Advertisment

এনকাউন্টারের সপক্ষে নেটিজেন: ক্ষমতার অঙ্গুলিহেলন

এভাবেই একদিন `ন্যায়বিচারের' হাত ধরে বন্ধ করে দেওয়া হবে রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবাদের সমস্ত শব্দ। পাশাপাশি রমরম করে চলতে থাকবে মস্তকধৌতির প্রোজেক্ট।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Hyderabad Encounter, Social Media

ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

তেলেঙ্গানায় এক তরুণীর ওপরে ঘটা নৃশংস, অমানবিক অপরাধের  নিন্দায় সারা দেশে ধিক্কার ঘৃণা ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে গত কদিন।  সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষে ক্ষিপ্ত হয়ে অপরাধীদের তাৎক্ষণিক শাস্তির দাবি তোলেন।  যেভাবে ধর্ষিতাকে হত্যা করা হয়েছে, সেভাবেই যেন নৃশংসতা  ফিরিয়ে দেওয়া হয় সন্দেহভাজন অপরাধীদের, সেই দাবি ক্রমশ জোরালো  হয়ে উঠেছে। নেটিজেনদের একাংশের বক্তব্য, এই ধরনের তাৎক্ষণিক এবং বিচার বহির্ভূত (এক্সট্রা জুডিশিয়াল) শাস্তি ভবিষ্যতের অপরাধীদের আতঙ্কে রাখবে এবং তারা পরবর্তী অপরাধ করার আগে দুবার ভাববে।  সংসদেও এই ধরণের শাস্তিবিধানের দাবি ওঠে। এক সাংসদ বলেন  অপরাধীদের জনসমক্ষে পিটিয়ে মেরে ফেলা প্রয়োজন।

Advertisment

এরকম ঘটনায় অপরাধীদের  কঠোর  শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন সে বিষয়েও বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কোনো কারণই নেই।  কিন্তু শাস্তি কী হবে, সেটা কি জনসাধারণই ঠিক করে দেবে? পাথর ছুড়ে  ধর্ষককে মেরে ফেললে ভবিষ্যতে ধর্ষণের সংখ্যা কমে যেত বলে যাঁরা দাবি রাখছেন, প্রতি বছরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে, যেখানে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা শাস্তিবিধানের অন্যতম প্রথা,  সংঘটিত  লিঙ্গ বৈষম্যমূলক অপরাধের সংখ্যা সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে কি তাঁদের? বিচার বহির্ভূত শাস্তির প্রক্রিয়া একবার যদি প্রাতিষ্ঠানিকরণ হয়ে যায়, তাহলে সেই পাথরের টুকরো কদিন বাদেই ছুটে আসতে পারে নিজেরই মাথা লক্ষ্য করে, ইনস্টিটিউশনের বিরোধিতা করার `অপরাধের'  শাস্তি হিসেবে।

আরও পড়ুন, এনকাউন্টার: কে ফ্যাসিবাদী, কে নয়?

ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় দু হাজার চার সালে।  অপরাধ ছিল হেতাল পারেখকে  ধর্ষণ করে হত্যা করা।  সরাসরি সাক্ষী না থাকায় বিচার হয় সারকামস্টেনশিয়াল এভিডেন্সের ওপরে ভিত্তি করে।  ভারত সরকারের  ন্যাশন্যাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর  তথ্য থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ধনঞ্জয় এর ফাঁসির পরে দেশে ধর্ষণের সংখ্যা কমেনি, বেড়েছে বরং।  পাথর ছুড়ে ধর্ষক হত্যা করে ভবিষ্যতের ধর্ষণের সংখ্যা কমিয়ে  আনার অনুমিতি তাই  ধোপে টেকে না।

৬ ই ডিসেম্বর  চার সন্দেহভাজন ধর্ষক-খুনি কে তেলেঙ্গানা পুলিশ এনকাউন্টারে হত্যা করে। তারা পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল সেই অভিযোগে।  `আহত' পুলিশদের শরীরে গুলি লাগেনি কোনো, সেক্ষেত্রে চারজনকেই গুলি চালিয়ে মেরে জেলার প্রয়োজন পড়লো কী ধরনের `আত্মরাক্ষার' জন্য? অপরাধী পালালে গুলি করার নিয়ম কোমরের নিচে, এখানে কেন সরাসরি কোমরের ওপরে গুলি করা হলো? অপরাধ পুনর্নির্মাণের সময়ে  ভিডিও রেকর্ড রাখা জরুরি, এক্ষেত্রে তা রাখা হয়েছিল কি? যদি না হয় তাহলে কেন হয়নি, এবং যদি হয় তাহলে সেখানে `অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার' সপক্ষে কী ধরনের প্রমাণ আছে?

