Advertisment

ধর্ষণ, মৃত্যুদণ্ড, খাপ পঞ্চায়েত কালচার

এই এনকাউন্টার বিশেষজ্ঞরা, খবরের কাগজের প্রতিবেদনে যা দেখা যাচ্ছে, 'নকশাল' থেকে 'জিহাদি' হয়ে 'ধর্ষক' সব হত্যাতেই পারদর্শী।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Rape and Encounter, Khap

একেকটি হাই-প্রোফাইল ঘটনা এলেই চটজলদি সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া হয়েছে

হায়দরাবাদ এনকাউন্টারের দুদিন আগে সংসদে যখন সাংসদরা চিল্লিয়ে বলেন, যে, আইন-কানুনের আর কোনো দরকার নেই, অভিযুক্তদের জ্বালিয়ে বা পিটিয়ে মেরে ফেলা দরকার, তখন তাঁদের অসহায়তাটা বোঝা যায়। এত কাঠখড় পুড়িয়ে ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশে একটি কড়া আইন আনা হল, তারপরেও ধর্ষণ হয়েই চলেছে, এ কি অসৈরণ কাণ্ড? এরপর আর আইনকানুন রেখে লাভ কী?

Advertisment

এর মধ্যে শুরুতেই যে স্বীকারোক্তিটি নজরে আসে, তা হল, নতুন ধর্ষণ আইনটি প্রকৃত প্রস্তাবে প্রায় অশ্বডিম্ব। ওঁরা সে নিয়ে হতাশ। হতাশ হবারই কথা। কারণ ওখানে কাজের কাজ একটিই আছে, তা হল, ধর্ষণের সংজ্ঞাকে কেবলমাত্র যোনিতে লিঙ্গের প্রবেশে আটকে না রেখে পরিধিটি বড় করা হয়েছে। বাকিটুকু, এক কথায়, আগের মতই, (বা হয়তো বেশিই, মাপা মুশকিল) চূড়ান্ত পশ্চাৎপদ। প্রথমত প্রচণ্ড 'প্রগতিশীল' বলে দাবি করলেও ওই আইনটি লিঙ্গনিরপেক্ষ নয়। ওই আইনে ধর্ষিত বলে কিছু হয়না, কেবল ধর্ষিতা হয়। পুরুষের পশ্চাদ্দেশে বলপূর্বক কোনো বস্তু প্রবেশ করানো সমাজে যে প্রবল খিল্লিযোগ্য বিষয়, এই আইন তাকে স্বীকৃতি দেয়। কারণ মরদের দরদ হয়না।

আরও পড়ুন, হায়দরাবাদের এনকাউন্টার ও পরিতোষের বুলেট

দ্বিতীয় এবং এখানে জরুরি বিষয় যা, তা হল, ওখানে ধর্ষণের এক ও একমাত্র ওষুধ হল কড়া দাওয়াই। সেখানেই শুরু এবং সেখানেই কর্ম খতম। শাস্তি কড়া হলেই যে অপরাধ আটকায়না, আসল কথা হল অপরাধীরা ধরা পড়ছে কিনা, এই অত্যন্ত পুরোনো সাধারণজ্ঞানটিই ওই আইনে অনুপস্থিত। উন্নাওয়ে ধর্ষিতাকে প্রায় পরিবারশুদ্ধ ফৌত করে দেবার পরেও অভিযুক্ত প্রাক্তন বিধায়ক দিব্যি অস্পর্শিত। সে কি আইন কড়া নয় বলে, নাকি ধরা পড়ার কোনো আশঙ্কাই নেই বলে? ফলে এই আইনে কিছু আটকাবেনা, সে অজানা নয়। তাও আমাদের রাজনীতিবিদ এবং তথাকথিত সমাজকর্মীরা হতাশ কেন বোঝা মুশকিল। কারণ আইনের লক্ষ্যটি গোড়া থেকেই ছিল কেবলমাত্র একটি 'কড়া' এবং 'দৃষ্টান্তমূলক' শাস্তির পদ্ধতির দিকে। বহু বহুবার তা উচ্চারিতও হয়েছে, জয়া বচ্চন বা মিমি চক্রবর্তী তো আজই আকাশ থেকে পড়েননি।

