Advertisment

ব্রহ্মাণ্ড থেকে সমাজ, বিজ্ঞান যেখানে যেমন; আলোচনায় ডঃ সব্যসাচী সিদ্ধান্ত

"প্রভাব মুক্ত হয়ে একটি শিশুর মৌলিক চিন্তা করার ক্ষমতা তৈরি হওয়া দরকার। তবেই আজ থেকে দশ-কুড়ি-ত্রিশ বছর বাদে সমাজ তার ফল পাবে।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

সার্নের এলএইচসি গবেষণাগার

গান-গল্প-আড্ডা শব্দগুলো কেমন এক নিঃশ্বাসে বলা হয়ে যায়, না? অথচ 'বিজ্ঞান'-এর সাথে হাইফেন দিয়ে যদি জুড়ে দেওয়া যায় এদেরই দু একটা! কেমন যেন ছন্দপতন হয়ে যায়। আসলে তা হয় না। মায়া আর্ট স্পেসে ডঃ সব্যসাচী সিদ্ধান্তের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিলে আপনারও এমনটা মনে হতে বাধ্য। বাঙালির আড্ডায় যদি সিনেমা-রাজনীতি-নাটক থেকে সাহিত্য-ফুটবল-ক্রিকেট থাকতে পারে, বিজ্ঞান তবে ব্রাত্য কেন? এই প্রশ্ন নিয়েই গিয়েছিলাম সেদিনের সান্ধ্য বৈঠকে।

Advertisment

যাকে নিয়ে গল্প এগোবে, চটপট তাঁর পরিচয়টা সেরে নেওয়া যাক। ডঃ সব্যসাচী সিদ্ধান্ত। ইতালির ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়র সায়েন্সের গবেষক। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে যুক্ত রয়েছেন সুইৎজারল্যান্ডের সার্নের সঙ্গে।

এই সার্ন শুনলেই যদি ভাবেন এবারের আলোচনা হয়ে উঠবে রসকষহীন গম্ভীর আলোচনা, নিছকই ভুল ভাবছেন। বিজ্ঞানের সাথে আমাদের যাদের সরাসরি অ্যাকাডেমিক যোগাযোগ নেই, যারা শুধু বছর কয়েক আগে খবরের শিরোনামে দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়েছিলাম নামটার সাথে, আজ শুধু মনে আছে, শব্দটার সাথে কীরকম যেন কাঠ কাঠ এক বিজ্ঞানের গন্ধ লেগে আছে। বাকিটা অজানা, খায় না মাথায় দেয় গুলিয়ে ফেলেছি বেমক্কা।

সার্ন হল জেনিভার কাছে অবস্থিত একদিকে আল্পস আর অন্যদিকে জুরা পাহাড়ে ঘেরা এক বিশাল গবেষণাগার। কণা বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার পীঠস্থান এই সার্ন। এর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি দেশ। ভু-পৃষ্ঠের ১০০ মিটার নীচে ২৭ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে সার্নের বিশাল কর্মকাণ্ড। সার্নের একাধিক গবেষণার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়টির নাম লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (এলএইচসি)। তা, হঠাৎ এত বিশাল, এত রাজকীয় আয়োজন কীসের জন্য? এই যন্ত্রের সাহায্যে নাকি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পরের মুহূর্তটা কেমন ছিল তা জানা সম্ভব। এমনটাই বলছেন সার্নের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা।

কী হয় এলএইচসি তে? বিশালাকার পাইপের মতো এই যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে একই সাথে দুটি বিপরীতমুখী উচ্চ শক্তিসম্পন্ন প্রোটন ( অথবা লেড আয়ন) স্রোত পাঠানো হয় খুব উচ্চ গতিতে। কতটা উচ্চ? তা প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি। এবার  বিপরীতমুখী স্রোত দুটির মধ্যে কোলাইড করানো হয়। এই ভাবে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টির আদি লগ্নকে ধরার চেষ্টা করা হয়। হ্যাঁ, কৃত্রিম উপায়ে সেই আদি মুহূর্ত তৈরি করা গেলেও তা কিন্তু অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী হয়। এক সেকেন্ডের কয়েক লক্ষ ভাগের এক ভাগ।

publive-image মায়া আর্ট স্পেস আয়োজিত বিজ্ঞান নিয়ে ঘরোয়া আড্ডায় বিজ্ঞানী সব্যসাচী সিদ্ধান্ত

