Advertisment

হায়দরাবাদের এনকাউন্টার ও পরিতোষের বুলেট

রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অতিক্রম করে, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সংবিধানকে অস্বীকার করে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল, যার সমর্থনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলেন দেশের বেশির ভাগ মানুষ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Hyderabad Encounter, Police Encounter

ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

রঞ্জনদা বলল আসল বিষয় হল ডোপামাইন কিংবা ডোপামিন। এই হরমোন মনের মধ্যে বেশ একটা পরিতোষের ভাব রচনা করে। বুঝতে হবে যে এ কিন্তু হঠাৎ করে অনেকটা সুখানুভূতি সৃষ্টি করে এমনটা নয়। আসলে মনের বিভিন্ন আনন্দদায়ক সংবেদনগুলিকে পারস্পরিক সংযোগে সাহায্য করে এই রাসায়নিক, যার চিহ্ন সি৮এইচ১১এনও২। ঠিক এই জায়গা থেকে খোঁজ পাবি জনগণের মনের। সেখানে যদি সমষ্টিগত আনন্দবোধের উৎপত্তি হয় তাহলে সারা দেশে বেশ একটা ফিল গুড ভাব আসে। এতে সরকারের ওপর মানুষের বিশ্বাস বাড়ে। তখন পিঁয়াজ একশো চল্লিশ আর আপেল আশি কেন, সেই ভাবনা খুব বেশি খোঁচা মারে না — বেশ একটা মেরি আঁতোয়াঁতে গোছের ভাব সুড়সুড়ি দেয়।

Advertisment

রঞ্জনদার কথায় আত্মোপলব্ধি হল যে রুটি আর পিঁয়াজের টুকরোর থেকে কম খরচে কেক আর আপেল পাওয়া গেলে খারাপ কি? সঙ্গে একটা সবল সরকার। কোন সরকার ভাবার দরকার নেই। কেন্দ্রই হোক বা পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ কিংবা তেলেঙ্গানা, সরকার গড়ালেই হল। যে রাতভোরে পেট খালি করার জন্যে বিছানা ছাড়তেই আলিস্যি লাগে, ঠিক তখন চারটে গণশত্রুকে ফাঁকা মাঠে নিয়ে গিয়ে ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই। এরপর সকাল থেকে টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচার। রাষ্ট্রের একটাই মুশকিল, ভালো ভালো কাজগুলো সপ্তাহান্তে করতে পারে না। শুক্কুরে সেই অফিস যেতে হল। তাই মোবাইলে খবর পড়েই লিটার লিটার ডোপামিন ক্ষরণ। শনি কিংবা রবির ভোরে ঘটনাটা গড়ালে সকালের কড়া চা থেকে একটু বেলায় লুচি আর সাদা আলুর তরকারি পেরিয়ে দুপুরের পেঁপে সহযোগে কচি পাঁঠার ঝোল। পোড়া শরীর থেকে বুলেট বেঁধা লাশ। নিউটনের তৃতীয় সূত্র। ভাল খারাপ বিচার হবে জনমতে। মনে করিয়ে দিতে হবে প্রতিটি ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ার কথা।

আরও পড়ুন, এই বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্রের লেখা

গম্ভীর বিশ্লেষণে আইন ব্যবস্থার ওপর আস্থা কমার কথা আলোচনা হচ্ছে বারবার। সঙ্গে আসছে বিচারের দীর্ঘসূত্রীতার প্রসঙ্গ। সেই জন্যেই নাকি এই এনকাউন্টারের পর জনমনে পরিতোষের ভাব বেশি। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের ওপর খাঁটি ঘি দিয়ে পরিবেশিত হল ন্যায়বিচার। রাস্তার ওপর থেকে আইনরক্ষকদের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি হল, ভাইদের হাতে রাখি বেঁধে দিল বোনেরা।

