Advertisment

ইতিহাসের রেলপথে ভারত-বাংলাদেশের বর্তমান যাত্রা

কোন সন্দেহ নেই পাকিস্তান ও চিন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্রুত সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে। কিন্তু বিদেশ সচিবের ঢাকা সফরের পিছনেও আছে এক নেপথ্য কাহিনী।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী।

প্রধান ফটক খুলে দিল নিরাপত্তাকর্মীরা। গাড়ি থেকে নামলেন ভারতের বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শুরু হল বৈঠক। ১ ঘন্টা ১৫ মিনিটের নিবিড় বৈঠক। শ্রিংলার সঙ্গে ছিলেন বর্তমান হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস। বৈঠকের শুরুতে হাসিনা জানতে চাইলেন, কেমন আছেন নরেন্দ্র মোদিজি। এই করোনা পরিস্থিতিতে আশা করি তিনি সুস্থ আছেন? একেবারেই ব্যক্তিগত প্রশ্ন। কিন্তু এই অরাজনৈতিক উৎকণ্ঠা প্রকাশ প্রথমেই বৈঠকের আন্তরিকতার সুরটা বেঁধে দিল। এরপর হাসিনা জানতে চান প্রণববাবুর কথা। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। এখনও তিনি সেনা হাসপাতলে কোমাচ্ছন্ন। শেখ হাসিনা জানতে চান কেমন আছেন তিনি? বাংলাদেশের রাজনেতারা শুধু নন, সাধারণ মানুষের কাছেও প্রণববাবু খুবই জনপ্রিয় এবং প্রণাম্য ব্যক্তিত্ব। শ্রিংলা জানালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী খুবই সুস্থ আছেন। ফিট এন্ড ফাইন। প্রণববাবু সম্পর্কেও তিনি জানালেন যে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি চিকিৎসাধীন। আমরা সকলেই আশাবাদী। ওঁর সুস্থতা কামনা করছি।

Advertisment

তাই বলা যায়, খুবই ঘরোয়া পরিবেশে আলোচনা এগোতে থাকে। সন্ত্রাসবাদ, রোহিঙ্গা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের উন্নয়ন, নানা ধরনের বিষয়। তবে দু'দেশের মধ্যে আবার রেল চলাচল শুরু করা কে ভারত এবার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশে ফেরার পর শ্রিংলা প্রধানমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে যে রিপোর্ট করেছেন তাতেও দু'দেশের মধ্যে বৈধ পরিবহন (legal connectivity) কে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কারণ প্রধানমন্ত্রী নিজেও মনে করছেন এই পরিকাঠামোগত উন্নয়ন দেশের বাণিজ্যিক ভবিষ্যতের জন্য জরুরী।

১৯৬৫ সালের আগে পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বেশকিছু রেল যোগাযোগ ছিল কিন্তু ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের পর এই রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ভারত এবার সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ছটি রেল চালু করতে হবে, তারমধ্যে আপাতত চারটি দ্রুত কার্যকর করতে হবে। ২০২০ সালের মধ্যেই এ প্রকল্প চালু করার কথা ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই কোরনা মহামারীর কারণে এই ট্রেন চলাচল শুরু করা সম্ভব হয়নি। এই বৈঠকে ঠিক হয়েছে খুব শীঘ্রই দু'দেশের পরিবহন ও রেল মন্ত্রকের মধ্যে বৈঠক হবে ও শুরু হবে এই রেল যোগাযোগ। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল শুধু ভারত আর বাংলাদেশের নয়, দুই দেশের মধ্যেও দশম রেললাইনটি ভারতই নির্মাণ করে দেবে।

আসলে ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসেবে এই দুই অর্থনৈতিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেশ পুরনো। তাই ৭১ সালে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের অনেক দিন আগে থাকতেই এই ভূখন্ডের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। মূলত সেটি ছিল বাণিজ্যিক সম্পর্ক। আসলে রাজনৈতিক সম্পর্ক অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলে। এজন্য বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান এবং জিয়া আমলের তুলনামূলক আলোচনা করলেই তা বোঝা যায়।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই সময়৬০ -এর দশক পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যের একটা বড় অংশ ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত হত। ১৯৫৫-৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যের একটা বড় অংশ ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত। হয় .৫৫-৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মোট বাণিজ্যের ভারতীয় অংশ ছিল শতকরা ২৩ ভাগ। পরবর্তীতে এই ধারা হ্রাস পেতে থাকে। দেখুন, ৬৫-৬৬ সালে বাণিজ্যে ভারতীয় অংশীদারিত্ব ছিল ২.৭৪ ভাগ। ৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে পাকিস্তানে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে যায়। এতে কিন্তু আর্থিক লোকসান বেশি হয় পূর্ব পাকিস্তানের। কারণ ভারত–পাকিস্তানের মোট বাণিজ্যের গড়ে প্রতিবছর শতকরা ৭৪.৫৭ ভাগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে। ভারতে পাকিস্তানের মোট রপ্তানির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল শতকরা ৮৪.৮৩ ভাগ।

