Advertisment

জাতের নামে বজ্জাতি আর কতদিন?

তথাকথিত 'দলিত' হিসেবে চিহ্নিত করে সমাজেরই অংশীদার এক বিরাট সংখ্যক মানুষের ওপর যুগ যুগ ধরে যে হেনস্থা, নির্যাতন ও অত্যাচার চলেছে, তা আর যাই হোক, শাস্ত্রের নীতি অনুসরণ করে না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
dalits beaten up

দলিত নিগ্রহের অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে একটি। গুজরাটের উনা শহরে দলিতদের মার। অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

বহু বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। দূরপাল্লার ট্রেনে কলকাতা ফেরার পথে এক দক্ষিণ ভারতীয় যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। বাড়ি বেঙ্গালুরুতে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ওই ছেলেটি জীবনে প্রথম তার এলাকার বাইরে এতদূরে এসেছে জীবিকার প্রয়োজনে। হাওড়ার দাসনগরে কোনও একটি ফ্যাক্টরিতে চাকরি পেয়েছে সে। খুব অসহায়ের মতো কামরার সবার কাছে জানতে চাইছে, কিভাবে দাসনগর যাবে। তার দক্ষিণ ভারতীয় টানে বলা ইংরেজি কেউই তেমন বুঝতে পারছে না।

Advertisment

যাই হোক, আমি যেচেপড়ে আলাপ করে, যথাসাধ্য সহজে, হাওড়া স্টেশনে নেমে কী করে সে দাসনগর পৌঁছবে, সে উপায় বাতলে দিই। আমাদের আলাপকালে আমাদের মধ্যে ঠিকানা বিনিময় হয়েছিল, এটুকু মনে পড়ছে। এমন তো কতই আলাপ বা ঠিকানা বিনিময় হয় পথেঘাটে। আমরা ভুলেও যাই ব্যাপারটা। কিন্তু ছেলেটি ভোলেনি।

প্রায় এক মাস পর প্রবল কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দীর্ঘ এক চিঠি লেখে সে আমায়। খুবই সুন্দর সেই প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তিতে এক অদ্ভুত বিষয় সংযোজিত হয়েছিল সেদিন, যা প্রথম এদেশের জাতপাতের ক্ষুদ্র ও অনুদার দিকটি সম্পর্কে ধাক্কা দিয়ে অবহিত করে আমায়। ঘটনাচক্রে সেই সময় আমার বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছেন এক কর্ণাটকি ব্রাহ্মণ। সম্পর্কে বাড়ির জামাই।

আরও পড়ুন: অঙ্গদান: যতটা প্রয়োজন, আমরা ততটা পারি না কেন?

ট্রেনে আলাপিত ওই যুবকের কৃতজ্ঞতা-ভরা চিঠি প্রাপ্তির পর আমার আবেগ ও উচ্ছ্বাসের বহর দেখে জামাই বাবাজি দেখতে চাইলেন চিঠিটি। আমি দেওয়ার পর উল্টেপাল্টে চিঠির শেষে নাম দেখেই নাকমুখ কুঁচকে এক অদ্ভুত ভঙ্গি করে চিঠিটা ফেরত দিলেন আমায়। বক্তব্য, ট্রেনের ওই যুবক আদতে নিচু জাতের। ক্রিস্টান হয়ে লেখাপড়া শিখে চাকরি পেতে পারে। কিন্তু মেলামেশা দূর, ওদের ছায়াও মাড়ায় না তাদের অঞ্চলের উচ্চবর্ণের মানুষ। বলা বাহুল্য, তিনি নিজেও ওই উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি। তাঁর অভিব্যক্তি বলছিল, চিঠি পড়াটা ছায়া মাড়ানোরই শামিল।

কমপক্ষে তিনটি দশক পার করেছি তারপর, ভারতবর্ষে জাতের নামে বজ্জাতি আজও সমানে চলছে। অতি সম্প্রতি গুজরাতে এক দলিত কিশোরকে বেধড়ক মারা হয়। ছেলেটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার অপরাধ, সে তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষদের সামনে হোটেলে এক চেয়ারে বসেছিল। 'তথাকথিত' কথাটা এই জন্যই বলা, আমার কাছে এই বর্ণ বিভাজন, জাতপাতের বৈষম্য কোনও যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হয়নি কোনওদিনই। কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছেই নয়। প্রসঙ্গত, ঘটনাটি ঘটে সংবিধান দিবসের দিনেই। এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে? ভারতীয় সংবিধান, যা দেশের সব মানুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।

