দেশীয় ব্যাংকগোষ্ঠীর ৯৪০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে মসৃণভাবে বিলেতে পালানোর পরে বিজয় মালিয়া এবার বুঝিয়ে ছাড়লেন, দেশটি এখনও বিলেতের উপনিবেশই। কেননা, একজন আর্থিক-অপরাধীর অভিযোগসাপেক্ষে বিলেতের আদালত ভারতের শীর্ষ-গোয়েন্দাসংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছিল মুম্বইয়ের আর্থার রোড কারাগারের চিত্রচরিত্র জানাতে। সেই নির্দেশ পেয়ে সিবিআই-ও নিরাপত্তার বালাই ভুলে তড়িঘড়ি মালিয়ার প্রস্তাবিত জেলকক্ষের ভিডিয়ো পাঠিয়ে দিয়েছে বিচারকের কাছে। তবে, তাতে যে মালিয়া ও তাঁর আইনজীবী বা বিচারক বিশেষ-প্রীত হয়েছেন, তা নয়। বরং, নাক সিঁটকেছেন। কেননা, মালিয়া তাঁর যে-পছন্দসই জেলঘরের প্রস্তাব দিয়েছেন, তা প্রায় দেশের পাঁচতারা-হোটেলের সমতুল্য। ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও মানবাধিকারের দশা ভুলে ইউরোপীয় মানবাধিকারের নিরিখে ব্রিটেন বিচার করেছে মালিয়ার মানবাধিকার। এমনধারা নির্দেশে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, তারা মনে করছে, দেশটি এখনও মহারানির খাস-তালুক। সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক যে, মালিয়ার জালিয়াতি নিয়ে দেশে শাসক-বিরোধীর রাজনৈতিক তর্জায় কখনও এই বিষয়টি উত্থাপিতই হয়নি। বোঝা যায়, দেশের সার্বভৌমত্বের চেয়ে মালিয়ার স্বাচ্ছন্দ্যই তাদের কাছে বেশি-জরুরি।
২০১৬ সালের মার্চে দেশ ছেড়ে বেপাত্তা হওয়ার আগে দু-বারের রাজ্যসভা-সাংসদ বিজয় মালিয়া সাংসদপদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। সংসদীয় কমিটি অবশ্য সেই ইস্তফাপত্র অগ্রাহ্য করে তাঁকে ‘বরখাস্ত’ করে। তারপরেই সরকারের ‘লক্ষ-রাখো’ বিজ্ঞপ্তি অগ্রাহ্য করে মুক্ত-বিহঙ্গের মতো তিনি উডে যান বিলেতে। সেখান থেকেই ইন্দ্রজিতের মতো নানা তির ছুড়তে থাকেন সরকার ও ব্যাংকগুলির দিকে। তাঁর সাম্প্রতিকতম তিরটি বিদ্ধ করেছে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে। মালিয়া জানিয়েছেন, দেশ ছাড়ার আগে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে খাস-সংসদেই তাঁর বৈঠক হয়েছে। তখন তিনি তাঁকে ব্যাংকের টাকা-ফেরতের সদিচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। পরে জেটলি ওই সাক্ষাৎকার অস্বীকার না-করলেও বলেছেন, সেই সাক্ষাৎকার কোনও বিধিবদ্ধ বৈঠক নয়। করিডোরের চলতি-কথা মাত্র। যদিও, পরে প্রাক্তন কংগ্রেস-সাংসদ পান্নালাল পুনিয়া জানিয়েছেন, তিনি সংসদের সেন্ট্রাল হলে মালিয়ার সঙ্গে জেটলিকে ঝাড়া কুড়ি-মিনিট বৈঠক করতে দেখেছেন। প্রদত্ত-তথ্যের ভিত্তিতে সিসি-টিভি নিরীক্ষার দাবিও তুলেছেন তিনি। তারপরেই রাহুল গান্ধী মিথ্যাচারিতার অভিযোগ তুলেছেন জেটলির বিরুদ্ধে। বিজেপি-র মুখপাত্র সম্বিত পাত্র পালটা-তির ছুড়েছেন রাহুল-মালিয়া আর্থিক সম্পর্কে কটাক্ষ করে। দেশে এমন বিবাদ একটি প্রচলিত-মুদ্রা। একটি-অন্যায় দিয়ে অন্যটিকে মান্যতা-দেওয়া। ঈপ্সিত-বাদানুবাদে নিশ্চয়ই খুশি ধনকুবের।
আরও পড়ুন, দেশ ছাড়ার আগে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম: বিজয় মালিয়া
