না, তিরিশ-চল্লিশজন (গতকাল প্রায় দুশো) হিংস্র মানুষ এসে হাসপাতালে যখন ভাঙচুর করছেন, সেই সময় অস্ত্রের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর বীরত্বের প্রত্যাশা করছি না। সব গণ্ডগোল তো শুরু হয় ওই জোরগলায় কথা, গালিগালাজ দিয়ে - সেইসময় যদি একটু প্রতিবাদ করেন? বিশ্বাস করুন, কাজটা কঠিন নয়।
আপনি বলবেন, পুলিশ-নিরাপত্তাকর্মী তাহলে আছেন কেন?
ঠিকই। আসুন, তাহলে একটু পুরোনো দিনের গল্প বলি।
খুব বেশীদিন আগের কথা নয়। আমাদের দেশে, এমনকি এই রাজ্যেই এমন রাজনীতিক ছিলেন, যিনি বলতেন, আমার কোনো সিকিউরিটির প্রয়োজন নেই। মানুষই আমার সিকিউরিটি। যেদিন মানুষ আমার পাশে থাকবেন না, সেইদিন আমার রাজনীতিতে থাকার প্রয়োজন নেই।
আজ, রাজনীতির মানুষদের নিরাপত্তার প্রয়োজন। জেড, জেড প্লাস, আরো কত কী!! কারো নিরাপত্তা জেড প্লাস থেকে একধাপও কমিয়ে দিলে, তাঁরা পাড়া মাথায় তোলেন - বলেন, খুনের চক্রান্ত হচ্ছে।
নিরাপত্তা বিষয়ে রাজনীতিকদের ভাবনার এই ধারাবদলের মধ্যেই ধরা আছে রাজনীতিকদের মানুষের সাথে সংযোগের পরিবর্তনটি। আজ রাজনীতিকরা দূরের প্রাণী - দুধসাদা স্করপিও-র জানলার কালো কাচ নামিয়ে ছুঁড়ে দেন হাসি, পাশে দৌড়াতে থাকেন কালো পোষাকের কঠিন চোখের প্রহরী - বেহালা থেকে সল্টলেক যেতে দরকার হয় হেলিকপ্টারের।
ডাক্তারবাবুরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। কিন্তু, কেমন হবে সেই নিরাপত্তা? রাজনীতিকদের মত? জেড বা জেড প্লাস?
এমন নিরাপত্তা, যেখানে সাধারণ মানুষ পাশে আসতে চাইলে কালো পোশাকে কঠিন মুখ এসে দূরে ঠেলে দেয়? ডাক্তারবাবুরা ভালো থাকবেন এভাবে?
আর আপনি?
হ্যাঁ, মনে রাখুন, আপনি ব্যর্থ হয়েছেন। নিদারুণ সেই ব্যর্থতা। ডাক্তারবাবুর কাছে আপনার প্রত্যাশার বিপরীতে আপনার যে দায়িত্ব, সেই দায় পালনের ব্যর্থতা।
আজকের কর্মবিরতি, সেই দায় মনে করিয়ে দেওয়ার। না, হয়রানির মাধ্যমে সেই মনে পড়িয়ে দেওয়াটা কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু, আপনাকে ঘুম থেকে জাগানোর অন্য পথ ছিল কি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনার কথা আমি শুনতে পেয়েছি, ডাক্তারদের আরো বেশী মানবিক হতে হবে, অনেক বেশী দায়িত্বসচেতন হতে হবে, চিকিৎসা শুধু পেশা নয়, চিকিৎসার নামে হয়রান হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই এমন মানুষ বিরল ইত্যাদি ইত্যাদি।
জানি, আপনি মিথ্যে বলছেন না। আপনার সব অভিযোগই সত্যি।
তবে, একটা ছোট পরীক্ষা করে দেখুন। আঙুল তুলে দেখান তো পাশের লোকটির দিকে। কী দেখলেন?
হ্যাঁ, তর্জনী যখন অন্যের উদ্দেশ্যে, খেয়াল করলেন কি, বাকি চারটে আঙুল কিন্তু চেয়ে আছে আপনারই দিকে?
কথাটা, আমরা যারা ডাক্তার তাদের ক্ষেত্রেও যেমন সত্যি, ঠিক ততোখানিই সত্যি আপনার মত রোগী-পরিজনদের জন্যেও।
তাই না?
"আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দুজনে সমান অংশিদার
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার |
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।
অন্ধ হ’লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে ?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি |
ভ্রান্তিবিলাস সাজেনা দুর্বিপাকে |
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক’রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি......"
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (উটপাখি)
(বিষাণ বসু সরকারি হাসপাতালের ক্য়ান্সার বিশেষজ্ঞ)