Advertisment

ঘরের হিংসা ঘরেই শেষ হয় না

ঘরের চার দেওয়ালের মাঝে একজন মানুষ দিনের পর দিন হিংস্র ও পাশবিক অত্যাচারের শিকার হবে, আর তা 'ঘরোয়া কোন্দল' বলে পার পেয়ে যাবে? 'ঘর'টা কি সমাজের অংশ নয়?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
domestic violence meaning

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

অতি সাম্প্রতিক সময়ের এক চমকে ওঠা খবর। বাবাকে খুনের পর থানায় এসে আত্মসমর্পণ করে বছর পনেরোর এক কিশোর। খাস কলকাতার বুকে ঘটেছে এ ঘটনা। রাজারহাট থানায় যখন ছেলেটি আসে, তখন পুলিশও প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি। তারপর তারা ছেলেটির হাতে রক্তের দাগ দেখে তার বাড়ি যায়। সেখানে গিয়ে এই ভয়ঙ্কর ও মর্মান্তিক খুনের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা হয়। মেঝেতে পড়ে ছেলেটির বাবার রক্তাক্ত দেহ। পাশে হত্যার অস্ত্র - রক্তমাখা কুড়ুল ও একটি বড় পাথর।

Advertisment

খবরে প্রকাশ, প্রতিদিন তার মায়ের প্রতি বাবার অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরেই এমন কান্ড করে বসে ওই কিশোর। বাবা নিত্য মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে প্রবল মারধর করত স্ত্রীকে । জানা গেছে, এই লোকটির আরও একজন স্ত্রী বর্তমান। ইদানীং এই নিয়ে অশান্তি তুঙ্গে ওঠে, যখন লোকটি তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসবে বলে শাসায়। প্রথম স্ত্রীর প্রতি আরও পাশবিক হয়ে ওঠে তার ব্যবহার। চোখের সামনে দেখতে দেখতে এক সময় ধৈর্য হারায় ওই কিশোর। ঘটনার পর থেকে পলাতক মৃতের স্ত্রী, আর এক বোন ও বড় ছেলে। এর ফলে সন্দেহ করা হচ্ছে, একা ওই ছেলেটি নয়, সঙ্গে আরও কেউ আছে। তদন্ত চলছে। সময়মতো ঘটনাক্রম সামনে আসবে এবং আইন আইনের পথে সিদ্ধান্ত নেবে।

আরও পড়ুন: দূষণ রোধে প্রশাসনের সবচেয়ে বড় শত্রু কে? আমি, আপনি, আবার কে?

প্রশ্নটা অন্যত্র। ছেলেটি তার বাবাকে খুন করেছে। আইনের চোখে খুন মারাত্মক অপরাধ। সেই হিসেবেই তার বিচার হবে। উল্লেখ্য বিষয় হলো, এর পৌনঃপুনিকতা। দেখা যাচ্ছে, আমাদের সমাজে কিশোর বা সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেমেয়ের মধ্যে মা-বাবাকে খুন করার ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিশেষত ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা বহুল। আইনের ধারা মেনে সেই খুনের কিনারা ও বিচার হয়েছে।

সবাই তো আর সব সময় এমন ঘটনার পর আত্মসমর্পণ করে না! ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধী কে, সেটা পুলিশকেই খুঁজে বের করতে হয়। তারপর কোর্ট ইত্যাদি এবং শাস্তি। বয়সের বিচারে নাবালক হলে তার একরকম বিচার ও শাস্তি। সাবালক হলে আর একরকম। মোদ্দা কথা, কোনও ক্ষেত্রেই শাস্তি জিনিসটা খুব সুখকর তো নয়! আঠারো পার হয়ে গেলে তো তার পরিমান যথেষ্ট কঠোর ও যন্ত্রণাময়। পুরো জীবনটাই কেটে যায় একটা দাগ নিয়ে।

