Advertisment

বাজেটের এক সপ্তাহ পার, এখনও বোঝা গেল না প্রয়োজনীয়তা

এই বাজেটের যত গভীরে ঢোকার চেষ্টা করছি, তত এর অগভীর চরিত্র প্রকট হচ্ছে। এত অর্থ, এত সময় ব্যয় করে এত তুচ্ছ একটি দলিল তৈরী করার যথার্থতা বা প্রয়োজন, কোনোটাই যেন বোধগম্য হচ্ছে না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
india budget 2020

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

বাজেট পেশ হওয়ার পরে সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। এখনো অনেক সাধারণ মানুষ বুঝে উঠতে পারছেন না, কী হলো বা কেন হলো। বিশেষজ্ঞ বা সমঝদারেরাও পুরোটা অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। আমিও তথৈবচ। আসলে এই বাজেটের যত গভীরে ঢোকার চেষ্টা করছি, তত এর অগভীর চরিত্র প্রকট হচ্ছে। এত অর্থ, এত সময় ব্যয় করে এত তুচ্ছ একটি দলিল তৈরী করার যথার্থতা বা প্রয়োজন, কোনোটাই যেন বোধগম্য হচ্ছে না।

Advertisment

তাহলে কেন এই বাজেট তৈরি করা হলো? আসুন, একটু অন্যভাবে বোঝার চেষ্টা করি। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় 'সমাজতান্ত্রিক' কথাটা ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২ তম সংশোধনের দ্বারা উপস্থাপিত হয়। ভারতবর্ষ নিজেকে কোনোদিন সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আদৌ গড়ে তুলতে পেরেছিল কিনা, সেই তর্কে যাওয়া এই লেখার পক্ষে নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু ১৯৯১ সালে উদারীকরণ নীতি প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গেই যে 'সমাজতান্ত্রিক' কথাটা অনাবশ্যক হয়ে পড়ে, তা বলাই বাহুল্য। এখন প্রস্তাবনায় এই কথাটা এতটাই দৃষ্টিকটু যে আমি তার আশু অপসারণ দাবি করি।

আরও পড়ুন: বাজেট ২০২০: শেষমেশ মধ্যবিত্তের হাতে রইল সেই পেনসিল

সমাজতান্ত্রিক যদি না হয়, তাহলে আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্রটা কী? আমরা কি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের নাগরিক?

বেশ কয়েক বছর ধরে এই বিশ্বাস বহন করেছিলাম যে ভারতবর্ষ আসলে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র (Welfare State), তার চরিত্র বা ধরন যাই হোক না কেন। এই রাষ্ট্র তার প্রান্তিক নাগরিক সহ সকলের ন্যূনতম সুরক্ষা ও কল্যাণের দায়বদ্ধতা বহন করে। এই ওয়েলফেয়ার স্টেটের চশমা পরে বহুদিন ধরে সরকারের সেন্ট্রাল সেক্টর স্কিম ও সেন্ট্রালি স্পন্সরড স্কিমগুলিকে দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই সব স্কিমের আওতায় পড়ে খাদ্য ভর্তুকি, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন, সমন্বিত শিশু বিকাশ পরিষেবা, মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা, ইত্যাদি। নিন্দুকেরা অবশ্য বলে এসেছেন যে এই প্রকল্পগুলি আদতে দারিদ্রকে পরিচালনা (poverty management) করার কিছু পন্থা। চরম দারিদ্র থাকলে 'প্রজাদের' বিদ্রোহ করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, তাই দারিদ্রকে 'পরিচালনার' মাধ্যমে শাসনে রাখতে হয়।

কংগ্রেস পার্টি বহুকাল শাসকের আসনে বসে রাজত্ব করার অভিজ্ঞতায় অন্তত এটুকু বুঝত যে নির্বাচনী গণতন্ত্রে জনপ্রিয়তা এবং শাসনের সম্মতি (consent for rule) বজায় রাখতে হলে নিজেদের জনদরদী ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখা অত্যাবশক। বিজেপি নিজেদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ঔদ্ধত্যে, ও ধর্মীয় মেরুকরণ জনিত জনপ্রিয়তার প্রতি নিবিড় আস্থায়, অর্থনৈতিক জনপ্রিয়তাকে হয়তো বা অবান্তর মনে করছে। এই ঔদ্ধত্য ও জনপ্রিয়তার সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত করতে হবে তাদের নব্য-উদারপন্থী (neo-liberal) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শন। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা এখানে বলে রাখা প্রয়োজন। নব্য-উদারপন্থী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শন তার নিজের ব্যাকরণ মেনেই ফলপ্রসূ হয় যদি সার্বিক ভাবে দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠান স্বাধীন ও দক্ষভাবে পরিচালিত হয়। এই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শন সর্বসাধারণের কল্যাণ নির্ধারণ করতে আদৌ পারে কিনা, তা অন্য এক বিতর্কের জন্য তোলা থাকল।

আরও পড়ুন: স্বাস্থ্য পরিষেবার সংকট ও সরকারের ভূমিকা

এই প্রেক্ষাপটে পুনঃনিরীক্ষণ করা দরকার ২০২০-২১ বিত্তবর্ষের বাজেট। নব্য-উদারপন্থী দর্শনে রাষ্ট্রের আদর্শ অর্থনৈতিক ভূমিকা কী হওয়া উচিত? সহজ করে বুঝতে হলে, রাষ্ট্র তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সরলীকরণ করবে, কিন্তু অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করবে না, যতদূর সম্ভব। বাজারের নিয়মে এবং বাজার দ্বারা চালিত হবে দেশের অর্থনীতি। যদি কখনো চরম প্রয়োজনে সরাসরি অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে, তখনও কিন্তু রাষ্ট্রকে মিতব্যয়ী (fiscally prudent) থাকতেই হবে। এহেন রাষ্ট্র অর্থনীতিতে আর্থিক হস্তক্ষেপ (monetary intervention) করতে পারে, কিন্তু রাজস্বঘটিত হস্তক্ষেপ (fiscal intervention) নিষিদ্ধ। আর যদি একান্তই নিরুপায় রাষ্ট্রকে বাধ্য করা হয় রাজস্বঘটিত হস্তক্ষেপে, তবে তা কর (tax) কমানো বা বাড়ানোয় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সরকারি খাতে ব্যয় করা যাবে না।

এই দর্শনের ধারক ও বাহক বিজেপি, তাই ক্ষমতায় এসেই এই সরকার প্রথমেই তুলে দেয় প্ল্যানিং কমিশন। রাষ্ট্র যখন অর্থনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করবেই না, তখন একটা পুরোদস্তুর প্ল্যানিং কমিশনকে মাইনে দিয়ে পুষে রাখা সত্যিই নিষ্প্রয়োজন। নীতি আয়োগের ভূমিকা পরিচালনা পরামর্শদাতার (management consultant)। যে রাষ্ট্র অর্থনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করে না, বা যার কল্যাণমূলক কোনো আঙ্গিক নেই, তার বার্ষিক বাজেটও আলাদা করে কোনো পথ নির্দেশ করে না। পথ আগেই নির্ধারিত হয়ে রয়েছে।

বোঝা গেলেও তো সবকিছু মেনে নেওয়া যায় না, আর তাতেই যত জ্বালা।

আরও পড়ুন: বাজেটের কল্যাণে ফিরে আসবে কি মধ্যবিত্তের ‘অ্যাসপিরেশন’?

এলআইসি এমন একটি সংস্থা, যা এতগুলো বছর ধরে খোলা বাজারে বেসরকারি বীমা কোম্পানীদের সাথে লড়াই করে ৭০ শতাংশের বেশি বাজার ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিপুল উদ্বৃত্তের অধিকারী এই সংস্থা বারে বারে সরকারকে সেই উদ্বৃত্ত ব্যবহার করতে দিয়েছে। এলআইসি আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ, আমার আপনার সকলের সম্পত্তি। এলআইসি-র এই নির্লজ্জ বেসরকারিকরণ তাই কষ্ট দেয়। আমার আপনার সার্বভৌমত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে অর্থমন্ত্রী এই বাজেটে ঘোষণা করলেন যে বিদেশী সরকারের সার্বভৌম ধন তহবিল (sovereign wealth fund) অগ্রাধিকার সেক্টরে ৩১ মার্চ, ২০২৪-এর আগে পুঁজি নিবেশ করলে সুদ, লভ্যাংশ ও মূলধনী মুনাফার ওপর আগামি তিন বছর ১০০ শতাংশ কর অব্যাহতি পাবে। কেন এই সুবিধে শুধু বিদেশী সরকারের সার্বভৌম ধন তহবিলের জন্য? আমি আপনি এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম কেন?

বাজেট যেহেতু অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহের সঠিক দিশা আর দেখায় না, এবং সুদূর ভবিষ্যতেও দেখাবে না, তাই আমাদের চোখ খোলা রাখতে হবে সারা বছর ধরে ঘোষণা করা অজস্র কেন্দ্রীয় সরকারি বিজ্ঞপ্তির দিকে। এবং চোখ খোলা রাখতে হবে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশী বেসরকারি লগ্নির গতিপ্রবাহের দিকে। উদাহরণ স্বরূপ, চোখ খোলা রেখে বোঝার চেষ্টা করুন, কেন ২০১৯-এ রেকর্ড সৃষ্টি করা বিদেশী পুঁজি লগ্নি করা হয় দেশীয় পরিকাঠামো সংস্থাগুলিতে, অথবা কেন ভারতীয় ডাক বিভাগের পরিকাঠামো পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে ব্যবহার করার আলোচনায় আমরা অংশগ্রহণ করছি।

আমার পরিচিত এক জমিদার পরিবারের গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক। আপাদমস্তক সামন্ততান্ত্রিক ভাবনাচিন্তা পোষণ করা এক জমিদার পরিবারের উত্তরসূরি আমাকে একদা বলেছিলেন যে অর্থের প্রয়োজনে কাজ করে "ছোটলোকেরা"। অর্থের প্রয়োজন হলে তিনি তাঁর বিস্তৃত পৈতৃক সম্পত্তির কিছুটা বেচে দিতেন। সামন্ততন্ত্রের উত্তারিধকারী ও সমাজতন্ত্রের দায়বহনকারীর মাঝে কোথাও যেন আমরা হারিয়ে যাচ্ছি।

(লেখক অর্থনীতিবিদ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নোতর দাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন https://t.me/iebangla

Union Budget 2020
Advertisment