অকুস্থল গুজরাট। চোদ্দ বছর বয়সী তফসিলি জাতিভুক্ত বনসকান্থা জেলার জেরদা গ্রামের বাসিন্দা ক্লাস নাইনে পাঠরত কিশোরটি টিউটোরিয়াল ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরছিল। দীসা গ্রামীণ পুলিশের দায়ের করা এফআইআর-এ প্রকাশ, ফেরার পথে কিশোরের পথ আটকায় দরবার সম্প্রদায়ের চারজন। আটকানোর পরই প্রশ্ন, "হোটেলে কোন সাহসে আমাদের উপস্থিতিতে চেয়ারে বসলি তুই?" এরই সঙ্গে নানাভাবে হেনস্থাও করে তারা ওই কিশোরকে। ছেলেটি বাধা দিতে গেলে শুরু হয়ে যায় মারধর।

ওই সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন তফসিলি সম্প্রদায়েরই এক তরুণ। তিনি দৌড়ে এসে বাধা দিতে গেলে, তাঁকেও ওই চারজন বেধড়ক মারে। শেষে দু'জনের চিৎকার শুনে আরও অনেকে ছুটে আসেন ও দুষ্কৃতীরা পালায়। বোঝাই যায়, আচরণের কোনও নৈতিক ব্যাখ্যা এদের নিজেদের কাছেও নেই। তাই ভিড় জমতেই পলায়ন।

আরও পড়ুন: রসিকতা যখন অমানবিক, তামাশা যখন বিকৃতি

নৈতিক ব্যাখ্যা থাকবেই বা কেমন করে? তথাকথিত 'দলিত' হিসেবে চিহ্নিত করে সমাজেরই অংশীদার এক বিরাট সংখ্যক মানুষের ওপর যুগ যুগ ধরে যে হেনস্থা, নির্যাতন ও অত্যাচার চলেছে, তা আর যাই হোক, শাস্ত্রের নীতি অনুসরণ করে না। প্রাচীন ভারতে শাস্ত্রমতে চার বর্ণের উল্লেখ রয়েছে - ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য, শূদ্র। সামাজিক ক্ষেত্রে মানুষের যে পেশা, সেই  হিসেবেই এই বিভাজন। এখানে কোথাও উচ্চ-নীচ ভেদাভেদের উল্লেখ নেই। পরে জাতি ও বর্ণ, এই দু'ভাবে বিষয়টি দেখা হয়।

এর সঙ্গে আবার ধর্মের জটিলতাও যুক্ত হয়। জটিলতা না তো কী? হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, কোনও ধর্মেই তো মানুষকে ঘৃণা করবার শিক্ষা দেওয়া হয় না। কিন্তু আমরা কি সেটা মানি? আমরা তো উল্টোটাই করি। উল্টোপথে চলতে চলতে বর্ণ-জাতি-ধর্ম গুলিয়ে একাকার। বেড়া তুলতে তুলতে, নিজের ছায়ার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি আমরা, সেটা বোঝার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি।

ইতিহাস বলে, প্রথমে মুঘল ও পরে ব্রিটিশ, এই দুই শক্তির প্রভাব ও দেশ শাসন-পরিচালনা পদ্ধতির প্রেক্ষিতে এই জাতি-বর্ণ বিভাজন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়। নীতি-নিয়মের ক্রম পরিবর্তন ও সংযোজনে ৩,০০০ জাতি ও ২২,০০০ উপজাতিতে বিভক্ত হয় প্রাচীন মূল চার বর্ণ। বলা বাহুল্য, বিভিন্ন যুগে এই ব্যাপক হারে বিভাজনকালেই সাধারণের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন সীমারেখা তৈরি হয়।