মনে পড়ছে, এ প্রসঙ্গে একবার প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী, নৃত্যগুরু ও সমাজসেবী অলকানন্দা রায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। উনি যে সংশোধনাগারের অধিবাসীদের মধ্যে কাজ করেন, সে তথ্য কমবেশি সবাই জানেন। শিশুদিবস উপলক্ষে একটি প্রতিবেদন লিখব, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল, কেমন আছে বা থাকে সংশোধনাগারের শিশু-কিশোররা।

উনি বলেছিলেন ওদের মর্মবিদারক জীবনকথা। নানা ধরনের অপরাধ করে সংশোধনাগারে আসে ওরা। এক্ষেত্রে খুনের অপরাধে যারা এসেছে, তাদের পরিণতির জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারই দায়ী। আর সেখানেও মুখ্য ওই পারিবারিক হিংসা। বাবা মা-কে মারছে, চোখের সামনে রক্তাক্ত, আহত হচ্ছে মা। ছোটবেলা থেকেই এই পাশবিকতা দেখতে দেখতে তার মধ্যে রাগ, ক্ষোভ, জ্বালার একটা অ্যাটম বোম তৈরি হচ্ছে। তারপর একদিন সেটা বার্স্ট করছে। অজান্তেই অপরাধের পথে পা বাড়াচ্ছে সে।

আরও পড়ুন: সভ্যতা? ভব্যতা? সে কাকে বলে?

প্রশ্ন হলো, আইন ও প্রশাসনের যথাযথ পদক্ষেপের পরও এই জাতীয় অনভিপ্রেত কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি কেন? খুনের শাস্তির গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও কেন বারবার এই অপরাধ? কী সেই প্রেক্ষিত, যেখানে সন্তান তার প্রাণপ্রিয় বাবা-মায়ের প্রাণনাশে মরিয়া হয়ে ওঠে? কী সেই ইন্ধন, যা এক অপাপবিদ্ধ কিশোর বা সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলে বা মেয়েকে খুনিতে পরিণত করে?

এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে তার জীবনযাপনের পরতে পরতেই। তার পরিবার ও পরিবেশের গর্ভে। আমরা জানি, প্রত্যেকটি অপরাধেরই কিছু মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা রয়েছে। এক্ষেত্রেও বলা যায়, মায়ের ওপর নিয়মিত ঘটতে থাকা অত্যাচারই ছেলেটির মনে তাৎক্ষণিক পাশবিকতার জন্ম দিয়েছে। কোথাও অমানবিকতা, কোথাও বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র বা ঈর্ষা-বিদ্বেষের কালো বিষাক্ত ধোঁয়ায় জর্জরিত পরিবেশ। যে শিশু তার জন্ম থেকেই পরিবারের বড়দের মধ্যে এসবের চর্চা দেখবে, সেও তো তাই শিখবে।

ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বা পারিবারিক হিংসা। প্রধানত স্ত্রীর ওপর স্বামীর পাশবিক অত্যাচার, এটা দেখার অভ্যাস আমাদের বহুযুগের। অভ্যাসই বটে। অভ্যাস বলেই যেন কোনও হেলদোল নেই। এক্ষেত্রে তথাকথিত ভাবে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে, নির্বিচারে, পারিবারিক ঘেরাটোপের ভিতর বীরের মতো চালিয়ে যাচ্ছে এই পাশবিক ও নারকীয় কান্ড।

ছোটবেলা থেকে পাড়ায়, আত্মীয়মহলে, এমন বহু দাম্পত্য টিকে থাকতে দেখি আমরা, যেখানে এক একজন মহিলা এই অত্যাচার সহ্য করে, স্বামীর সঙ্গে মানিয়ে চলার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে অনুগত স্ত্রীর ভূমিকা পালন করছেন। শিক্ষিত, অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর এমন অনেক মহিলাকেও দেখেছি দিনের পর দিন এই অত্যাচার সহ্য করছেন। উল্টোদিকে, পুরুষও অনেক সময় নির্যাতনের শিকার। সেখানে বিষয়টা হয়তো দৈহিক নয়, মানসিক। কিন্তু নির্যাতন তাতেও কিছু কম হয় না।

সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার, পরিবারের বাকিরা এই অত্যাচার মুখ বুজে দেখছেন। এক্ষেত্রে শুধু পরিবারই কেন, আত্মীয়-প্রতিবেশীদের দায়িত্বও কিছু কম নয়। কম বয়সে এই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শুনেছি, 'স্বামী-স্ত্রীর অশান্তির মধ্যে ঢুকতে নেই। ওটা ওদের নিজেদের ব্যাপার। আপনা থেকেই মিটে যাবে। আমরা বাইরের লোক সেখানে কথা না বলাই ভালো।' এই যুক্তি সেদিনও যেমন, আজও তেমনই অর্থহীন আমার কাছে। ঘরের চার দেওয়ালের মাঝে একজন মানুষ দিনের পর দিন হিংস্র ও পাশবিক অত্যাচারের শিকার হবে, আর তা 'ঘরোয়া কোন্দল' বলে পার পেয়ে যাবে? 'ঘর'টা কি সমাজের অংশ নয়?

বস্তুত, 'ঘর'-কে নিছক অন্দরমহল হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়েই আমরা ঘরের শিশু সদস্যদের কথা ভুলে যাই। কী ভয়াবহ অবস্থা হয় তার মনের, ভাবুন একবার। একদিকে মা, যিনি তার আশ্রয়, শান্তি, আদর ও আহ্লাদের কেন্দ্র। যাকে ঘিরে তার বেড়ে ওঠা। সে প্রতি মুহূর্তে সেই মাকেই লাঞ্ছিত, নির্যাতিত হতে দেখছে। আর এটা কে করছে, না, তার বাবা।

আরও পড়ুন: মিলনমেলার সিঁদুর-খেলা, সংস্কারের স্থান কোথায়?

বিশেষত ছেলেদের ক্ষেত্রে বাবা তো সামনের সেই মানুষটা, যাঁকে দেখে সে পথ চলতে শিখবে। কী শিখছে সে তাঁর কাছে? না, নারীকে অপমান, নির্যাতন ও চূড়ান্ত নিষ্ঠুর অত্যাচার করবার পাঠ। মাকে কষ্ট পেতে দেখা, আর বাবার ভয়ে প্রতিবাদ করতে না পারা, এক চরম অসহায় অবস্থার দিকে ঠেলে দেয় তাকে। উল্টোক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাবার প্রতি মায়ের মনোভাব ও আচরণও সমান কুপ্রভাব ফেলে শিশুর ওপর। বলা বাহুল্য, শিশুর মনে অপরাধের বীজ বপন হয় এভাবেই। জমে থাকা তীব্র ক্ষোভ, জ্বালা, হতাশা একদিন জিঘাংসায় পরিণত হয়।

পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ তাই শুধু আইন ও প্রশাসনের দায়িত্ব নয়। সমাজের প্রত্যেকের দায় আছে। প্রতিবাদ হওয়া উচিত ধারাবাহিক ও ব্যাপক হারে। যে পুরুষ নিয়মিত স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে অমানবিকতার চূড়ান্ত নিদর্শন রাখছে, সে আইনের চোখে সাংবিধানিক ভাবেই একজন অপরাধী। সমাজ তাকে কেমন করে ক্ষমা করে? এমন নয়, কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন। কিন্তু আইনকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য তো করবে? সামাজিক ভাবে বয়কট তো করতে পারবে? না করলে পরের প্রজন্মের অপরাধী হওয়া ঠেকাবে কে?

এক নিরপরাধ কিশোরের মায়ের প্রতি তার বাবার পাশবিক নির্যাতন দেখে খুনিতে পরিণত হওয়ার ব্যক্তিগত প্রেক্ষিতে থেমে থাকবে না এই পরিক্রমা। অপরাধ একটা সামগ্রিক সামাজিক প্রেক্ষাপট, যেখানে ঘটনা থেকে ঘটনাক্রম তৈরি হয়। পারিবারিক হিংসা থেকে পারিবারিক খুন। একজন খুনি কি অজান্তেই কখনও কখনও একাধিক খুন বা অন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে না? সংশোধনাগারে এর সংশোধন অসম্ভব। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এই বিষয়ে ভাবতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। ঘরে ও বাইরে।

Advertisment