বলাবাহুল্য এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ব্যাপারটি নিজেই একটি মান্ধাতার আমলের অকার্যকর জিনিস। সপ্তদশ শতকের লন্ডনে সবার সামনে পুড়িয়ে মারা হত অপরাধীকে। অপরাধী চেঁচাত, আর লোকে আনন্দ করে দেখত। পাঁচিলের গায়ে সারি-সারি কাটা মুন্ডু গেঁথে রাখা হত, যাতে লোকে ভয় পায়। এসব তামাদি হয়ে যাওয়া পদ্ধতি, যা এখন সৌদি আরব জাতীয় কয়েকটি দেশ ছাড়া কোথাও চালুও নেই। এতে করে অপরাধ কমে না, সবাই জানতেন। তবুও যে বারবার 'দৃষ্টান্তমূলক' শব্দটি উচ্চারণ করে যাওয়া হয়েছে এবং যাচ্ছে, তার বড় কারণ, মূলত পশ্চাদপদতা।

কারণ রাজনীতিবিদ হোন বা সমাজকর্মী, তাঁরাও তো এই একটি সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থারই ফসল। ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক এবং কড়া শাস্তি (পড়ুন মৃত্যুদণ্ড)-র দাবিটি মূলত আসে সেই ব্যবস্থা থেকেই। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং মৃত্যুদণ্ডের দাবি কোনওটি তোলার জন্যই তো ঠিক নারীবাদী বা লিবারাল হবার প্রয়োজন নেই। বরং ঠিক উল্টোটাই। ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের দীর্ঘদিনের দাবি হল দক্ষিণপন্থীদের (পড়ুন সংঘপ রিবারের), পুরোনো সামন্ততন্ত্রে যাদের শিকড়। তাদের যুক্তি খুব সহজ। খুনে কেবল জীবন যায়, কিন্তু ধর্ষণে একটি নারীর সম্ভ্রমের মৃত্যু হয়, তা হল মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। খুনের জবাব খুন হতে পারে, কিন্তু সম্মান বা ইজ্জৎ এর জবাব কেবল মৃত্যুদণ্ডই নয় বরং মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ কিছুর। অর্থাৎ দৃষ্টান্তমূলক কিছু চাই।

বস্তুত এই ধারণা ভারতীয় দক্ষিণপন্থীদের তৈরি তাও নয়। ধর্ষণকে চিরকালই ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে দেখা হয়েছে, যদিনা অবশ্য শত্রুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, এবং তার শাস্তি হিসেবে হাত-পা কেটে নেওয়া, লিঙ্গচ্ছেদন, মুণ্ডচ্ছেদ সবই চালু ছিল নানা সময়। অখণ্ড ধর্ষণ সংস্কৃতি নামক বস্তু কখনও ছিলনা, এখনও নেই। নিজের নারীকে রক্ষা করা এবং 'অপর'এর নারীকে 'সম্ভ্রম' নষ্টের জন্যই ধর্ষণ করা, এই ছিল পাশাপাশি। এখানে নারী ছিল রক্ষার সামগ্রী। সাবমিসিভ। তার বুক ফাটে তবু মুখ ফোটেনা। সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হবার কথা যদি সে একবার মুখ ফুটে বলতে পারে, তারপর আর কোনো প্রশ্নোত্তর, বিচার, কোনো কিছুই প্রয়োজন নেই। বাকি থাকে শুধু প্রতিশোধ। পৌরুষের রক্ত ফুটে ওঠে টগবগ করে।

আরও পড়ুন, ধর্ষণে মৃত্যুদণ্ড কিংবা গণপিটুনির দাবি: হাত ধুয়ে ফেলার রাজনৈতিক চেষ্টা

এই পুরো ধারণাটিই তুলে আনা হয়েছিল নতুন ধর্ষণ আইনে। দৃষ্টান্তমূলক, প্রতিশোধমূলক, এবং বিচারের প্রয়োজনহীন। আদতে নারীর তো শিভালরিসমৃদ্ধ রক্ষাকর্তার প্রয়োজন নেই। নারীকে এগিয়ে আনতে গেলে সর্বস্তরে তার ক্ষমতায়ন জরুরি। ধর্ষণ প্রতি নিয়ত সর্বত্র ঘটে চলছেনা ( অনেকেই জেনে আশ্চর্য হবেন, ভারতে খুনের সংখ্যা ধর্ষণের চেয়ে বেশি), ফলে বেশি জরুরি হল রাস্তায়-ঘাটে তাকে কীকরে ছোটোখাটো আক্রমণের শিকার না হতে হয় সেদিকে নজর দেওয়া। আর যে কটি ধর্ষণের (এবং অন্যান্য অপরাধেরও) ঘটনা ঘটছে তার প্রতিটির দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা। এই দিকে কেউ কখনও নজর দেননি। বরং তৈরি করা হয়েছে গণউন্মাদনা। 'মেয়েদের পক্ষে ভারত সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা' ইত্যাদি, যার কোনো ভিত্তি নেই। নজর কেবল দেখা গেছে 'দৃষ্টান্ত' তৈরির দিকে। একেকটি হাই-প্রোফাইল ঘটনা এলেই চটজলদি সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া হয়েছে। টিভি চ্যানেলে, সোশাল মিডিয়ায় বসে তৈরি হয়েছে গণহিস্টিরিয়া। যেন বিচারের প্রক্রিয়াটি ওখানেই সমাপ্ত। এবার সাজা দিয়ে দিলেই হয়।