এইসব  প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবেনা, কারণ দেশবাসী উল্লাসে উদ্বাহু হয়ে উঠেছেন পুলিশের এই `ন্যায়বিচারে'। সাধারণ মানুষ কে বাদ দিলেও, একাধিক সাংসদ প্রশংসায় পঞ্চমুখ পুলিশের এই ভূমিকায়।  সেই সাংসদদের মধ্যে একজন ২০১২ সালে এই রাজ্যের এক ধর্ষণ কাণ্ডের মূল অভিযুক্তকে আড়াল করেছিলেন - অপরাধীকে আড়াল করা প্রকারান্তরে অপরাধের মধ্যেই পড়ে।  গভীর আতঙ্কের বিষয় এই যে,  জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপারসনের মতো অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ও বলেন  এই ঘটনায় তিনি খুশি, যদিও নিয়মরক্ষার্থে এটাও যোগ করেন যে বিচারব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই `এটা' হলে ভালো হতো।

আরও পড়ুন, ধর্ষণ, মৃত্যুদণ্ড, খাপ পঞ্চায়েত কালচার

এই এনকাউন্টারের মূল হোতা  ভি সি সাজনারের এনকাউন্টারের  একাধিক রেকর্ড আছে।  ২০০৮ সালে  তিন যুবককে  (অভিযুক্ত হয়েছিলেন  দুই ছাত্রী কে লক্ষ্য করে অ্যাসিড ছোঁড়ার জন্য)  এনকাউন্টারে মেরে ফেলা হয় গুলি করে। ২০০৮ সালের  এই দ্রুত শাস্তিদানের চার বছর বাদে দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ড ঘটে।  আটকানো যায়নি কামদুনি, কাঠুয়া বা উন্নাও এর নৃশংস ঘটনাও।  এনকাউন্টার দিয়ে  অতএব ধর্ষণ আটকানো যায়না।

দিনের পর দিন  অক্ষম ও অনুপযুক্ত শাসক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের থেকে অবিচার পাওয়ার ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে হতে,  ক্ষমতার হাতে নিপীড়িত হওয়ার অসহায়তা ফুটে বেরোয় রক্তদর্শনের হিংস্রতার মধ্যে দিয়ে।  তাই ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা, ডাইনি সন্দেহে জ্বালিয়ে দেওয়া, সন্দেহভাজন ধর্ষকের লিঙ্গ ছিঁড়ে নিয়ে কুকুর  দিয়ে খাওয়ানোর নিদান।

হিংসার সাধারণীকরণের এই প্রবণতা  অতি সুচতুরভাবে রাষ্ট্র  জিইয়ে রাখে। উৎসাহ দেয় এনকাউন্টারকে।   রাষ্ট্র জানে হিংস্রতার আঁচ কখনো পড়বে না স্বামী চিন্ময়ানন্দ, বাবা রাম  রহিম বা আসারাম বাপুর ওপর, উন্নাওয়ের অভিযুক্তরা জামিনে ছাড়া পেয়ে ঠিক আগুন লাগিয়ে দেবে অভিযোগকারিণীর গায়ে, এবং ভারতবর্ষের সংসদে বসে থাকা ধর্ষনের দায়ে অভিযুক্ত অজস্র সাংসদের গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না।  এ এক এমন ই রাষ্ট্র যেখানে  `ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে' রেপ থ্রেট দেওয়ার পরেও সাংসদের কপালে জোটে শুধুই মৃদু স্নেহমিশ্রিত ভর্ৎসনা।  সুতরাং রাঘব বোয়ালরা ঠিকই ছাড় পেয়ে যাবে, এবং যাতে ছাড় পেয়ে যায়, তার জন্য কুরবানন দেওয়া দরকার কিছু চুনোপুঁটিকে, আলোচ্য অপরাধে  অভিযুক্ত সন্দেহভাজন চারটি মানুষ তাই  অবশ্যবধ্য।

আরও পড়ুন, হায়দরাবাদের এনকাউন্টার ও পরিতোষের বুলেট

ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী কারও বিচার করা বা শাস্তি দেওয়া  আইনরক্ষকের ক্ষমতার বাইরে।  ল এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখে, বিচার করে জুডিশিয়ারি।  পুলিশ কাস্টডিতে মৃত্যু তাই বিনা বিচারে  মৃত্যু।  ফলে এনকাউন্টারে মৃত্যু হলে `এতদিনে একটা সঠিক বিচার হয়েছে' বলে রব তোলা মূর্খামি।

ন্যায়বিচারের  মূল স্তম্ভ একটি  ল্যাটিন প্রবাদ - `অডি অলটেরাম পার্টেম' (লিসেন টু টি আদার সাইড, অর্থাৎ অভিযুক্তের বক্তব্য শুনতে হবে), তা না হাওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া যায় না।  অডি অলটেরাম পার্টেম এর মতোই বিচার ব্যবস্থার আরেকটি মূল স্তম্ভ প্রিসাম্পশন অফ ইনোসেন্স ।  অতি  প্রাচীন কাল থেকেই এই অনুমিতি মেনে চলা হয়।  দ্বিতীয় শতকে রোমান সম্রাট আন্তোনিয়াস পায়াস বিচারবিভাগীয় পরিমার্জনা করতে গিয়ে প্রথম এই অনুমিতির প্রচলন করেন, সেখানে বলা হয় `Ei incumbit probatio qui dicit, non qui negat' অর্থাৎ অভিযোগকারীর দায়িত্ব অপরাধের প্রমাণ দেওয়া, বিচারে দোষী প্রমাণিত না হাওয়া পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।  সমস্ত রকম বিচারব্যবস্থায় এই অনুমিতি অশেষ গুরুত্ব পেয়ে এসেছে,  মুসলিম হাদিসেও সমপ্রকার শব্দবন্ধের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।

