যাঁরা নিয়মিত এই কলাম পড়েন, তাঁদের মনে থাকবে, ভারতীয় দল নিউজিল্যান্ড সফরে যাওয়ার আগেই আমি লিখেছিলাম, ভারতের কিউয়ি শিকার বড় সহজ হবে না। নিজেদের মাটিতে যথেষ্ট শক্তিশালী দল নিউজিল্যান্ড, এবং একদিনের আন্তর্জাতিক সিরিজের প্রথম ম্যাচেই তারা আবারও একবার তা বুঝিয়ে দিল। শেষ মুহূর্তে অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন দল থেকে ছিটকে যাওয়া সত্ত্বেও।
যাঁরা সদ্যসমাপ্ত টি-২০ সিরিজে ভারতের ৫-০ জয়ের উদাহরণ দেবেন, তাঁদের বলব, এই ব্যবধান অতি সহজেই ৩-২ হতে পারত, এবং ভারতের পক্ষে নয়। সিরিজে ভারত ২-০ এগিয়ে যাওয়ার পরেও কিউয়িরা সিরিজে ফেরার সুযোগ পেয়েছিল। তৃতীয় ম্যাচে চার বলে দু'রান করতে, এবং চতুর্থ ম্যাচে ছয় বলে সাত রান করতে না পেরে নজিরবিহীন 'ব্যাক টু ব্যাক' সুপার ওভারে সিরিজ হারে তারা। ভারতের এই পিছিয়ে থেকেও ফিরে আসা, এবং নিশ্চিত হারের মুখ থেকে জয় ছিনিয়ে নেওয়াকে অসংখ্য বাহবা দিয়েও বলতে হবে, কিউয়িরা সুপার ওভারে 'চোক' করে, হাতে উইকেট থাকা সত্ত্বেও ম্যাচ হারে। যদি তৃতীয় ও চতুর্থ ম্যাচে তারা জিতত, তবে পঞ্চম ম্যাচটা অন্যরকম হতো, বলা বাহুল্য।
চিন্তার কিছু আছে কি?
সাতটি সীমিত-ওভারের ম্যাচ জেতার পর এটি ছিল ভারতের প্রথম হার। হ্যামিলটন পার্কের পাটা উইকেটে এই হারকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার হয়তো প্রয়োজন নেই এই মুহূর্তে, তবে কয়েকটা ব্যাপার নিশ্চিত ভাবাবে ভারতকে।
এক, কুলদীপ যাদবের পড়ন্ত ফর্ম। গত প্রায় এক বছর ধরে একদিনের ম্যাচে তাঁর বোলিং অ্যাভারেজ দাঁড়িয়েছে ৩৭, যেখানে তাঁর কেরিয়ার অ্যাভারেজ ২৬-এর কিছু বেশি। বুধবারের ম্যাচে ১০ ওভারে ৮৪ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়েছেন তিনি, সুতরাং তাঁর গড়ের যে খুব উন্নতি হয় নি, তা বলাই যায়। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁকে অনায়াসে পড়তে পারছিল কিউয়িরা। মোদ্দা কথা, হ্যামিলটন পার্কে মাঝের ওভারে কুলদীপ এবং শার্দূল ঠাকুরের চেয়ে ভালো বোলিং করেন কিউয়ি বোলাররা। সেখানেই তফাৎ হয়ে যায় দুই দলের।
দুই, লেগস্পিনের বিরুদ্ধে বিরাট কোহলির দুর্বলতা। আপাতত বিরাটের বর্মে এই ছিদ্রের কথা মোটামুটি 'ওপেন সিক্রেট' হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে ডানহাতি 'রিস্ট স্পিনার' হলে আরও প্রকট হয়ে উঠেছে এই দুর্বলতা। গত চারটি একদিনের ম্যাচের তিনটিতে লেগ স্পিনারদের বিরুদ্ধে আউট হয়েছেন বিরাট। হ্যামিলটনেও তিনি ৫১ রান করে আউট হয়ে যান ইশ সোধির গুগলি পড়তে না পেরে। বস্তুত, সোধির বিরুদ্ধে কোহলির গড় রান মাত্র ৯.৫০, এবং 'ডট বল'-এর হার ২১.৪৩ শতাংশ। এই সিরিজের বাকি ম্যাচে যে একথা ভালমতোই মনে রাখবে নিউজিল্যান্ড, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কোহলি যে স্তরের খেলোয়াড়, তাতে এই দুর্বলতা দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ারই সম্ভাবনা। তবে কাটিয়ে উঠতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।
কেন ভারতের জেতা জরুরি
১০ জুলাই, ২০১৯। তারিখটা রক্তের অক্ষরে লেখা আছে বিরাট কোহলি, এবং ভারত ও ভারতীয় সমর্থকদের স্মৃতির মণিকোঠায়। ২০১৯ বিশ্বকাপে সারা টুর্নামেন্টে অপরাজিত থেকে সেমিফাইনালে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা নিউজিল্যান্ডকে ২৪৯/৮ রানে সীমিত রাখল ভারত। বৃষ্টি বাধ সাধল, এবং খেলা হলো পরের দিন, মেঘলা, স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় ম্যানচেস্টারে। দারুণ তাড়া করেও শেষরক্ষা হলো না, ম্যাচের 'কন্ডিশন' বদলে যাওয়াতে। নিউজিল্যান্ডের পেস বোলাররা, মূলত ম্যাট হেনরি, ট্রেন্ট বোল্ট, ও মিচেল স্যান্টনারের দৌলতে ভারতকে হার স্বীকার করতে হলো কিউয়িদের কাছে। সাত বছরের আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) ট্রফির খরা চলতেই থাকল।