যে-বিজেপি অনুক্ষণ দেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতার ধুয়ো তোলে, তারা রাজনৈতিকভাবেও বিষয়টি নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেনি। বিরোধীদেরও মুখে কুলুপ। বিদেশে পরমাণুতথ্য পাচারের ভুয়া-অভিযোগে ইসরোর বিজ্ঞানী নাম্বি নারায়ণনকে জেলবাস করতে হলেও, দেশের অন্যতম কারাগারের গোপনীয় তথ্য সরকারিভাবে বিদেশের আদালতে প্রকাশ্য করে দেওয়ার বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই কেন্দ্রের। কেননা, দেশের প্রখ্যাত-বিদ্বজ্জনদের মানবাধিকার উপেক্ষা করে তাঁদের একযোগে গ্রেফতার করলেও, মালিয়ার মানবাধিকারে তারা সতর্ক ও সচেতন।সেই মতো তারা জেলের প্রশস্ত-স্নানাগার ও গবাক্ষবিশিষ্ট কক্ষের ভিডিয়ো পাঠিয়ে দিয়েছে ব্রিটেনের আদালতে। মালিয়ার মানবাধিকারে তারা পান থেকে চুন খসতে দিতে নারাজ। মদকুবের মালিয়া যে জেলের ভিতরে অতিথিদের জন্য সেলার চাননি, সাঁতারপুকুর চাননি, হয়তো তাতেই তারা কৃতজ্ঞ। কিন্তু, হলে হবে কী! আদালত ও মালিয়ার আইনজীবী ভিডিয়োটি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে মোটেই খুশি নয়। তারা মালিয়ার কারারুদ্ধ-জীবনে আরও আলোবাতাস প্রবাহিত করতে চান।
প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে প্রথম-বিশ্বের কোনও দেশ এমন মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলতেই পারে। বিদেশের আদালতে কোনও বিচারপ্রক্রিয়ায় এমন রায় দিতেই পারেন সংশ্লিষ্ট-বিচারক। কিন্তু, রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকারও নিশ্চয়ই থাকে বিরুদ্ধ-পক্ষের। কেন্দ্রের হয়ে লন্ডনে মামলা লড়ছে ব্যয়বহুল আইনি সংস্থা ‘দি ক্রাউন প্রোসেকিউশন সার্ভিস’। তারা আইন-মোতাবেক বিষয়টি মেনে নিলেও, সংস্থাটিকে কেন্দ্র এ-বিষয়ে বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল করেছে বলে কোনও দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যে জানায়নি। সংস্থাটি যেহেতু কেন্দ্রের কাছ থেকে নিজেদের আর্থিক প্রাপ্য কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেবে, সেহেতু বিষয়টি নিয়ে তাদের সরব হওয়ার প্রাসঙ্গিকতা অগ্রাহ্য করা যায় না। মালিয়া যদি দেশের জেলে নিরাপত্তা ও পরিবেশগত সুবিধার দাবিদার হন, ভারতের পক্ষেও সে-ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বের আন্তর্জাতিক অধিকার দাবি করা অসংগত নয়। বিশেষত, কেন্দ্র যখন দেশের মানুষকেই ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ রাফাল-বিমানের দরদামটুকু জানাতেও নারাজ, তখন তাদের এই পবিত্র-নীরবতা কোনওভাবেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকে না।