এই এনকাউন্টারের ঘটনার সুদূরপ্রসারী অভিঘাত আছে।  এই ঘটনা চার অভিযুক্ত অপরাধীর হত্যা হিসেবে দেখলে চলবে না,  প্রকৃতপ্রস্তাবে তা স্টেট স্পন্সর্ড নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের দিকে প্রথম পদক্ষেপ।  এনকাউন্টারের ঠিক পরের দিন তেলেঙ্গানার এক বর্ষীয়ান মন্ত্রী সরাসরি এনকাউন্টারের সমর্থনে বিবৃতি দিয়ে জানান অপরাধ দমনের এটিই সঠিক পথ।  এই এনকাউন্টারের ঘটনায়  ব্যক্তিবিশেষ নয়,  রাষ্ট্র এবং শাসনব্যবস্থা হিংসাকে অনুমোদন করছে এবং নির্দিষ্ট পদ্ধতি এড়িয়ে যাচ্ছে নিজেদের স্বার্থে। এর ফলাফল অসম্ভব আতঙ্কজনক এবং বিপদজনক।

এভাবেই একদিন `ন্যায়বিচারের' হাত ধরে বন্ধ করে দেওয়া হবে রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবাদের সমস্ত শব্দ। পাশাপাশি রমরম করে চলতে থাকবে মস্তকধৌতির প্রোজেক্ট।  বিচারবহির্ভূত শাস্তির ব্যবস্থা করতে যাতে স্বতস্ফূর্ত ভাবেই এগিয়ে নাগরিকসমাজ  রক্তলোলুপ হয়ে ওঠেন, তার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে রাষ্ট্র থেকে। সাধারণ নাগরিক তাদের ক্ষোভ মেটাতে রক্তপিপাসু হয়ে উঠবে।  তাদের মনে পড়বে না যে নাগরিকদের সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই, এই  বিচারবোধ কাজ করবে না যে লিঙ্গবৈষম্য মূলক অপরাধ আটকানোর জন্য যে চেতনা ও শিক্ষার প্রসার প্রয়োজন, সাধারণ নিরক্ষর মানুষকে তার আওতায় আনতে  না পারা  রাষ্ট্রেরই অক্ষমতা।  রাষ্ট্র সচেতন নাগরিক চায় না - তাতে গদি  উল্টে যাওয়ার ভয় থাকে, তাই  যুক্তিবোধ  ঘুলিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রের প্রয়োজন। গণক্ষোভের তীব্র বাষ্প বের করে দিতে চায় বিচার বহির্ভূত বেআইনি প্রক্রিয়ার সেফটি ভালভ দিয়ে।  ফাঁকে ফোকরে, সুচারু ভাবে খেলে নিতে চায় ধর্মভিত্তিক বৈষম্যের তাস।  চার অভিযুক্তর তিনজন হিন্দু হাওয়া সত্বেও তাই প্রধানতঃ  চতুর্থ  মুসলিম  ব্যক্তিকেই  প্রক্ষেপ করা হয় অপরাধী হিসেবে।

আরও পড়ুন, উন্নাও বুঝিয়ে দিল, এনকাউন্টার সমাধান নয়

একদিন এনকাউন্টারের কোনো সমর্থকের ওপরেই নেমে আসবে রাষ্ট্রর খাঁড়া।  তারই প্রতিবেশী তার বিরুদ্ধে তুলে নেবে হাতে পাথর, কারণ সে বিশ্বাস করবে পাশের বাড়ির লোকটি কোনো কারণে সমাজের পক্ষে বিপদজনক,  বিচারের মাধ্যমে এগোলে দেরি হতে পারে, সমাজকে অপরাধীমুক্ত করতে গেলে অত দেরি করা যুক্তিযুক্ত নয়।

আমরা কি এভাবেই আজীবন  রাষ্ট্রের হাতের, ক্ষমতার হাতের পুতুল  হয়েই রয়ে  যাবো? এনকাউন্টারে `ন্যায়বিচারের সাফল্যে' যে শ্বাপদ-উল্লাস, তা যে আসলে গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টারই দূরাগত ধ্বনি, সেটুকু বোঝার সময় কি এখনো আসেনি?

(তাপস কুমার দাস ভারত সরকারের পরমাণু শক্তি বিভাগের গবেষণাকেন্দ্রের মহাকাশবিজ্ঞানী)

পড়তে ভুলবেন না এনকাউন্টারের এক অন্য কাহিনি, ছত্তিসগড়ে

Advertisment