ঘটনার পুনঃনির্মাণ সম্ভবত ভোর তিনটে থেকে পাঁচটার মধ্যে। সশস্ত্র বেশ কয়েকজন পুলিশ আর চারজন অপরাধী। হঠাৎ সেই জঘন্য অপরাধীরা ঢিল ছুঁড়ে আবার শুরু করল গোলমাল। তারপর কিনা পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পালাতে গেল — হিন্দি ছায়াছবির অতিপরিচিত রিমেক। তেলেঙ্গানার দক্ষ পুলিশবাহিনী আধলার আঘাতে সামান্য আহত হলেও ফটাফট নামিয়ে দিতে পারল চার-চারটি লাশ। সারা দেশ ঠিক এটাই চাইছিল। সেই জনমত সকাল সকাল সমর্থন করেছেন সিপিআইয়ের সম্পাদক কে নারায়ণ। তিনি বলেছেন “পুলিশি এনকাউন্টার অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যে, যেমন হয়েছিল ২০১২ সালে ছত্তিশগড়ে, যেখানে মারা গিয়েছিলেন সতেরোজন মাওবাদী কর্মী। তবে এক্ষেত্রে অভিযুক্তরা এমন সাংঘাতিক সামাজিক দুষ্কর্ম করেও হয়ত দ্রুত আইনমাফিক উপযুক্ত শাস্তি পেত না। আমরা এই পুলিশি পদক্ষেপকে সমর্থন করি এবং আশা করি এ জাতীয় ঘটনা অপরাধীদের ভীতির বার্তা প্রেরণ করবে।”

টুইটার খুঁজে দেখা যাচ্ছে যে নীতিগতভাবে এই পুলিশি প্রক্রিয়া সমর্থন করেছেন শশী থারুর। তবে তাঁর সাবধানী বক্তব্য যে আরও ভালোভাবে বিষয়টি জানতে হবে। তাঁর মতে আইনের শাসনে সাধারণভাবে পুলিশি এনকাউন্টারে মৃত্যু ঠিক নয়। অর্থাৎ এই এনকাউন্টারটি নিয়ে তাঁর বিশেষ আপত্তি নেই বোঝাই যাচ্ছে।

তেলেঙ্গানা বিজেপির মুখপাত্র কে কৃষ্ণ সাগর রাও-এর কথাও শুনতে হবে এ প্রসঙ্গে। “গণধর্ষণ এবং খুন অত্যন্ত ভয়ঙ্কর অপরাধ। বিজেপি এর তীব্র নিন্দা করেছে, এবং দায়িত্বশীল বিরোধীপক্ষ হিসেবে বারবার তেলেঙ্গানা সরকারের ওপর চাপ বাড়িয়েছে যাতে অপরাধীদের কঠিন শাস্তি হয়। একইসঙ্গে আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই যে ভারতবর্ষ ব্যানানা রিপাবলিক নয়। দেশের আইন এবং সংবিধান আছে। রাজ্য সরকার এবং পুলিশকে অতি দ্রুত সাংবাদিক সম্মেলন করে গোটা ঘটনার সঠিক বিবরণ দিতে হবে। তার পরেই দায়িত্বশীল জাতীয় দল হিসেবে বিজেপি তার মতপ্রকাশ করবে।”

মানেকা গান্ধীর মতামতও কৃষ্ণ রাওয়ের দিকেই। আবার রাজ্যবর্ধন রাঠোর পুরোপুরি সমর্থন করেছেন হায়দ্রাবাদ পুলিশকে। সব মিলিয়ে বেশ একটা তৃপ্তির ভাব থাকলেও উৎসবের আবহে অনেক ধরণের মতামত শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।

আরও পড়ুন, গোড়ায় গলদ, তাই ভারতে নারীরা সম্মান পাবেন না কখনোই

সারমর্ম করলে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে দেশের একটা বড় অংশের মানুষ গোটা বিষয়টায় খুশি। কিন্তু একটু চিন্তাভাবনা করলে অন্যান্য কিছু প্রশ্ন উঠে আসবেই। সেরকমই কিছু মতামত ভেসে আসছে অন্তর্জালে। এত তাড়াতাড়ি কি করে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া গেল যে এই চারজনই অপরাধী? যদি তা না হয় তাহলে অন্যান্য দোষীরা হয়ত এখনও নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর চারজন যদি সত্যিই দোষী সাব্যস্ত হয় সেক্ষেত্রেও তাদের এই অপরাধের পেছনে অন্য কেউ প্ররোচনা দিয়েছিল কিনা সে খবরও আর কোন দিন জানা যাবে না। তবে এই সমস্ত টুকরো বক্তব্য কোনটাই কিন্তু পুলিশের এই গুলি চালিয়ে চারজন অপরাধীকে খুন করার সম্পূর্ণ বিরোধী মত ব্যক্ত করছে না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেশের কোন মানুষ এখনও বলেন নি যে শুক্রবার ভোরে তেলেঙ্গানা পুলিশের গুলিচালনা ঠিক হয় নি।

অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অতিক্রম করে, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সংবিধানকে অস্বীকার করে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল, যার সমর্থনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলেন দেশের বেশির ভাগ মানুষ। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও একটা বড় অংশ এই সরকারি হত্যাকাণ্ডের সমর্থক। বাঙালি চেনামুখের ভিড়েও সেই সমর্থনের সুর স্পষ্ট। দেশের জনমত যদি এটাই হয় তাহলে তো এই ধরণের অপরাধের শাস্তি নিয়ে বিশেষ মতবিরোধ থাকা উচিৎ নয়। ধর আর গুলি কর। তবে এ ব্যাপারে কিছু অগ্রণী ভাবনাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তা হল এই ধরণের অপরাধীদের গুলি করে মারলে তারা নাকি কম কষ্ট পায়। সেক্ষেত্রে পাথর ছুঁড়ে মারা কিংবা জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়ার মত কিছু শাস্তি নিয়েও দেশের এবং বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষমতাশালী মানুষেরা ভাবনাচিন্তা শুরু করতে পারেন। জনমত সঙ্গে থাকলে সংবিধান সংশোধন কিংবা নতুন আইন আনা অসম্ভব কিছু নয়।

আসলে সবথেকে তাড়াতাড়ি বিচার পরিবেশিত হয় যখন জনগণ বা পুলিশ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে। সে বিচার ন্যায় কি অন্যায় সে সমস্ত জটিল প্রশ্নের প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর কিছু দেশে এখনও পাথর ছুঁড়ে মানুষ মারার আইন আছে। সেই দেশগুলো অনেক ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে বেশ সম্পন্নও বটে। কিছু সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রেও সেনাবাহিনী যখন তখন অপরাধীদের তুলে এনে হাতেগরম বিচার গিলিয়ে দেয়। ফলে আমাদের দেশের এই দাবীর পেছনে যুক্তি যথেষ্ট আছে। আর নিয়ম মেনে আইন ব্যবহার করতে গেলে চটজলদি শাস্তি দেওয়া একেবারেই সম্ভব নয়। গণধর্ষণ এবং খুনের মত অত্যন্ত জঘন্য অপরাধের ক্ষেত্রেও যে কোন দেশের বিচার ব্যবস্থায় চরম দণ্ড জারি হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।

আরও পড়ুন, কীভাবে আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করে কিছু “সরকার-সমর্থিত কুশীলব”

সুতরাং সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যদি সংবিধান মেনে বিচার প্রক্রিয়া চলে তাহলে হাতে গরম সিদ্ধান্ত পরিবেশন অসম্ভব। অন্যদিকে সময় গড়ালে শাস্তির তীক্ষ্ণতা অনেকটা কমে যায় সেকথা সকলেই জানেন। সীসের দানায় ভর করা কদলী গণতন্ত্রে চটজলদি ন্যায়বিচার পরিবেশন আপাতত আপামর জনমানসে দাগ কেটেছে। এইসময় অন্যপক্ষের অস্তিত্বসংকট একশো তিরিশ কোটির দেশে বিলম্বিত বিচারের মতই বাস্তব। দুটি মহিলার পোড়া লাশ, চারটি পুরুষের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ, অথবা হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে থাকা নব্বই শতাংশ দগ্ধ আর এক মহিলার জীবনপণ লড়াইতে দাঁড়ি পড়ার গল্প জনগণের স্মৃতি থেকে খসে পড়বে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই। ডোপামিনের কাজ ফুরোবে, যতদিন না সরল দোলগতিতে ফিরে আসেন আর এক নির্ভয়া।

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

Anyo Paksha
Advertisment