হায়দরাবাদে গণধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার ঘটনায় দেশ জুড়ে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এ ঘটনা নির্ভয়াকাণ্ডকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। হায়দরাবাদ নিয়ে প্রতিবাদ চলতে চলতেই বক্সারের ঘটনা জনসমক্ষে চলে এল। দেশ জুড়ে নারী নির্যাতন, নারীদের উপর আক্রমণ, ধর্ষণ বেড়েই চলেছে।
সবাই প্রতিক্রিয়া জানাতে তাৎক্ষণিকভাবে যা বলছেন, তাও ভয়ংকর। সংসদে দাঁড়িয়ে সাংসদ জয়া বচ্চন তো বলেই বসলেন, দোষীদের জনসমক্ষে পিটিয়ে মারা উচিত। প্রতিরক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সওয়াল করলেন। এই ঘটনাসহ এই জাতীয় সমস্ত ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুক্ত ব্যক্তিদের নরপশু, তাদের কাজকে পাশবিক কাজ বলে চিহ্নিত করাটাই আমাদের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন: কীভাবে আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করে কিছু “সরকার-সমর্থিত কুশীলব”
আমরা যদি একটু স্থিতধী হয়ে ভাবি, তাহলে দেখব, পশুজগতে ধর্ষণ নেই। সেই জগতে নির্ধারিত মেটিংপর্বে শুধু সেক্স হয়। তাই পাশবিক, নরপশু ইত্যাদি বলাটা পশুজগৎকে অপমান করা। মানুষের জগৎ ভিন্ন। ৩৬৫ দিনই একজন পুরুষ যৌনকর্ম করতে সক্ষম, যখনই তার মনে হবে, তখনই সে তার ক্ষমতার, পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতায় নারীর উপর নানা জাতীয় আগ্রাসন চালানোর মানসিকতা বজায় রাখে।
সুজান ব্রাউনমিলার তাঁর ধ্রুপদী রচনা Against Our Will-এ লিখেছেন, ধর্ষণের মতাদর্শ পুরুষ তখনই আবিষ্কার করেছে যখন সে বুঝতে পেরেছে পুরুষের কাঠামোগতভাবে ধর্ষণের ক্ষমতা রয়েছে এবং মেয়েদের কাঠামোগতভাবে অসহায়তা রয়েছে সে ক্ষেত্রে। তাঁর ভাষায়, "The real life deployment of penis is a basic weapon of force against woman, principal agent of his will and her fear."
যাঁরা মানুষের যৌনতামূলক আচরণের উপর গবেষণা করেছেন, তাঁদের রচনায় ধর্ষণ নিয়ে বিশেষ আলোচনা নেই, তা সে Krafft-Ebing, ফ্রয়েড, অথবা সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম দুজন পথপ্রদর্শক মার্ক্স-এঙ্গেলস হোন কি বেবেল হোন। একজন জার্মান দার্শনিক উইলহেলম রেইখ এই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তাঁর নিজের বইয়ের একটি পরিচ্ছেদের Masculine Ideology of Rape শিরোনামের মাধ্যমে। কিন্তু তিনি সে বিষয়ে বিশদে কিছু আলোচনা করেননি।
পরবর্তীকালে পশ্চিমী দুনিয়ার নারীবাদীরা ধর্ষণের সঙ্গে ক্ষমতার যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, ধর্ষণেরও ইতিহাস রয়েছে। Joanna Bourke এর একটি অসাধারণ বইও রয়েছে, যার নাম, Rape: A History from 1860 to Present. তিনি দেখিয়েছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে ধর্ষণকে দেখা হত শুধুমাত্র যৌন হিংসা হিসেবে। কিন্তু ১৮৮৩ সালের পর থেকে যৌন হিংসাকে বিশেষভাবে ধর্ষণ বলে চিহ্নিত করা শুরু হয়। ধর্ষককে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়। সমাজ সেই কাজকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করতে শুরু করে ও পরে, অনেক অনেক পরে, নানা পরিস্থিতি ও আন্দোলনের চাপে স্বীকার করে যে ধর্ষণ হচ্ছে অপরাধ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কী ধরনের শারীরিক সাজা দিলে ধর্ষণ, নারীর উপর হিংসা বন্ধ হবে? উক্ত সাংসদের দাওয়াই? মানুষের হাতে খুন হওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া? একটা বর্বরতার উপর আরেকটা বর্বরতা?