সমাজ একশ্রেণীর মানুষকে 'দলিত' বলে চিহ্নিত করে। সেটা যত না প্রাচীন শাস্ত্রসম্মত, তার চেয়ে অনেক বেশি স্বার্থান্বেষী মানুষের ক্ষুদ্র স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে তৈরি। তা নাহলে একজন মানুষ অপর আরেকজন মানুষকে কেমন করে এতটা ঘৃণার চোখে দেখে যে তার ছায়াও মাড়ানো বারণ হয়ে যায়? এদেশে 'অনার কিলিং'-এর অধিকাংশ ঘটনা ঘটে এই উঁচু-নীচু বর্ণ, জাতি ও ধর্মীয় বিভেদ-বিভাজনের চক্করে। প্রশাসন হাজার চেষ্টা করেও রোধ করতে পারছে না এই নারকীয় হত্যালীলা।

উল্লেখযোগ্য, একদা এই বিভাজন ও সেই অনুষঙ্গেই সংরক্ষণ প্রথা সরকারি-বেসরকারি স্তরে চালু হয় এদেশে। এ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক, অশান্তি পার করে একটা সময় জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করে বিষয়টি। কিন্তু এই আইন প্রণয়ন, সরকারি স্বীকৃতিও মুছে দিতে পারেনি দলিত মানুষজনের প্রতি উচ্চবর্ণের দৃষ্টিভঙ্গির বৈষম্য। সাম্প্রতিক এক খবরে প্রকাশ, দেশের প্রথম সারির এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে 'দলিত' শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীরা যোগ্যতা সত্ত্বেও সংরক্ষণের শতাংশের হিসেবে তাঁদের প্রাপ্য চাকরি, পদমর্যাদা, পদোন্নতি, কোনওটাই পাচ্ছেন না। তাঁরা প্রবলভাবে নিগৃহীত ও অসম্মানিত। নিগ্রহের শিকার কলেজে পাঠরত ছাত্রছাত্রীরাও।

আরও পড়ুন: ওরে, আমার পেঁয়াজ গিয়েছে চুরি!

অর্থাৎ প্রথমে সামাজিক নীতি নির্ধারকদের দ্বারা কিছু মানুষের 'দলিত' হওয়া। তারপর তাঁদের উন্নতি প্রকল্পে কিছু সুবিধা দেওয়ার আইন চালু। শেষে সেই আইনকে কলা দেখিয়ে সেখান থেকেও আবার তাঁদের বঞ্চিত করা। এই প্রবঞ্চনা কার সঙ্গে? শুধু কি দলিতদের প্রতি? যে ছাত্রছাত্রীরা একজন সুযোগ্য শিক্ষকের কাছে বিদ্যাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হলো, তারা তো নিঃসন্দেহে! আর সামগ্রিকভাবে যে বিভেদের সংস্কৃতি, যে ঘৃণার আবহ তৈরি হলো, তাতে তো পুরো দেশের, পুরো সমাজেরই অবদমন ঘটছে। এরা কী পরিমান আত্মপ্রবঞ্চক ভাবুন। আত্মপ্রবঞ্চক না হলে এখানে রাজনীতিতে এত ব্যাপক হারে জাতপাতের ব্যাপারটা গুরুত্ব পেত না। আসলে সবটাই প্রয়োজনভিত্তিক ব্যবহার। মনুষ্যত্বের এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কিছু হতে পারে কি?

স্বাধীনতার পর কয়েক যুগ পার হয়ে গেল। আমরা মানুষ হিসেবে সাবালক হতে পারলাম না। দলিতদের ওপর বারবার ঘটে যাওয়া নিগ্রহ, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা প্রমাণ করে, আমরা এখনও মনুষ্যত্বকে একজন মানুষকে বিচারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে পারিনি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে উচ্চ রুচি, শিক্ষা ও মানবিক গুণ, সামাজিক চেতনার প্রকাশ। আবার ঠিক উল্টোটাই দেখেছি বেশ কয়েকজন সমাজ-নির্দিষ্ট উচ্চবর্ণের লোকজনের মধ্যে।

আসল কথা হলো, ওই বিভাজন রেখাটাই যে ভিত্তিহীন। এতকাল ধরে ভিত্তিহীন এক বিষয়কে আঁকড়ে, কোন মহত্ত্ব লাভ করলাম আমরা, সে তো সময়ই বলবে। তবে যে কথা এখনই দাঁড়িয়ে বলা যায়, সব ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া আছে। ঘৃণা ও বিদ্বেষ জন্ম দেয় আরও ঘৃণা ও বিদ্বেষের। সব কিছু ছারখার হয়ে যাওয়ার আগে একবার ভেবে দেখবেন সবাই।

Dalit
Advertisment