সুতরাং ২০২০-র নিউজিল্যান্ড সফর ভারতের কাছে 'প্রতিশোধের ট্যুর' ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিউয়িদের বিরুদ্ধে তাদের নিজেদের মাঠে ভারতের রেকর্ড অদ্যাবধি খুব একটা ভালো ছিল না। সবদিক দিয়েই ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম ফরম্যাটে পিছিয়ে ছিল ভারত। কিন্তু টি-২০ সিরিজে অনবদ্য ক্রিকেট খেলে তারা কিউয়িদের হারাল ৫-০ ব্যবধানে, এবং সেই ১০ জুলাইয়ের কিছুটা হলেও মধুর প্রতিশোধ নিল।
পথ সহজ নয়
তবে খেলা তো শেষ হয় নি। চোট আঘাত জনিত সমস্যায় এখনও ভুগছেন ট্রেন্ট বোল্ট, লকি ফারগুসন,বা ম্যাট হেনরি, তবে এঁদের বাদ দিলেও রয়েছেন টম ল্যাথাম, রস টেলর, টিম সাউদি, বা টম ব্লান্ডেলের মতো খেলোয়াড়রা। মনে রাখবেন, ২০১৯ সালের প্রথমদিকে ভারতকে ৩-২ ব্যবধানে হারায় এই নিউজিল্যান্ড দল।
অন্যদিকে, ভারতীয় দলে নেই রোহিত শর্মা। অসাধারণ ফর্মে ছিলেন রোহিত, সুতরাং তাঁর অনুপস্থিতি চিন্তার উদ্রেক করবেই। যদিও পৃথ্বী শ, শুভমান গিল ও ময়াঙ্ক আগরওয়ালের মতো ক্রিকেটাররা ভারতীয় 'এ' দলের সঙ্গে নিউজিল্যান্ড সফর করাতে ম্যাচ প্র্যাকটিসের মধ্যেই আছেন। আর চোট-আঘাত তো আজকাল হয়ে দাঁড়িয়েছে একজন পেশাদার খেলোয়াড়ের নিত্যসঙ্গী। তবে ভারতের প্রথম চার ব্যাটসম্যান - কে এল রাহুল, অধিনায়ক বিরাট কোহলি, শ্রেয়স আয়ার ও মনীশ পাণ্ডে দারুণ ফর্মে আছেন। ঋষভ পন্থকে শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে জাদেজার আগে খেলালে কেমন হয়? ১০ বলে ৩০ রান করার ক্ষমতা রাখেন পন্থ, এবং তারই সঙ্গে বাড়বে ব্যাটিং 'ফায়ার পাওয়ার'।
জসপ্রীত বুমরা ফিরে এসেছেন তাঁর নিজস্ব ছন্দে। তাঁর জুড়িদার মহম্মদ শামিও আছেন দুরন্ত ফর্মে। নভদীপ সাইনি বল করছেন ১৪৫ কিমি গতিতে। শার্দূল ঠাকুর নিউজিল্যান্ডের হাওয়ার সুযোগ নিয়ে সুইং করাতে পারেন সাদা বলকে, ব্যাটিংয়ের হাতও তাঁর মন্দ নয়। প্রথম ম্যাচের পর যা মনে হচ্ছে, সমানে সমানে একটা টক্কর আশা করব একদিনের সিরিজে। কিউয়িরা চেষ্টা করবে ৫-০ সিরিজ হারের পর ঘুরে দাঁড়াতে, ভারত চাইবে গড়তে ইতিহাস।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ
ক'জন দেখছেন জানি না, তবে দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে গেছে গতবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতীয় দল। ফাইনালে নিউজিল্যান্ড অথবা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলবে তারা। এই লেখা জমা দেওয়ার সময় চলছিল নিউজিল্যান্ড-বাংলাদেশ সেমিফাইনাল। লীগ পর্যায়ে ভারতের বিরুদ্ধে হারে নিউজিল্যান্ড, তবে কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে সাড়া ফেলে দেয় তারা। অন্যদিকে, ১০৪ রানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে দুরমুশ করে সেমিফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। আগামী ৯ ফেব্রুয়ারির ফাইনালে যেই উঠুক, ভারতের পরীক্ষা সম্ভবত কঠিন হতে চলেছে।
শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়ের নিয়মিত কলাম পড়ুন এখানে
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন https://t.me/iebangla