আরও পড়ুন: জাতের নামে বজ্জাতি আর কতদিন?
এমনকী এই শাস্তিদানের প্রশ্নেও বা দাবি তোলার প্রশ্নেও আমরা কি সৎ? জম্মুর কাঠুয়াতে মন্দিরের মধ্যে নৃশংস অত্যাচারের পর যখন ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়, তখন কেন্দ্রীয় শাসকদল কী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল তা আমাদের জানা। ধর্ষকদের বন্দনা করবার মত পাষণ্ড কাজেরও সাক্ষী আমরা, কাঠুয়ার আইনজীবীদের উপর হামলার, হেনস্থা করার মত ঘটনারও সাক্ষী ইতিহাস। বিহারের সরকারি হোমে যখন নাবালিকাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়, তখন এসব আওয়াজ ওঠে না। ধর্ষক সাধুবাবাদের আড়াল করতে ব্যস্ত থাকে রাজনৈতিক দল ও প্রশাসন, আমরা সে ইতিহাসও জানি। আসারাম, নিত্যানন্দের মত গডম্যানরা উদাহরণ।
আমরা এও দেখেছি প্রতিবাদী মহিলা কণ্ঠস্বরকে হুমকি দেওয়া হয় এই বলে যে 'তোকে রেপ করে দেব'। তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ বলেন, ধর্ষণের কথা বলার পরেও বহাল তবিয়তে দলে থাকেন। ধর্ষক সাংসদদের, বিধায়কদের সহানুভূতি জানায় রাজনৈতিক দলগুলি।
রাষ্ট্র স্বয়ং যখন বিক্ষুব্ধ, বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীকে ঠান্ডা করার জন্য সেই জনগোষ্ঠীভুক্ত নারীদের উপর ধর্ষণকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে উদাহরণ ও সতর্কীকরণ হিসাবে - তখন ধর্ষকামীর শাস্তির কথা কখনওই ওঠে না, তদন্তের দাবি নস্যাৎ করে দেওয়া হয় দেশের সুরক্ষাবাহিনীর উপর ষড়যন্ত্র হিসাবে। তাই কাশ্মীরের উপর রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ২০১৮ সালের প্রতিবেদনের সত্যতাকেই স্বীকার করেনি ভারত সরকার। সাংবাদিক স্বাতী চতুর্বেদী তাঁর I Am Troll পুস্তিকায় দেখিয়েছেন, বিখ্যাত, নানা-অজানা ব্যক্তিদের টুইটারে ফেসবুকে কী কদর্য ভাষায়, কুৎসিতভাবে নারীদের আক্রমণ করা হয়। এবং তা পড়েন (ও উপভোগ করেন) দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব!
