রাজ্য সরকারের চাকরি করেন যাঁরা, তাঁদের কাছে দিনটির ব্যঞ্জনা কিঞ্চিৎ বেশি। দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার দিন। দুপুরে পাঁঠার ঝোল দিয়ে গরম ভাত খাওয়ার দিন। কিন্তু বাড়িতে কচিকাঁচা থাকলে সে আরাম সইবে না। সাত সকালে লালপেড়ে হলদে শাড়ি অথবা বাটিকের পাঞ্জাবি পরিয়ে ঘরের সবচেয়ে খুদে সদস্যটিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন ইশকুলে। আজ্ঞে হ্যাঁ, ২৩ জানুয়ারি যে! বেলা সামান্য গড়ালে যান্ত্রিক ত্রুটিবশত মাইকের বিকট শব্দ সহযোগে সারি সারি দেশাত্মবোধক গান আপনাকে ওই একটা দিনের কয়েকটা ঘণ্টার জন্য হলেও দেশপ্রেমী করে তুলবে।
ঘরে বসেই পাড়ার মোড়ের মঞ্চ থেকে আসা কেউকেটাদের ভাষণ থেকে আপনি জেনে যাবেন নেতাজী কত বড় 'দেশপ্রেমী' ছিলেন। দুপুর গড়ানোর আগেই 'নায়ক'-এর আসনে বসানো হবে সুভাষচন্দ্রকে, আর খলনায়কের আসনে? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, গান্ধীজীকে। কারণ আমরা ভিলেন ছাড়া নায়কের মাহাত্ম্য বুঝতে শিখিনি। কারণ নেতাজী আমাদের, আর গান্ধী ওদের। বিবিধের মাঝে মহামিলনের ভারতে আমরা কী সুন্দর ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছি, না? মহাত্মা গুজরাটের, ভগত সিং পাঞ্জাবের, সুভাষ আমাদের। ভারতের হয়ে থাকতে দিলাম কই ওঁদের?
আরও পড়ুন, কেন ইটালিয়ান সাজতে হয়েছিল নেতাজীকে? জানে কি আজকের প্রজন্ম?
ইতিহাসে জেনেছি, সুভাষের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিরোধ হয়েছিল মহাত্মার। ব্যাস, সিদ্ধান্তে এসেছি, দুই রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে ব্যক্তিগত তিক্ততা ছিল। ভুলে যাব, মহাত্মাই সুভাষচন্দ্রকে বলেছিলেন 'পেট্রিয়ট অফ পেট্রিয়টস'। সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে যা যা করেছিলেন সুভাষ, তার জন্য তাঁকে মনে রাখতে গেলে চিন্তাভাবনা উদার করতে হয়। তুলনায় 'দেশপ্রেম' (ক্ষুদ্র অর্থে) বোঝা অনেক সহজ এই দেশে। নেতাকে পুজো করতে হবে। ভগবানের আসনে না বসালে 'জন নায়ক' হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা হবে না। অতএব তাঁকে নিয়ে ছবি তৈরি হলে নেতার সুরা পানের দৃশ্য নিয়ে আপত্তি উঠবেই। মাকে না জানিয়ে নেতা কাউকে ভালবেসেছিলেন, এমনকী বিয়েও করেছিলেন জানলে তিনি প্রণম্য থাকবেন কী করে? আর দেশ ছাড়া আর কাউকে ভালবাসলে নেতার ভাবমূর্তিও বেশ খানিকটা ক্ষুণ্ণ হয় কী না!
অতএব ফিরে আসা যাক নৃত্যে-গানে ভরা সাংস্কৃতিক সকালে। দৃঢ় ভঙ্গীতে এক হাত সামনে তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সুভাষ। ছবিতে গাঁদা ফুলের মোটা মালা। মঞ্চে 'মুক্তির মন্দির সোপান তলে'-র ছন্দে নৃৃত্যরত খুদেরা। আর মঞ্চের সামনে খুদেদের গর্বিত বাবা মায়েরা। এইটুকুই তো আমাদের ২৩-এর সুভাষ সুখ। 'কেয়া পাতার নৌকো করে সাজিয়ে দেব ফুলে'-র সঙ্গে দুলতে থাকা ফুলগুলোর সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য এই সকাল জরুরি কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আপনার ২৩-এর নস্টালজিয়া বছর বছর ফিরে আসার জন্যেও এই সকালের উপযোগিতা রয়েছে কি না, ভাববার বিষয়। তবে দেশের আগামী প্রজন্মের বৌদ্ধিক অথবা যৌক্তিক বিকাশের জন্য এই সকাল নিতান্তই অহেতুক নয় কি?