এভাবেই তৈরি করা হয়েছে 'দৃষ্টান্ত'। দুনিয়াব্যাপী বিরাট খাপ পঞ্চায়েত। অনেকটাই ভার্চুয়াল ছিল এসব, কারণ প্রাথমিকভাবে ভাবা গিয়েছিল, ভারতবর্ষে বসে গণবিচারে মেরে ফেলা তো সম্ভব নয়। এ তার বিকল্প। অন্তত এই নিবন্ধের লেখক তেমনই ভেবেছিলেন এবং লিখেছিলেন। এখন অবশ্য দেখা যাচ্ছে, বাস্তবতা তাঁর দুঃস্বপ্নকেও ছাপিয়ে গেছে। বিনা বিচারে মেরে টেরে ফেলাও স্রেফ হরিয়ানার অনার কিলিং এর দপ্তর নয়, ভারতীয় রাষ্ট্রের পক্ষেও দিব্যি সম্ভব।

অবশ্য পিছিয়ে দেখলে মনে হয়, অনিবার্যই ছিল। কারণ, খাপ পঞ্চায়েত বা গণবিচার তো শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনের হাতেরই পুতুল। ভারতবর্ষে এর আগে 'এনকাউন্টার' হয়নি তা নয়। ভবিষ্যতেও হবে না তা নয়। কিন্তু আইনবহির্ভূত কাজের পিছনে এই বিপুল জনসমর্থন এর আগে দেখা যায়নি। এটি একটি তৈরি করা প্রক্রিয়া। দুঃখের ব্যাপার হল বহু মানুষ এই অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবার প্রক্রিয়ায় হাত লাগিয়েছেন, যাঁরা ঠিক দক্ষিণপন্থী নন। এই এনকাউন্টার বিশেষজ্ঞরা, খবরের কাগজের প্রতিবেদনে যা দেখা যাচ্ছে, 'নকশাল' থেকে 'জিহাদি' হয়ে 'ধর্ষক' সব হত্যাতেই পারদর্শী। কিন্তু ইতিপূর্বে বেশিরভাগ কাজকর্মই মূলত চুপিসাড়ে করতেন। এরপর, জগৎটাই হিন্দি সিনেমা হয়ে গেলে, প্রবল জনসমর্থন সহ সবই নতুন উদ্যমে বেশি বেশি এবং ঢাকপিটিয়ে করতে শুরু করে দিলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

আরও পড়ুন, পুলিশি এনকাউন্টার নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশগুলি কী কী

নারীর ক্ষমতায়ন একটি দীর্ঘস্থায়ী জটিল এবং বহুস্তরীয় প্রক্রিয়া। তার একটি অংশ আইনের বাইরের। আইনি কাজের মধ্যে আছে বিচার-ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, যা আবার শুধু মেয়েদের সমস্যায় আবদ্ধ নয়। আইনকে এত কড়া করো, যাতে দশজন নিরপরাধেরও শাস্তি হলে হোক, কিন্তু একজন অপরাধীও যেন পালাতে না পারে, বা আইনের দরকারই নেই, সিধে গুলি মেরে খালাস করে দাও, এই জাতীয় শর্টকাট নিয়ে, গণবিচারের উন্মাদনা তৈরি করে, সে বস্তু করা যায়না। স্রেফ গণবিচার দিয়ে কোনো দীর্ঘস্থায়ী বস্তুই তৈরি করা যায়না, এমনকি বিপ্লবও না। তাতে ফল তো পাওয়া যায়ইনা। কেবল ক্ষমতাসীনের হাতে তুলে দেওয়া হয় জনসমর্থনের বিপুল অস্ত্র। একদিকে জ্বলতে থাকে উন্নাওয়ের ধর্ষিতার লাশ, অন্যদিকে এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট ঠান্ডা মাথায় বেছে নেন নিজের লক্ষ্য। তাঁর পরের লক্ষ্য কে হবে, কেন হবে, কেউ জানেনা, যদিও জনসমর্থন এবার পাকা। অবিলম্বে এই বোধটুকু অন্তত সমাজকর্মীদের মধ্যে ফিরে না এলে, এই অনিবার্য পরিণতিকে রোখা মুশকিল।

(সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুচণ্ডালী ওয়েবজিনের সম্পাদক, মতামত ব্যক্তিগত)

Guruninda
Advertisment