আরও পড়ুন: জ্যোতি বসু থেকে মমতা, রাজ্যপালদের লক্ষ্মণ রেখা
আর তাত্ত্বিকভাবেই কঠোরতম সাজা, মৃত্যুদণ্ড কিন্তু ধর্ষণসহ যে কোনও গুরুতর অপরাধ কমাতে সাহায্য করে না। বারবার তা নানাস্তরের সমীক্ষায় প্রমাণিত। তবু অন্ধ এক কুসংস্কারের মত তা কাজ করে চলে, অথবা শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে রাজনৈতিক সমাজ তার হাত মুছে ফেলে, মনে মনে ভাবে দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল।
পিটিয়ে মারার দাওয়াই ন্যক্কারজনক। যে দেশে সংবিধান রয়েছে, আইনের শাসন রয়েছে, বিচারব্যবস্থা রয়েছে, যে দেশে পিটিয়ে মারাকে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট জঘন্যতম অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছে, সে দেশেরই আইনপ্রণয়নকারী বলছেন, পিটিয়ে মারা উচিত জনসমক্ষে। আখলাক, পেহলু, তাবরেজদের পিটিয়ে মারার ঘটনা তো আমরা দেখেছি। সমাজকে আরও বর্বরোচিত, আরও নৃশংস হওয়ার স্তরও তো আমরা ২০১৪ সাল থেকেই দেখছি। তাকে আরও উন্নত করতে বলা তো সভ্য সমাজের কলঙ্ক।
প্রশ্ন উঠবে, আক্রান্তের বা তার পরিবারের ন্যয়বিচারের কী হবে! মৃত্যুদণ্ডই কি ন্যায়বিচারের মানদণ্ড? নির্ভয়াকাণ্ডের পর বিচারপতি ভার্মা কমিশন এ কথা বলেনি। কোনও নারী সংগঠন তাদের স্মারকলিপিতে এ দাবি তোলেনি। আমরা সবাই এ কথা বিশ্বাস করি যে Rape and sexual violence are deeply rooted in specific ethical, economic and cultural environment. তাকে আঘাত করতে না পারলে, তাকে নির্মূল না করতে পারলে, মেয়েরা বারবার এই ধরনের আক্রমণের মুখে পড়বেন।
আরও পড়ুন: জল জমা আর জল জমানো
মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তা রোধ করা যাবে না।
মৃত্যুদণ্ডের ভয় কোনও প্রভাবই ফেলে না সম্ভাব্য অপরাধীর উপর। এমনকী বর্তমান শাস্তিপ্রদানের, ন্যায়বিচারের কাঠামোয় অভিযুক্তকে অপরাধী প্রমাণের হালও করুণ। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, ২০১৭ সালে ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলায় সাজার ঘটনা মাত্র ৩২ শতাংশ। এমনকী ২০১৩ সালে যেখানে ধর্ষণ মামলায় চার্জশিট দেওয়ার হার ছিল ৯৫.৪ শতাংশ, সেখানে ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬.৬ শতাংশে। (সূত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯)
সুতরাং সমস্যার গভীরে না গিয়ে কিছু চটজলদি দাওয়াইয়ের কথা বলে হাততালি পাওয়া যেতে পারে, জনক্ষোভকে সাময়িকভাবে প্রশমিত করা যেতে পারে, তাতে নারীর উপর আক্রমণ কমবে না। পৃথিবীর দেশে দেশে দেখা গিয়েছে, নানাভাবে আইন সংশোধন করে, নারীবাদীদের আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও ধর্ষণ করে পার পেয়ে যাচ্ছে নানা স্তরের অপরাধীরা।
অব্যাহতির সংস্কৃতিকে নির্মূল করতে হবে। ধর্ষণকে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রের ব্যবহার চিরতরে বন্ধ করতে হবে। বাছাই করা প্রতিবাদ, এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে ধর্ষণের উসকানি তথা ধর্ষণের সংস্কৃতিকে পরাস্ত করার মধ্যে দিয়েই আমরা প্রকৃত সফল হব এ কথা বলতে, "Womens Rights are (also) human rights.
আরও পড়ুন: চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও বিশ্বাস
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭০ এর শেষ দিকে ভারত সরকার ১৯৬৬ সালে রচিত রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক মানবধিকার সনদে স্বাক্ষর করে এবং তার ফলে বিশ্বের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, সে তার নিজ দেশে, সনদের অনুচ্ছেদ ৬ অনুসারে, ধীরে ধীরে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেবে। কার্যক্ষেত্রে ভারত সরকার নানা অজুহাতে নানা আইনে মৃত্যুদণ্ড যুক্ত করছে।
(সুজাত ভদ্র মানবাধিকার কর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)