আজ এত বছর পর ৬৫ সালের আগের রেল যোগাযোগ আবার সত্যি সত্যি চালু হতে চলেছে, এ তো কম কথা নয়। ঢাকা–কুরিগ্রাম ইন্টারসিটি ট্রেনের উদ্বোধন করতে গিয়েও শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন ৬৫ সালের যুদ্ধে যা বন্ধ হয়ে গেছিল, আবার তা চালু হচ্ছে। এতে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক নতুন উদ্দীপনা লাভ করছে। ২০০৮ সালে ভারত–ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু হয়। ২০১৭ সালে বন্ধন এক্সপ্রেস কলকাতা থেকে খুলনায় চালু হয়। বাংলাদেশের রেল মন্ত্রী এবং ভারতের হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস চিলহাটি থেকে সীমান্ত পর্যন্ত হারিয়ে যাওয়া রেলপথ পুনরুদ্ধারের কর্মসূচির শুভ সুচনা করেন।

১৯৬৫ সালের আগে বাংলাদেশ থেকে শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিঙে ট্রেন যেত। হলদিবাড়ি স্টেশন পর্যন্ত এই রেলপথকে ভারত সরকার “রেস্টোর” করছে। অতএব চারটি রেল চালু হওয়ার পর অন্য দুটি করিমগঞ্জ–মহিশাসন থেকে বাংলাদেশের শাহবাজপুর এবং হলদিবাড়ি–চিলহাটিও চালু হবে। সমুদ্রপথে মোংলা বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে যোগাযোগ স্থাপন হবে। এলপিজি গ্যাস অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আসবে। তাতে বাংলাদেশ প্রভূত রাজস্ব সংগ্রহ করবে। কারণ এজন্য ট্রানজিট চার্জ পাবে বাংলাদেশ।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এখন এই কোরনা আক্রান্ত সময় কেন বিদেশ সচিব হঠাৎ ঢাকা গেলেন? বাংলাদেশ ও ঢাকার সংবাদমাধ্যমের একাংশ প্রচার করছে চিনের আগ্রাসী মনোভাবের জন্যই বিদেশ সচিবের এই তড়িঘড়ি সফর। কোন সন্দেহ নেই পাকিস্তান ও চিন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্রুত সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে। কিন্তু বিদেশ সচিবের ঢাকা সফরের পিছনেও আছে এক নেপথ্য কাহিনী। গত ছ'মাস কোরনার কারনে বিদেশ মন্ত্রী ও বিদেশ সচিব পৃথিবীর কোন প্রান্তে যেতে পারছেন না। শুধুই ভিডিও কনফারেন্স হচ্ছে। শুধু ভারত নয়, গোটা পৃথিবীরই এমন হাল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে বিদেশি অভ্যাগতদের আসাও তো বহুদিন বন্ধ ছিল। এমতাবস্থায় ভারত সরকারের প্রত্যাশা ২০২০-র ডিসেম্বরের মধ্যেই কোরনা মহামারী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন এবার ধীরে ধীরে আবার বিদেশ সফর শুরু করুন। শ্রিংলা প্রতিবেশী রাষ্ট্রই প্রথম, এই নীতি মেনে বাংলাদেশ থেকেই তার সফর শুরু করলেন।

বাংলাদেশের পর হয়তো তিনি যাবেন মায়ানমার। সেটিও তাৎপর্যপূর্ণ সফর হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু হাসিনা উত্থাপন করেন এবং ভারতের হস্তক্ষেপ চান। ভারত এব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। নিরাপদ কোন যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে তাদের কিভাবে ফেরত পাঠানো যায় সেটাই ভারতের লক্ষ্য। এব্যাপারে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকেও কাজে লাগাতে চাইছে ভারত। সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বৈঠকও আসন্ন, আর এবার নিরাপত্তা পরিষদে ভারত আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে বিশেষ মর্যাদা পেতে পারে।

বিগত জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মোদির যাবার কথা ছিল। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। এখন নতুন পরিকল্পনা, আগামী বছর বাংলাদেশ গঠনের ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষে মোদি ঢাকা যাবেন ২০২১ সালে। তারপর হাসিনাও আসবেন দিল্লি। হাসিনা–বিদেশ সচিব বৈঠকে এব্যাপারেও চূড়ান্ত কথা হয়ে গেছে। তবে চিনের ঢাকাকে সাহায্য প্রদান নিয়ে দিল্লির মোদী সরকার ও হাসিনা সরকার উভয়পক্ষই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। কারণ চিন যে ঋণ দেয় তা শুনতে অনেক, কিন্তু এই ঋণ শোধ করার প্রক্রিয়া খুবই জটিল। আর চিন বরাবরই যতটা ঘোষণা করে, ততটা অর্থ কখনোই দেয় না। ফলে ঢক্কা নিনাদ হয় বেশি। বাংলাদেশকে যেমন ২৯ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিলেও আসলে এখনও পর্যন্ত দিয়েছে শুধুমাত্র ১ বিলিয়ন ডলার। সেখানে ভারত বলেছে দেবে ৭.৮ বিলিয়ান, আর ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে ৮০০ মিলিয়ন। ৭৪-৭৫ সালে জিয়া আমলে চিন বলেছিল ৭৭,৬৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য দেবে। তখনও বাংলাদেশ আদতে পেয়েছিল নয় ভাগের এক ভাগ মাত্র। কিন্তু গণমাধ্যমে তখনও পাকিস্তান-চিন ঢাকঢোল পিটিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্যের কথা বলেছিল। সেই ট্রেডিশন আজও সমানে চলেছে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Bangladesh India Sheikh Hasina Delhi Theke Bolchi
Advertisment