এলএইচসির এই গবেষণা কোন কোন প্রশ্নের উত্তর দেয় জানেন? পদার্থের ভর কোথা থেকে আসে? হিগস বোসন কণার নাম মনে আছে তো? ২০১৩ সালে বিজ্ঞানী পিটার হিগস এবং এংলার্ট এই কণার আবিষ্কার করে নোবেল পেয়েছিলেন। তাঁর বহু আগে থেকে এই কণার সন্ধান চলছিল। এই কণার নাম দিতে গিয়ে রীতিমতো নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। গত শতকের নয়ের দশকে বিজ্ঞানী লেডারম্যান এ কণার বিষয় নিয়ে লেখা তাঁর প্রকাশ হতে চলা বইটির নাম দিতে গিয়ে বেশ  মুশকিলে পড়লেন। কী নাম দেবেন, ভাবতে ভাবতে একসময় তিতিবিরক্ত হয়েই বোধহয় বলে ফেললেন, "গড ড্যাম পার্টিকেল"! বলাই বাহুল্য, ঝানু প্রকাশক লুফে নিলেন তা। কালেক্রমে আরও ছোট হয়ে গড ড্যাম পার্টিকেল হল গড পার্টিকেল বা ঈশ্বর কণা। ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই প্রশ্ন করে যে বিজ্ঞান, তারই এক সাড়া জাগানো আবিষ্কারের নাম হয়ে গেল ঈশ্বর কণা!

বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বলে, ব্রহ্মান্ডে ম্যাটার থাকলে অ্যান্টি ম্যাটার থাকতেই হবে। অথচ আমাদের আশেপাশে সব ম্যাটার। কিন্তু শক্তির নিত্যতা সূত্র আবার বলে শক্তি ভরে রূপান্তরিত হয়। এর জন্য অ্যান্টি ম্যাটারের একান্ত প্রয়োজন। বিজ্ঞানীদের মনে এমন এক সম্ভাবনার কথা উঠে আসে। হয়তো অ্যান্টি ম্যাটারের তুলনায় খানিক বেশি ছিল ম্যাটার, যা থেকে জন্ম নিল ব্রহ্মাণ্ড। এই ম্যাটার-অ্যান্টি ম্যাটারের সামঞ্জস্যহীনতা ব্যাখ্যা করার দায় পড়ল সেই এলএইচসি-র ওপরেই।

স্বাভাবিকভাবেই এতক্ষণে আপনার নিশ্চয়ই মনে হতে শুরু করেছে, এই এত বড় কর্মকাণ্ডের সাথে মানবজাতির সম্পর্ক কোথায়? মানুষের কী কাজে আসতে পারে এই গবেষণা? প্রশ্নের উত্তরে ডাঃ সিদ্ধান্ত বললেন, "বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চাই এই গবেষণার মূল লক্ষ্য। কিন্তু এ ধরণের বিশাল গবেষণার ধাপে ধাপে গবেষণার খাতিরেই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। সেই প্রযুক্তিগত উন্নতি আজ না হলেও আজ থেকে দশ বছর পরে সাধারণ মানুষের কাজে লাগবে। সার্নের টেকনোলজি ট্রান্সফার ডিপার্টমেন্ট উন্নত প্রযুক্তিগুলোকে অন্য কোন কোন ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়, তাই নিয়েই কাজ করে। সার্নের অ্যাক্সিলারেটর প্রযুক্তি ক্যানসারের চিকিৎসার কাজে ইতিমধ্যে কাজে লাগতে শুরু করেছে।"

প্রশ্ন ছিল, বিজ্ঞান সাধনায় ভারত কোথায় দাঁড়িয়ে? ডাঃ সিদ্ধান্ত জানালেন, শুধু দেশ নয়, কলকাতার একাধিক প্রতিষ্ঠান (সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়র ফিজিক্স অন্যতম) সার্নের বেশ কিছু পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গে প্রত্যক্ষ  ভাবে যুক্ত। ভারত বর্তমানে সার্নের অ্যাসোসিয়েট সদস্য। তবে চটজলদি ফল পাওয়া যায় বলে শুধুই অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স-এর চর্চা করতে হবে, এই ধ্যান ধারণা থেকে দেশকে বেরোতে হবে বলে মনে করেন বক্তা। "বেসিক সায়েন্সের চর্চা না হলে একটা সময়ের পর প্রযুক্তির উন্নতি থেমে যাবে।"

বিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে, প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতার বিকাশ হচ্ছে কতটা?

"বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। আর সেটা বাড়ানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় স্কুল জীবন। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে যুক্তি দিয়ে কোনও ঘটনাকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাটা বাচ্চাদের মধ্যে তৈরি করে দিতে হবে। এটা কিন্তু শুধু বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। দর্শন-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। প্রভাব মুক্ত হয়ে একটি শিশুর মৌলিক চিন্তা করার ক্ষমতা তৈরি হওয়া দরকার। তবেই আজ থেকে দশ-কুড়ি-ত্রিশ বছর বাদে সমাজ তার ফল পাবে। কোনও ইতিবাচক পরিবর্তনই রাতারাতি আসে না।"

science
Advertisment