মামলাটির গতিপ্রকৃতি দেখলে বোঝা যায়, বিলেতের আদালত গোটা বিষয়টিই দেখছে মালিয়ার দিকে দাঁড়িয়ে। এর আগে ওয়েস্টমিনিস্টার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের বিচারক এমা আরবাথনট জানিয়েছিলেন, এই মামলাটি আসলে একটি ‘জিগস পাজল’। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ব্যাংকগুলি মালিয়াকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব লক্ষ্মণরেখাই মানেনি। এমনকী, ব্যাংককর্তাদের একাংশও যে মালিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন, তা-ও এখন পরিষ্কার। মালিয়ার কৌঁসুলি ক্লেয়ার মোন্টগোমারিও ষড়যন্ত্রের তত্ত্বে জোর দিয়েছেন। সে-কারণে ব্যাংককর্তাদের আদালতে হাজিরও করাতে চান তিনি। সবটাই চলছে মেগা-সিরিয়ালের চিত্রনাট্য মেনে। অবশ্য, এই তথ্যও মনে রাখা দরকার, ভারতের অভিযোগে লন্ডনে মালিয়াকে গ্রেফতার করেছিল সুবিখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-ই। সাড়ে-ছয় কোটি পাউন্ডের জামিননামার বিনিময়ে তিনি আপাতত মুক্ত। তা-ও আসলেই চিত্রনাট্যের বাঁক। যে-বাঁক নেই নীরব মোদী বা মহুল চোসকির মহার্ঘতর-ধারাবাহিকে।
এ-কথা ঠিক, ব্রিটেনে-বসবাসকারী শিখজনগোষ্ঠীর সমানাধিকার ও মানবাধিকারের চেয়ে ব্রিটেনবন্ধু মালিয়া স্বভাবতই অপেক্ষাকৃত-বেশি সুবিধা পাবেন। কেননা, তিনি বন্ধুদেশের প্রাক্তন-সাংসদ, ধনকুবের, পানামা-নথি ও প্যারাডাইস-নথিভুক্ত। কেবল বিজেপি-র নয়, অতীতে কংগ্রেসেরও মধুর-সম্পর্ক ছিল মালিয়ার সঙ্গে। ২০০২ সালে তিনি কংগ্রেস ও জনতাদলের (স) সমর্থনে নিজের রাজ্য কর্নাটক থেকে রাজ্যসভার ভোটে জিতেছিলেন। ২০১০ সালে বিজেপি-র সমর্থনে ফের সাংসদ হয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলি ধনকুবেরদের কেন রাজ্যসভায় পাঠায়, তা সহজবোধ্য। তাছাড়াও, একদা মালিয়া অধিপতি হিসাবে আমাদের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের নামের আগে নিজের দুটি মদসংস্থার নাম জুড়ে দিতে পেরেছিলেন। ফরমুলা-ওয়ান গাড়িদৌড়েরও স্থপতি তিনি। এমন আন্তর্জাতিক গুণিজনের পাশে দাঁড়ানোর দায়বদ্ধতা থাকেই মুক্তমনা দেশের।
কথা তা নয়। কথা হল, মালিয়া অভিযোগ করেছিলেন, জেলে যেতে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু, ভারতীয় জেলগুলি একটুও স্বাস্থ্যকর নয়। জেলের কুঠুরিতে আলোবাতাস খেলে না, সেগুলি একেবারেই অপরিসর, জনাকীর্ণ, দাগি-অপরাধী গিজগিজ করছে সেখানে (যেন, ব্রিটেনের জেলে কেবল সাধকেরা থাকেন)। মালিয়া চেয়েছেন, তাঁকে একটি সুপরিসর ব্যারাকে রাখতে হবে, শয়নকক্ষটি হবে প্রশস্ত ও ঠান্ডাযন্ত্র-সমন্বিত। সামনে থাকবে বিস্তৃত উঠোন, অতিথি-আপ্যায়নব্যবস্থা, আধুনিক স্নানাগার, বিলাসি শৌচাগার, এবং সর্বোপরি একটি নাতিদীর্ঘ গ্রন্থাগার, চেয়ার-টেবিল। এতটুকু তিনি চাইতেই পারেন। গ্রন্থাগারের দাবিটি অভূতপূর্ব হলেও অস্বাভাবিক নয়। মালিয়া নিশ্চয়ই জানেন, অতীতে জওহরলাল নেহরু থেকে নজরুল ইসলামের মতো বন্দিরা কারাগারে প্রভূত সাহিত্যরচনা করেছেন। মালিয়ার পক্ষে একটি আত্মজীবনী লেখার তাগিদ নিশ্চয়ই প্রাসঙ্গিক ও জরুরি। তাঁর ঘনঘটাময় আত্মজীবনী প্রকাশের জন্য মুখিয়ে থাকবে আন্তর্জাতিক প্রকাশনসংস্থাগুলি। মালিয়ার এই ন্যূনতম-চাহিদাগুলি পূরণ না-করার কোনও সঙ্গত কারণ নেই। সে-জন্য বিলেতের সামান্য-প্রভুত্ব মেনে নেওয়াই যায়। সর্বোপরি, এ-কথাও ভুললে চলে না, আমরা এখনও কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত।